ঢাকা: গত ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিত্তবানদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন। এক সপ্তাহে পেরিয়ে গেলেও যতো বড় মাপের দুর্যোগ ততোটা মাপে সাড়ে মিলছে না বলেই প্রতীয়মান হয়। তাই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ বড়লোকেরা কোথায় গেলেন? স্বাভাবিক অবস্থায় বিত্তবানদের প্রতি এরকম উদাত্ত আহ্বান ছাড়াই ‘প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলে’ বিপুল অর্থ জমা পড়ে। কিন্তু ২৫ মার্চের পরে বিক্ষিপ্ত কিছু কিন্তু কেন। গোটা দেশের প্রায় প্রতিটি শহরে উঠতি ধনিক শ্রেণির একটি সরব উপস্থিতি গত এক দশকের রাজনীতির বৈশিষ্ট্য। টেন্ডার থেকে শুরু করে প্রতিটি সরকারি ক্রয়ে একটি বিশেষ দলের সদস্য বা সমর্থকরাই একতরফা প্রাধান্য বিস্তার করেছে। কোনো প্রতিবাদী, কোনো প্রতিপক্ষ, কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী তাদের ছিল না। পদ্মা সেতু বা মেট্রো রেলের মতো যতো মেগা প্রকল্প হয়েছে তার সঙ্গে যুক্ত ছিল হাজার হাজার কোটি টাকা।
কোনো সন্দেহ নেই যে, অতীতের যে কোনো সময়ের তুলনায় বিপুল উন্নয়ন যজ্ঞ দেখেছে বাংলাদেশের মানুষ। প্লেন চার্টার করে রোগের চিকিৎসায় বিদেশে যাওয়ার মতো বড় লোকের তালিকা করলে তা এতটা ছোট হবে না। অথচ যখন দেশে স্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা দেখা দিল, সমগ্র বিশ্ব যখন থমকে দাড়ালো, তখন তারা কেউ বললেন না যে, আমরা প্লেন চার্টার করে পিপিই আনব। মাস্ক আনব। ভেন্টিলেটর বা অন্যান্য সামগ্রী আনব। গত এক দশকে বেসরকারি ব্যাংক, মেডিকেল কলেজের মতো ব্যাঙ্গের ছাতার মতো ল্যাব ও বেসরকারি হাসপাতাল গড়ে উঠেছে। কিন্তু তারা আসলে কি প্রসব করেছে, তার একটা এসিড টেস্ট জাতি প্রত্যক্ষ করছে। হাসপাতালগুলো দু:সময়ে মানুষের জন্য দরোজা না বন্ধ করলেও দরাজ দিলে তা খুলে রাখেনি। অথচ এর বেশিরভাগই বিত্তবানরা গড়ে তুলেছেন। তাদের উল্লেখযোগ্য অংশই সরকারি দলের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ আশীর্বাদে আছেন। ব্যতিক্রম বাদে তারা না দিচ্ছেন অনুদানে অর্থ। তারা না দিচ্ছেন সেবা। এই অবস্থা কমবেশি প্রায় সবখাতের জন্য প্রযোজ্য। বাংলাদেশের উৎপাদনশীল ও অনুৎপাদনশীল সবখাতে হঠাৎ বড়লোকের উল্লম্ফন ঘটেছে। এই সত্য কেনো লুকোছাপার বিষয় নয়। খালি চোখ দেখা যায়। হঠাৎ বড়লোক। কিংবা সময় ও সুযোগকে ‘বৈধভাবে’ কাজে লাগিয়ে যারা বড় লোক হয়েছেন। তাদের একটি তালিকা তৈরি হলে ক্রোড়পতির সংখ্যা কত হবে। আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ কথাটা এখন আর তেমন কেউ ব্যবহার করেন না। কারণ কথাটা যাদের ক্ষেত্রে খাটে তাদের সংখ্য অগনিত। লাখপতিরা এখন আর কোনো পতি নন। কারা লাখপতি , তা কেউ জানতে চান না। এমকি কারা কোটিপতি তাও মানুষ গুনতে ভুলে গেছেন। ব্যাংক থেকে সাড়ে চার হাজার কোটি চলে যাওয়ার পরে দেশের অর্থমন্ত্রীর তাচ্ছিল্য ভরা উক্তি শোনা গেছে। এখন বড় প্রশ্ন যারা বড় ঋণখেলাপি, বেসিক ব্যাংকের সেই অনাদেয় বা লুট হওয়া টাকার মতো ঘটনা যা আছে, সেইসবের কি হবে। দেশে মানি লন্ডারিং আইনের ব্যবহার সামনে আরো কার্যকর হবে, তেমনটা অনেকেই মনে করেন না। কেউ অস্বীকার করবেন না, জিডিপি’র আকারে ঈর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি ঘটেছে। মাথাপিছু আয় ‘আট বছরের ব্যবধানে ৯২৮ ডলার থেকে দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ১৯০৯ ডলারে পৌঁছে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বিএনপি-জামাত আমলের ৩.৫ বিলিয়ন থেকে ৩৩ বিলিয়নে উন্নীত হয়েছে। প্রবাসীদের আয় ৩ গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ১৫ বিলিয়ন হয়েছে। বিদ্যুত উৎপাদন ক্ষমতা ৪৩৮৫ থেকে ২১,৬২৯ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তাতে একটা সমৃদ্ধির চিত্রই পরিষ্কার। এখন করোনার রাশ টানতে মধ্যম আয়ের দেশের মতো হালচাল কোথায়। ব্যাংক খাতে লুটপাট, নৈরাজ্য ও বিশৃংখলা কারও অবিদিত ছিল না। ঋণখেলাপীর দায়ে ব্যাংকগুলো নুব্জ হয়ে চলছিল। তারল্য সংকট ওপেন সিক্রেট। করের টাকা দিয়ে ব্যাংকের ঘাটতি মূলধন পূরণ করার জন্য বরাদ্দ এবারেও রাখা আছে বাজেটে। রাশেদ খান মেনন সংসদেই এই চিত্র তুলে ধরেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বাধীন ভূমিকা দূরে থাক, ব্যাংকগুলোকে কার্যকর নজরদারি করতেও তারা অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে। নিজের অর্থই তারা সামাল দিতে পারেনি এবং তার কোন জবাবদিহিতা দেশবাসী পায়নি। রাজনৈতিক বিবেচনায় ব্যাংক প্রদান, ব্যাংক মালিকদের আবদারে ব্যাংক আইন সংশোধন করে ব্যাংকগুলোকে পারিবারিক মালিকানার হাতে তুলে দেয়া, একই ব্যক্তি একাধিক ব্যাংকের মালিক বনে ব্যাংক খাতকে নিয়ন্ত্রণ করা, ব্যাংক মালিক এসোসিয়েশন কর্তৃক সিআরআর নির্ধারণ করা এসবই ব্যাংক খাতে এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। প্রশ্ন হলো, এই ব্যাংক মালিকরা জানেন তাদের টিকে থাকতে হলে বর্তমান ব্যবস্থাটা টিকিয়ে রাখতে হবে। তাই মানবতার সেবায় না হলেও নিজেদের সম্পদ টেকানোর সেবায় তাদের নেমে পড়া উচিত। কিন্তু কোটি টাকা দামের প্রশ্ন হল, এই গোষ্ঠি রাতারাতি যেন নিভে গেছেন। পিসি সরকারের জাদুর মতো আলো ঝলমলে মঞ্চ থেকে কর্পুরের মতো উবে গেছেন। অথচ করোনা তহিবলে শুধু পাশের বাড়িতেই নয়, বিশ্বের দেশে দেশে বিত্তবান বা বড়লোকেরা অনুদান দিয়েছেন। বাংলাদেশের ক্রিকেটসহ কিছু অঙ্গনের কয়েকজন মাত্র এগিয়ে এসেছেন। হঠাৎ বড়লোকদের কোনো তৎপরতা নেই। করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের পাশাপাশি বিত্তবানদের আরও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছিলেন শিল্প প্রতিমন্ত্রী কামাল আহমেদ মজুমদার। তিনি বলেছিলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে করোনার চিকিৎসা সুবিধা সম্প্রসারিত করা হচ্ছে, পাশাপাশি সারাদেশের দিনমজুর ও নিম্নআয়ের মানুষদের জন্য মানবিক সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। কিন্তু সর্বত্র সরকারি পদক্ষেপ সীমিতভাবে চোখে পড়লেও দলীয় বৃহৎ সমর্থক যাদের ছবি বড় ফেস্টুনে চোখে পড়ত, তাদের ফেস্টুন নেই। তারা ছবি ছাপিয়ে ছাপিয়ে বলছে না, কে কত ত্রাণ দিচ্ছেন। অথচ এটা সকল অর্থে একটি জাতীয় ইমার্জেন্সি।
শুক্রবার করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যুর আশঙ্কা অতিরঞ্জিত বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন। অথচ এরকম একটি সমীক্ষা বহুদিন ধরেই সামাজিক মিডিয়ায় চলছিল। এমনকি দায়িত্বশীল সূত্র বলেছে, একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক এই সমীক্ষার সঙ্গে যুক্ত থাকার জন্য তাকে বিব্রত থাকতে হয়েছে। এটা একটা গাণিতিক মডেল। গোটা বিশ্বের এপিওডেমোলজিস্টরা একবাক্যে একে গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। কথাটা খুব সহজ। যথাযথ পদক্ষেপ না নিলে ২০ লাখ বা বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণহানি ঘটতে পারে। ওই একই সমীক্ষার ফল ভারতসহ বিভিন্ন দেশে মিডিয়া প্রকাশ করেছে। পাবলিক ডিবেট হয়েছে। কারণ এটা কার্যত সরকারের জন্য সহায়ক একটি বিষয়। কারণ যথা পদক্ষেপ নেওয়ার দায়টা নিশ্চয় শুধু সরকারের হতে পারে না। কিন্তু তথ্য প্রচার হতে না দেওয়ার মনোভাব কোনো কাজে দেয় না। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেন বলেছিলেন, খাদ্যের ঘাটতির জন্য নয়, তথ্যের অভাবে খাদ্য যথাস্থানে না পৌঁছানোতেও দুর্ভিক্ষ ঘটতে পারে। করোনার মতো মহামারি ঠেকাতে তথ্যের অবাধ প্রবাহ আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তা দুর্ভিক্ষের চেয়ে স্পর্শকাতর। শনিবার মীরজাদি সেব্রিনা দুজনের মুত্যুর খবর দিলেন। বললেন, এদের একজন গত ২৪ ঘন্টায় আক্রান্ত হয়েছিল। মানুষ না খেয়, কচুঘেচু খেয়ে লম্বা সময় টিকতে পারে। কিন্তু করেনা কোনো চান্স দেবে না। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে করোনা ভাইরাসে বাংলাদেশে প্রায় ২০ লাখ লোকের মৃত্যু হতে পারে, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. মোমেন বলেন, একজন হাইপোথিসিস করে এমন কথা বলেছেন। এটা খুবই দুঃখজনক। ‘করোনা ভাইরাসে না-কি বাংলাদেশে ২০ থেকে ৫০ লাখ মানুষের মৃত্যু হতে পারে। ইম্পেরিয়াল কলেজ থেকে এমন একটি ধারণা করা হয়েছে। আমি বলব এটা অতিরঞ্জিত।’ অনেকেই তার সঙ্গে একমত হবেন। কিন্তু এই মত প্রকাশ পাওয়ার ফল নেতিবাচক হতে পারে না। সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট এর আগে পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর বরাতে জাতিসংঘের ফাস হওয়া মেমোর ওপর প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এর সবটাই আসলে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ধরে নিয়ে আগাম বড় প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশক। কেউ আশা করে না জাতির জীবনে বিপর্যয় নামুক। কারণ এই প্রথম দলমত নিবিশেষে মনে করছেন, কে বাঁচে কে মরে তা কারো জানা নেই। ১৯১৮ সালের ফ্লুতে উন্নত বিশ্বেরই কয়েক কোটি মানুষ মারা গিয়েছিল। তখন হয়তো ইমপেরিয়াল কলেজ এভাবে সতর্ক করেনি। জাতিসংঘটই ছিল না, কারা আর রিপোর্ট করবে। সতর্ক করবে। বারংবার প্রশ্ন উঠছে, সরকার কতোটা প্রস্তুত। কিন্তু এটাতোও প্রশ্ন, সমাজ কতোটা সাড়া দিচ্ছে। এর আগে ঋণখেলাপি সংক্রান্ত একটি প্রজ্ঞাপণের এক মাসের মধ্যে ঋণখেলাপের পরিমাণ ১৭ হাজার কোটি টাকা বেড়ে ১ লাখ কোটি টাকার উপর ছাড়িয়ে গিয়েছিল। এই তারা করোনোর সময়ে কি করছেন, সেটা খতিয়ে দেখা দরকার। অনেকে বরং ভয় করছেন, সকল ঋণ খেলাপিরা করোনার দোহাই দিয়ে বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কি করবেন। বাণিজ্যের আড়ালে বছরে যারা ১ লাখ কোটি টাকা পাচার করছিলেন তারা কে কোথায়। তারাও কি সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকবেন? সরকারের আহ্বানে তারা পাশে দাড়াবেন না? ১০ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে দেশ থেকে। এই লোকেরা কোথায়। ২০০৬ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যেই ৫ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছিল।