মানুষ হওয়ার সময় এখনও নয়!

Slider জাতীয় টপ নিউজ বাধ ভাঙ্গা মত সম্পাদকীয় সারাদেশ

রিপন আনসারী: ইতিহাস ভঙ্গ করে বিশ্ব মহামারী আকারে সকল দেশে এখন করোনা নামক শত্রুর একচ্ছত্র প্রভাব। প্রতিষেধক আবিস্কার করতে পারিনি বলেই আমরা ঘরে বসে যুদ্ধ করছি দরজা জানালা বন্ধ করে। অদৃশ্য শত্রুর বিরুদ্ধে আমাদের জীবন-মরণ যুদ্ধ এখন নিত্যদিনের। প্রতিদিন হু হু করে বাড়ছে করোনার ছোবলে লাশ হওয়া মানুষের সংখ্যা। এক লাখ ছুঁই ছুঁই অংকে মৃত মানুষের লাশের মিছিল। স্পষ্ট করে কোন দেশ এখনো বলতে পারছে না, করোনার প্রতিষেধক কি। এই অবস্থায় আমরা সবাই আতঙ্কিত। একমাত্র ভরসা স্ব স্ব ধর্মের প্রধানের করুনার উপর। আমরা মসজিদে মন্দিরে গির্জায় প্রার্থনা করছি, এই বিপদ থেকে আত্মরক্ষা করতে। আমরা স্রষ্টার উপর পূর্ন বিশ্বাস রেখে আশা করছি, একদিন আলো আসবেই। পবিত্র শবেবরাতের রাতে এই হউক আমাদের প্রধান অঙ্গিকার।

করোনার আক্রমন কত ভয়াবহ যে, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্টের অধিপতি বলেছেন, তিনি পরাজিত। জনগনের নিকট বার বার কান্নাকাটি করছেন আমেরিকার রাষ্ট্রপতি। মহাশক্তিধর আরেক দেশের প্রধানমন্ত্রী করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে এখন করোনায় আক্রান্ত। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অনেক নামী দামী মানুষও করোনায় মারা গেছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতি, সাবেক খেলোয়ার, অভিনেতা সহ অসংখ্য বড় বড় মানুষকে নিয়ে গেছে করোনা নামক ভাইরাসে।

আমাদের দেশে করোনায় ছোবল বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক কম হলেও শতকরা হারে আমরা এগিয়ে আছি। এর মধ্যেই আমাদের পুঁজির উৎস বিদেশে থাকা আমাদের প্রায় শতাধিক মানুষ করোনায় মারা গেছেন। আমাদের দেশের বিশাল পুঁজির উৎসস্থল শিল্পখাত এখন হুমকির মুখে। অর্থনীতি নিয়ে আমরা চরমভাবে ভেঙ্গে যাচ্ছি। এই ভীতিকর অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে আমরা সারাদেশে অঘোষিত লকডাউন করছি প্রায় ১৫দিন থেকেই। সম্প্রতি কয়েকটি জেলা ও এলাকায় সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে লকডাউন ঘোষনা করেছে। সরকার এই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য আপ্রান চেষ্টা করছে। সকল রাজনৈতিক দল, সকল শ্রেনী ও পেশার সংগঠন এমনকি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকটি মানুষ এই অবস্থার মোকাবেলা করছেন নিজেদের নিরাপত্তার কথা না ভেবেই। লকডাউন সফল করতে দায়িত্বরত স্থানীয় বড় বড় সরকারী কর্মকর্তাগণও হোম কোয়ারেন্টিনে। করোনার ভয়ে দায়িত্ব থেকে পালিয়ে গেছে অনেক দায়িত্ব প্রাপ্ত মানুষও। তবুও আমরা আশাবাদী। আমাদের জয় হবেই। আমরা আমাদের পাশে আছি সব সময়। থাকবও ইনশাল্লাহ।

সাম্প্রতিক সময়ে মানবতার অজুহাতে কিছু অসাধু মানুষ অসহায় মানুষকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে মানে মনবতাকে অস্ত্র হিসেবে নিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার চেষ্টাও করছেন। অনেক দানবীর নিজেদের সাধ্যমত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন। সংবাদ মাধ্যমের খবর বলছে, অনেকে চাঁদা তোলে অসহায় মানুষকে না দিয়ে নিজেই আত্মসাৎ করছেন। আবার অনেকেই নেতাদের কাছ থেকে ত্রাণ বিতরণের কথা বলে নিজের ঘরেই লুকিয়ে রেখেছেন যা ধরাও পড়ছে। এই মহামারিতে যেখানে এক মুঠো ভাতের জন্য ক্ষুধার্থ মানুষ অপমান ও মৃত্যু নিশ্চিত জেনেও ঘর থেকে বের হয়ে ত্রাণের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকেন, সেখানে কোন কোন লোক ডাকঢোল পিটিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান করে গ্রেফতার ও দন্ডিতও হয়েছেন। ত্রাণ দিতে গিয়ে দিনমজুরের মেয়েকে শ্লিলতাহানীও করেছেন একজন জনপ্রতিনিধি। বিভিন্ন ধরণের সহায়তা করার কথা বলে কিছু অসাধু জনপ্রতিনিধিদের লালসার শিকার হওয়ার ঘটনা নজরে আসে কম কিন্তু ঘটে বেশী। অনেকে ত্রাণ দিয়ে ছবি তোলে হায়েনার মত ত্রাণ কেড়ে নিয়ে যায়। অনেকে আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে ত্রাণ দেয়ার কথা বলে দিতে দিতেই ত্রাণের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায়। ডাক বড় মাইর ঠোস বলে প্রবাদও কিন্তু আছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সুবাধে আমরা অনেক ঘটনা ধরতে পারছি এখন। তবে এই মহামারিতে যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম না থাকত, তবে ট্রলগুলোও কম হতো। আমরা জানতামও কম।

মানবিক সময়ে মানবতায় যেখানে নিজেকে উৎসর্গ করার কথা, সেখানে ভয়াবহ ঘটনাও ঘটছে। মানবতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে জনপ্রিয় করে তোলার চেষ্টাও প্রবল। নিজের সক্ষমতা না জেনেই অনেকে এমন কিছু কাজ করছেন, যা মানবতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ভবিষৎকে অন্ধকার করে ফেলে। ডাক্তারের দোকানে সব্জিওয়ালাকে ঔষুধ বিক্রির কথা বলে রেখে যাওয়ার পর ওই দোকানীর চিকিৎসা যে বুমেরাং হবে না, সেটা বলা যাবে না। কারণ সব্জিওয়ালা ও ওষুধওয়ালা দুটি ভিন্ন ব্যক্তি, দুটি ব্যবসা এবং দুটি আলাদ কাজ। তবে এ দুটির মধ্যে একটু ব্যতিক্রমও আছে। উল্টা-পাল্টা সব্জি খেলে হয়ত মানুষ মারা যাবে না কিন্তু ঔষুধ উল্টাপাল্টা হলে রোগী আরোগ্য লাভ করবেই না, বরং মৃত্যু বরণও করতে পারে। তাই ঔষুধওয়ালা দিয়েই ঔষুধ বিক্রি করানো উচিত। না হয় মানুষ বাঁচতে গিয়ে মরে যাবে। সুতরাং মানবতাকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে নিজেকে জনপ্রিয় করার জন্য ফটোসেশন ত্রাণ বিতরণ থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করে না। ইতিহাস লিখতেও হয় না। ইতিহাস নিজের গতিতে মানুষের মনে লিপিবদ্ধ হয়ে যায়।

এক সময় অভিযোগ ছিল, কতিপয় পুলিশ মানুষকে নির্যাতন করে ঘুষ খায় বা মানুষকে নিরাপত্তা দিতে গিয়ে মেরে ফেলে। সেই পুলিশ এখন নিজেদের বেতনের টাকা বা রেশন দেয়ার জন্য মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরছেন। ক্ষুধার্থ মানুষকে ঘর থেকে ডেকে তোলে খাবার দিয়ে আসছে পুলিশ। প্রশংসার দাবী রাখে এরকম উদাহরণ। আবার কষ্ট পেতে হয়, যখন রাজধানীতেও ওই পুলিশের কতিপয় বিপদগামী সদস্য নিস্তেজ মানুষকে কংকালে আঘাত করে। ভালো ও মন্দ মিলিয়েই আমরা। তবে সার্বিক ভাবে করোনা ভাইরাসের আক্রমনে জাতি হিসেবে আমরা অনেকটাই মানবিক হয়েছি, যা, আমরা আগে হয়ত ছিলাম না। করোনা ভাইরাসের আক্রমনে আমরা অনেক মানবিক হয়েছি। হিংসা প্রতিহিংসা ভুলে আমাদের উঁচু পর্যায়ে মনের মিলও হয়েছে। অনেক আসামী জেলমুক্তি পেয়েছেন। করোনার ভয়ে বঙ্গবন্ধুর খুনি মাজেদ হেঁটে হেঁটে ফাসির মঞ্চে এসেছেন, যাকে আমরা ধরার জন্য পাগল ছিলাম।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের রাজনীতিকদের মধ্যেও অনেকটা দূরত্ব কমে এসেছে। রাজপথের বিরোধী দলের মহাসচিব ৮৫ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ দেয়ার দাবী করার পর সরকার প্রধান বিরোধী দাবীর কাছাকছি প্রায় ৭৩ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করেন। এসব ছাড়াও বুঝা যায়, আমরা অনেকটা মানবিক হয়েছি। নিঃসন্দেহে এটা ভালো লক্ষণ।

পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে বলতেই হবে, করোনার আক্রমনের হাত থেকে রক্ষার জন্য আমাদের সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে ঘরে থাকার কোন বিকল্প নেই। জনসমাগম ও ভীড় এড়িয়ে চলতেই হবে। না হয়, নিজেকে মরতে হবে এবং অন্যকে মরতে সহযোগিতা করা হবে। এই জন্য সরকার লকডাউন করছে এটা করা উচিত এবং এর কোন বিকল্প নেই। তবে এই লকডাউন করার আগে একটু মাথায় রাখতে হবে, কি হলে মানুষ ঘর থেকে বের হবে না। মানুষের যা দরকার, তা যদি ঘরে থাকে, তবে মানুষ ঘর থেকে বের হলে কঠিন শাস্তি দেয়া উচিত। আর যদি বাঁচার জন্য ঘরে থেকে না খেয়ে মরতে হয়, তবে ওই মানুষগুলোকে ঘরে রাখা আরো কঠিন ও বিপদজনক হবে।

তাই দাবী থাকবে, সরকার যে এলাকা লকডাউন করবে, সে এলাকার মানুষের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ঘরে দিয়ে যেন তালাবদ্ধ করে রাখার ব্যবস্থা করেন। তবে হয়ত আর মানুষ সহজে বাইরে যাবে না। ত্রাণ বা সুলভমূল্যে জিনিসপত্র আনতে গিয়ে কৃত্রিম ভীড়ের জন্ম দিবে না। আর এমন হলে যারা বাইরে যাবেন, তারা নিশ্চিত অপরাধ করতেই যাবেন। আর তাদের বিরুদ্ধে যে কোন ব্যবস্থা নিলে সবাই খুশিও হবেন।

তাং ০৯/০৪/২০২০

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *