আমাদের লাশও জীবিতদের শিক্ষা দেয় না!!

Slider জাতীয়


রিপন আনসারী: রাজনীতিতে জিরো থেকে হিরো হওয়ার প্রমান লিখে শেষ করা যাবে না। কম সময়ে বেশী টাকার মালিক একমাত্র রাজনীতি বা রাজনীতির আশির্বাদ। আমাদের এই ইতিহাস যুগের পর যুগের। টাকার জন্য পরীক্ষা দিতে না পারা ছেলেটি ভিক্ষা করে লেখাপড়া শেষে মন্ত্রী হন নি, এমন নজীর আমাদের নাই, বলা যাবে না। মানুষের বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে টাকা উপার্জন করে মা ছেলেকে লেখাপড়া করিয়েছেন, মায়ের সেই ছেলে মন্ত্রী, সচিব, গভর্নর হয়নি এমনটা নয়। লেখাপড়া না জানা এমনকি গরীব বাবা-মায়ের সন্তানটিও এমপি হননি, এমন উদাহরণ থেকে রেহাই নাই। রাজধানী ঢাকায় ফুটপাতে ঘুমানো ছেলেরা সিআইপি নয়, এমনটা বলা ঠিক হবে না। যাদের বাড়িতে বাবা-মা কাজ করেছেন, তারা এখন বড় চেয়ারে বসা ওই কাজের বুয়ার ছেলের সামনে মাথানত করে দাঁড়িয়ে থেকে সাহায্য চায় না, এমন কথা বুকে হাত দিয়ে বলা মুশকিল।

আর কি চাই আমরা! কত লাগবে! করোনা ভাইরাস বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দিয়ে আমাদের বুঝিয়ে দিল, কি কি হলে আমাদের আজ অসহায় হতে হত না। কিন্তু আমরা আজ অসহায়। করোনা ভাইরাসের কাছে। এই ভাইরাস জানান দিয়ে আসলেও এন্টিভাইরাস আবিস্কার করতে পারিনি আমরা। শুধু আমরা নই, পুরো বিশ্ব। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী গতরাতে আইসোলেশন থেকে হাসপাতালে গেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী রাষ্ট্রপতিও হাল ছেড়ে দিয়েছেন। আরেকজন ক্ষমতাশালী সরকার প্রধান আলো জ্বালিয়ে করোনার করুনা চাইছেন। কিন্তু হচ্ছে না। সুতরাং মনে রাখতে হবে, সব শেষের পর শেষ আছে। শক্তি, ক্ষমতা, টাকা সবই পৃথিবীতেও অসহায় হয়, করোনার আক্রমন তার প্রমান। এরপরও আমাদের শিক্ষা হচ্ছে না। তবে আমরা এমন জাতি যে, মরার আগে শিক্ষা নিতে চাই না। আমাদের লাশও জীবিতদের শিক্ষা দেয় না। ইতিহাস যাই বলুক না কেন, করোনার আক্রমন থেকে আমাদের শিক্ষা নেয়া খুবই প্রয়োজন ছিল। যা আমরা এখনো নেই নি। সময় আছে। শিক্ষা নেয়ার। কারণ শিক্ষার কোন বয়স নেই।

বাংলাদেশ সরকার, করোনা মোকাবেলায় প্রথম দিকে জোর দিলে হয়ত আমাদের প্রস্তুতি নিতে তাড়াহুড়ো করতে হত না। যাই হউক, তার পরে হলেও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি। গতকাল সরকার প্রধান বিশ্বের সবেচেয়ে বড় প্রণোদনা প্যাকেজ দিলেন। প্রশংসাও করেছেন অনেক। প্যাকেজটিতে ৫টির জায়গায় আরো ২/১টি শ্রেনী বাড়িয়ে দিলে ভালো হতো। এই সময়ে স্বাস্থকর্মী, মিডিয়াকর্মী, প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী, বিশেষ করে সশস্ত্র বাহিনী এবং নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেনীর মানুষের জন্য খাত স্পষ্ট থাকলে আরো সুন্দর হত। তবুও যা হয়েছে, ভালোই হয়েছে। আমরা খুশি। তবে ব্যবসায়ীরা প্রথমে তাদের কর্মীদের বেতন দিবে বলে ৫ হাজার কোটি টাকা নিলেন। কিন্তু কর্মীদের বেতন দিলেন না। এমনকি প্রতিষ্ঠানগুলো কবে খোলা কবে বন্ধ, সেটাও বললেন না। অসহায় ওই শ্রমিকেরা গণপরিবহন বন্ধ থাকায় পায়ে হেঁটে এসে দেখলেন, কোন কোন প্রতিষ্ঠান খোলা, কোনটা বন্ধ আবার কোনটা লেঅফ করে দেয়া। তারা শুনলেন, অফিস খোলা হলে বেতন পাবেন। এই অবস্থায় অফিসের গেট থেকে বাসায় গিয়ে দেখলেন বাসার মালিক দাঁড়িয়ে আছেন। কারণ গ্রাম থেকে ভাইরাস নিয়ে আসতে পারে, তাই ভাড়াটিয়া শ্রমিকদের বাসায় ঢুকতে দেয়া হবে না। আর সরকার রাজধানী ঢাকাকে লকডাউন করে দিলেন। পুলিশ বলল, ঢাকা থেকে বের হওয়া যাবে না, আসাও যাবে না।

তথ্য বলছে, ৭ শতাধিক শিল্প কারখানা এখনো খোলা। ৫ লাখের উপরে শ্রমিক কাজ করেছেন গতকাল, আজো করতে হতে পারে। তাহলে এই শ্রমিকেরা কি করবে! ভাড়া বাসায় ঢুকবে! কাজে থাকবে! না বাড়িতে যেতে পারবে! সিদ্ধান্ত চমৎকার। ক্ষদার্থ এই লাখ লাখ মানুষ নিয়ে আমরা কি খেলা খেলছি। এটাকে খেলা না বলে বলতে হবে, এরা যে মানুষ, তা আমাদের মনেই নেই। মনে হচ্ছেও না। ৪/৫ লাখ শ্রমিককে বাইরে রেখে আমরা ঢাকাকে লকডাউন করে দিলাম, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কি বলবে সাধারণ মানুষ! এখানে কিসের সমস্যা! প্রধানমন্ত্রী ব্যবসায়ীদের যা দিলেন তা বিশ্বে নজীর নেই। শ্রমিকদের জন্য তেমন কিছু না থাকলেও সিংহভাগ তো মালিকদের জন্যই। তবুও খূশি না? তবে এত গাফিলতি কেন!

ভাবতে অবাক লাগে, ‘ব্যাপক পরিমাণ খাদ্য কিনতে হবে সরকারকে৷ তিন চার কোটি মানুষকে তিন মাস খাওয়াতে হলে ৫০ থেকে ৬০ কোটি টন খাদ্য কিনতে হবে৷ সরকার কখনো এত ব্যাপকভাবে করেনি৷ মজুদ করতে গেলে সরকার পারবে না৷ তাই কিনে তা জনগণের কাছে পৌঁছে দিতে হবে৷’ এই অবস্থায় সরকার রেকর্ড সংখ্যক টাকা দিলেন ব্যবসায়ীদের। তবুও শ্রমিকেরা রাস্তায় কেন?

আমরা যদি ভেবে দেখি, সরকার বড় ও রপ্তানিমুখী শিল্পখাতকে অনেক গুরত্ব দিয়েছে৷ ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলোর জন্যেও ২০ হাজার কোটি টাকার ঋণ সুবিধা ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী৷ ‘সমস্যা হল, ব্যাংকগুলোতে এমনিতেই ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোর ব্যাপারে অনীহা৷ তারা এত প্রতিষ্ঠানকে ম্যানেজ করা ঝামেলার ব্যাপার মনে করে৷’

আমরা চেয়েছিলাম, দেশের শ্রমশক্তির বড় অংশ এই দুই শিল্পের বাইরে অনানুষ্ঠানিক খাতে রয়েছে, যাদের জন্য প্রণোদনায় তেমন কিছু নেই৷ এসব প্রতিষ্ঠানের জন্য আলাদা উদ্যোগ নেয়ার দরকার ছিল। ‘যেসব প্রতিষ্ঠান ভাড়া করা জায়গায় করা, ফ্যাক্টরি, চুল কাটার দোকান, রেস্টুরেন্ট, তারা যদি ভাড়া দিতে না পারে, তাদের যদি উঠিয়ে দেয়া হয়, তাহলে তারা আর ফিরতে পারবে না৷ তাদের যেন উচ্ছেদ না করা হয়, সে ব্যবস্থা করতে হবে৷ বাড়িওয়ালারা যদি অন্তত ৫০ ভাগ ভাড়া কমিয়ে দিতে পারতো, তাহলে কাজ হতো৷’

ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে ৭০ থেকে ৮০ লাখ লোকের জীবিকা জড়িত। এসব খাতকে যদি সুরক্ষা না দেয়া হয়, তাহলে তাদের ৭০ থেকে ৮০ ভাগ আর ব্যবসায় ফেরত আসতে পারবে না।

বর্তমানে বিশ্ব মহামারিতে আক্রান্ত। বাংলাদেশও কাঁপছে। আগামী দুই সপ্তাহ আমাদের জন্য লাল সংকেত। এই পর্যন্ত বিশ্বে করোনাভাইরাসের সর্বশেষ পরিসংখ্যান জানার অন্যতম ওয়েবসাইট ওয়ার্ল্ডোমিটারের তথ্য অনুযায়ী, ভাইরাসটিতে এ পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন বিশ্বের ১২ লাখ ৭৩ হাজার ৫০৫ জন। এদের মধ্যে বর্তমানে ৯ লাখ ৪১ হাজার ৭০৩ জন চিকিৎসাধীন এবং তাদের মধ্যে ৪৫ হাজার ৫৯২ জনের অবস্থা (৫ শতাংশ) আশঙ্কাজনক। এ পর্যন্ত করোনাভাইরাস আক্রান্তদের মধ্যে ২ লাখ ৬২ হাজার ৩৫১ জন (৭৯ শতাংশ) সুস্থ হয়ে উঠেছেন এবং ৬৯ হাজার ৪৫১ জন (২১ শতাংশ) রোগী মারা গেছেন। গত বছরের ডিসেম্বরের চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া প্রাণঘাতি করোনাভাইরাস বাংলাদেশসহ বিশ্বের ২০৬টি দেশ ও অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছে। গত ১১ মার্চ করোনাভাইরাস সংকটকে মহামারি ঘোষণা করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)।

বাংলাদেশে গত রবিবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ জনে। এছাড়া দেশে নতুন করে আরও ১৮ জনসহ করোনা আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হওয়ায় মোট রোগী বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮ জনে। আমরা আশংকা করছি, আগামী দুই সপ্তাহ আমাদের জন্য বিপদ সংকেত। তাই আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছি যে কোন পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে।

পরিশেষে বলতে চাই, সরকার টাকা দিয়েছে। আপনারা শ্রমিকদের টাকা দিয়ে দেন। তারপর লকডাউন পুরোপুরি সফল হবে। লাখ লাখ ক্ষুদার্থ মানুষকে বাইরে লক করে রেখে লকডাউন করলে এরা কোথায় যাবে! সব ভেবে সিদ্ধান্ত নিন। দেরী হয়ে গেছে। তবুও বাঁচার জন্য সিদ্ধান্ত নিতে হবে এখনি।

মনে রাখতে হবেন, নিয়তি কাকে কখন কি করে দেয়, তা একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন। বাদশা থেকে ফকির আর ফকির থেকে বাদশার নজির তো আমরাই! তাই মানুষকে মানুষ ভেবে আসুন সবাই বাঁচার জন্য চেষ্টা করি। আমিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *