ঢাকা: সরকারি ঘোষণাকে ‘থোড়াই কেয়ার’ করছেন দেশের তৈরী পোশাক শিল্পের সাথে সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। নানামুখী সমালোচনাকে বিবেচনায় না নিয়ে গতকালও তারা শত শত কারখানা খোলা রেখেছেন। কাজ করিয়েছেন হাজার হাজার শ্রমিককে দিয়ে। খোদ ঢাকা প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকায় (ইপিজেড) গতকাল খোলা ছিল ৪৬টি কারখানা। চাকরি রক্ষার তাগিদে শ্রমিকরাও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন। কারখানায় প্রবেশ করার এবং বের হওয়ার সময় ঝুঁকিপূর্ণ ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়েই চলেছেন তারা। এ নিয়ে ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের ওপর নেমে আসছে চাকরি হারানো খড়গ। আগামী দিনগুলোতেও এসব কারখানা খোলা থাকবে বলে জানা গেছে। এ নিয়ে জনমনে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হলেও তা আমলে নিতে নারাজ কর্তৃপক্ষ। যদিও তাদের দাবি, শ্রমিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেই কাজ করাচ্ছেন তারা।
বিভিন্ন পর্যায়ের পোশাক শ্রমিক, গণমাধ্যমকর্মী এবং কারখানার মালিকপক্ষের সাথে কথা বলে জানা যায়, রফতানির আদেশ চলমান আছে এমন বেশির ভাগ গার্মেন্ট কারখানাই খোলা রয়েছে। আবার অনেক কারখানা খোলা রাখা হয়েছে পিপিই বা মাস্ক তৈরি করার অযুহাতে। বিশেষ করে আশুলিয়া, সাভার এবং টঙ্গী এলাকার কারখানাগুলো খোলা রয়েছে অধিক সংখ্যায়। এসব কারখানার শ্রমিকরা বরাবরের মতোই সকাল ৮টার আগে ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে কারখানায় প্রবেশ করছেন এবং ছুটির পর আবরো ফিঙ্গার প্রিন্ট দিয়ে বাসায় ফিরছেন। কারখানা থেকে সরবরাহ করা মাস্ক ব্যবহার করলেও সামাজিক দূরত্ব রক্ষার বিষয়টি থেকে যাচ্ছে বিচেনার পুরোপুরি বাইরে। চরম ঝুঁকিপূর্ণ জেনেও এসব শ্রমিক নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে বিভিন্ন লোকের সাথে মিশছেন, আবার কারখানায় এসে পরস্পরের সাথে মিশছেন।
বাংলাদেশ গার্মেন্ট অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি রফিকুল ইসলাম সুজন গতকাল মুঠোফোনে নয়া দিগন্তকে বলেন, সাভার ও আশুলিয়া এলাকার অন্তত ৩০ শতাংশ কারখানা চালু রয়েছে। এগুলোর বেশির ভাগই আগে থেকেই চালু ছিল। কয়েকটি নতুন করে চালু হয়েছে। তার দাবি, শ্রমিকদের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে হামিম গ্রুপ, শারমিন গ্রুপ, হালিম গ্রুপ, আলভী অ্যাপারেলস, গ্লোবার অ্যাপারেলসসহ অনেক বড় বড় কোম্পানি তাদের কারখানা খোলা রেখেছে। সরকারের ঘোষণাকে তারা থোড়াই কেয়ার করছেন দাবি করে সুজন বলেন, গার্মেন্ট মালিকরা কোনো আইনই মানেন না। শ্রমিকদের তারা মানুষই মনে করেন না। বিজিএমইএ একটা দায়সারা অনুরোধ করেই ক্ষ্যান্ত রয়েছে। বিশেষ করে ফিঙ্গার প্রিন্ট দেয়ার মাধ্যমে করোনাভাইরাস ছড়ানোর আশঙ্কা অত্যাধিক বলে জানান তিনি। তিনি জানান, হামিম গ্রুপ গতকাল দুপুরের দিকে নোটিশ দিয়ে জানায়, কারখানা ১১ এপ্রিল পর্যন্ত বন্ধ থাকবে। আবার বিকেলে নোটিশ দিয়ে জানায়, ৬ এপ্রিল থেকে যথারীতি কারখানা খোলা থাকবে। কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের সাথে এভাবে অমানুষিক আচরণ করছে বলে জানান সুজন।
আমাদের আশুলিয়া প্রতিনিধি জানান, তার বাসার পাশে অবস্থিত জিএমএক্স অ্যাপারেলসসহ বেশকিছু কারখানা শুরু থেকেই খোলা আছে। সিনসিন অ্যাপারেলস, জিসান অ্যাপারেলসসহ বেশ কিছু কারখানা কয়েক দিন বন্ধ থাকার পর গতকাল থেকে উৎপাদন শুরু করেছে। তবে অনন্ত, জমজম, নাসির, নাসাসহ বেশকিছু কারখানা বন্ধ রয়েছে। ঢাকা ইপিজেডে কর্মরত জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসআই) একটি সূত্র জানায়, ইপিজেডের ভেতরে গতকাল ৪৬টি কারখানা খোলা ছিল। এসব কারখানা আগামী দিনগুলোতেও খোলা থাকবে বলে তাদের কাছে তথ্য রয়েছে।
টঙ্গী পশ্চিম থানা এলাকায় ট্রাউজার ল্যান্ড ও বিজ ফ্যাশন এবং পূর্ব থানা এলাকায় দাদা গার্মেন্টস ও প্যান্টাগন গার্মেন্টস গতকাল খোলা ছিল বলে জানান নয়া দিগন্তের টঙ্গী সংবাদদাতা আজিজুল হক। এ ছাড়া মারধর ও ভয়ভীতি দেখিয়ে চাকরি থেকে অব্যাহতি দেয়ার প্রতিবাদে এবং বেতন ভাতার দাবিতে গতকাল টঙ্গীসহ শ্রমিক অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় বিক্ষোভ হয়েছে বলে জানা গেছে। টঙ্গীর শালিকচূড়া এলাকায় বিক্ষোভ করেছেন ওরিয়েন্ট এলিউর নিটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকরা। এ সময় তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে নেমে আসেন।
বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা জানান, কারখানা কর্তৃপক্ষ বেশ কয়েকজন শ্রমিককে প্রশাসনিক কর্মকর্তার কক্ষে ডেকে নিয়ে বিনা নোটিশে চাকরি থেকে অব্যাহতি নিতে বলেন। আগের কোনো নোটিশ ছাড়া অব্যাহতি না নিতে চাইলে কর্তৃপক্ষ ভয়ভীতি দেখিয়ে মারধর করে জোরপূর্বক বেশ কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর নেয়। পরে তারা শ্রমিকদের অফিসিয়াল আইডি কার্ড, জাতীয় পরিচয়পত্র ও মোবাইল ফোন কেড়ে নিয়ে বাইরে বের করে দেয়। এ ব্যাপারে শ্রমিকরা টঙ্গী পূর্ব থানায় দু’টি অভিযোগ করেন বলে জানা গেছে।
এ দিকে চাকরি বাঁচাতে মাত্র এক দিন আগে যেসব শ্রমিক দূর-দূরান্ত থেকে বহু কষ্টে কর্মস্থালে পৌঁছেছেন তাদের অনেককে গতকাল একই রকমের বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে বাড়ি ফিরে যেতে দেখা গেছে। পরিবহন সঙ্কটের কারণে অনেকে হেঁটে ঢাকার বাইরে গেছেন। আবার অনেকে ঢাকা বা এর আশপাশে নিজ বাসস্থানে গিয়ে পড়েছেন প্রতিরোধের মুখে। তিন বছর ধরে ভাড়া করে থাকছেন এমন বাসায় যাওয়ার পর করে না আতঙ্কে বাড়িওয়ালা ঢুকতে দিচ্ছেন না। অনেক শ্রমিক মার্চ মাসের বেতন না পাওয়ায় বাড়ি ভাড়া দিতে পারছেন না। টাকার অভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় বাজার খরচটুকুও করতে পারছেন না অনেকে।