২৬ মার্চ, একটি মৃত্যু ও কিছু প্রশ্ন

Slider জাতীয় টপ নিউজ বাধ ভাঙ্গা মত


রুমিন ফারহানা: ২৬ মার্চ, ২০২০। একটা ছবি ভাইরাল হলো ফেসবুকে। থানা হাজতে ওসি’র রুমে ফ্যানের সাথে রশি দিয়ে ঝুলছে এক ব্যক্তির লাশ। তার নাম শানু হাওলাদার। তাকে গত ২৩ মার্চ রাত সাড়ে ১১টার দিকে সন্দেহভাজন হিসাবে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আমতলী থানা পুলিশ ধরে নিয়ে আসে। পরদিন তার ছেলে থানায় এসে তাকে খাবার দিয়ে যান। তার এক দিন পর পরিবারের লোকজন তার সাথে থানায় দেখা করতে চাইলে পুলিশ দেখা করতে দেয়নি, উল্টো খারাপ ব্যবহার করে তাদের তাড়িয়ে দেয়া হয় বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা। এর পরদিন সকালে থানা থেকে খবর দেওয়া হয় শানু হাওলাদার পরিদর্শকের (তদন্ত) কক্ষে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

তবে পরিবারের অভিযোগ তাকে ধরে নিয়ে আসার পরে আমতলী থানা ওসি আবুল বাশার ও পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জন মিস্ত্রি তার পরিবারের কাছে তিন লাখ টাকা দাবি করে। শানুর ছেলে ১০ হাজার টাকা ওসিকে দেন। বাবার সাথে দেখা করতে চাইলে গালাগাল করে তাড়িয়ে দেয়া হয় তাদের। বলা হয় কেবল মাত্র দাবীকৃত টাকা নিয়ে আসলেই দেখা করতে দেয়া হবে। কিন্ত দাবি করা বাকি টাকা দিতে না পারায় শানুকে থানা হাজতে রেখে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন স্বজনরা।

অথচ যে মামলায় পুলিশ শানুকে গ্রেফতার করেছে সেই মামলার এজাহারে আসামী হিসাবে নামই নেই শানুর। ওসি’র ভাষ্যমতে হাজত খানার ফ্যানের সাথে গলায় রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে শানু। কিন্তু হাজত খানায় কোন ফ্যানই নেই। এই বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে পূর্বের কথা পালটে তিনি বলেন “পরিদর্শক (তদন্ত) মনোরঞ্জনের কক্ষের ফ্যানের সাথে রশি পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছে।” টাকা না দেয়ায় তাকে নির্যাতন করে হত্যার অভিযোগ প্রসঙ্গে তিনি জবাব এড়িয়ে যান। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা যদিও শানুর শরীরে আঘাতের কথা স্বীকার করেন কিন্তু বলেন যে ময়না তদন্ত ছাড়া মৃত্যুর সঠিক কারণ বলা যাবে না। এই জঘন্য কাণ্ডের শাস্তি স্বরূপ “দায়িত্বে অবহেলার জন্য” পরিদর্শক (তদন্ত) ও একজন ডিউটি অফিসার এএসআই’কে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। আর ওসি সাহেবকে প্রত্যাহার করে বরগুনা পুলিশ লাইন্সে সংযুক্ত করা হয়েছে। ৩ সদস্যের একটি তদন্ত টিমও গঠন করা হয়েছে।
ঘটনাটি ঘটেছে ২৬ মার্চ, আমাদের স্বাধীনতা দিবসে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে সাম্য, মানবিক মর্যাদা আর সামাজিক ন্যায় বিচারের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার যে স্বপ্ন দেখেছিল ৭ কোটি বাঙালি তা কি আজকের বাংলাদেশ? এই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য এত রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম? আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে।

বাংলাদেশে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা হেফাজতে নির্যাতন আর বন্দীর মৃত্যুর ঘটনা অতীতেও হয়েছে। কিন্তু গত ১১ বছরে তা অতিক্রম করেছে অতীতের সকল রেকর্ড। জানুয়ারী ২০০৯ থেকে অক্টোবর ২০১৭ এই ৮ বছরে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ এর রিপোর্ট বলছে ৬৫৩ জন মানুষ আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যু বরণ করেন। ১৯৮৪ সালের ১০ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারন পরিষদ নির্যাতন এবং অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার অথবা দণ্ডবিরোধী একটি সনদ গ্রহন করে এবং ১৯৯৮ সালের ৫ অক্টোবর স্বাক্ষরিত দলিলের মাধ্যমে উক্ত সনদে বাংলাদেশও অংশীদার হয়। যদিও ১৯৯৮ সালেই বাংলাদেশ এই সনদের অংশীদার হয় কিন্তু এ সংক্রান্ত প্রাথমিক রিপোর্ট পেশ করে এর ২০ বছর পর ২৩ জুলাই ২০১৯। রিপোর্ট পেশ করার পর কমিটি এগেইনস্ট টর্চার (CAT)তাদের অভজারভেশনে বলে বাংলাদেশ হেফাজতে নির্যাতন কিংবা মৃত্যুর বিষয়ে যথাযথ ও সুষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে। অধিকাংশ সময় পুলিশ ভিক্টিম পরিবারের অভিযোগ পর্যন্ত নিতে অস্বীকৃতি জানায়। এমনকি অভিযোগকারী কিংবা তার পরিবার সদস্যরা বহু সময়ই পুলিশের হুমকি, হয়রানি কিংবা প্রতিশোধের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এই ধরনের নিপিড়নমূলক, নিষ্ঠুর আর অমানবিক আচরণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করে গেছে যদিও তাতে সরকারের টনক নড়েনি এক বিন্দু।
এছাড়াও আমাদের সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ নির্যাতন এবং নিষ্ঠুর, অমানবিক, লাঞ্ছনাকর ব্যবহার ও দণ্ড মৌলিক ভাবেই নিষিদ্ধ করেছে। এ সকল কিছু বিবেচনায় বাংলাদেশ সরকার নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃত্যু (নিবারণ) আইন পাশ করে ২০১৩ সালে। মূলত নির্যাতন ও অন্যান্য নিষ্ঠুর, অমানবিক অথবা অমর্যাদাকর আচরণ অথবা শাস্তির বিরুদ্ধে জাতিসংঘ সনদের কার্যকারিতার জন্য এ আইন হয়। এতে বিধি প্রনয়নের ক্ষমতা সহ ২০টি ধারা আছে। যাতে মূলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে বলা হয়েছে। এমনকি ভয় ভীতি দেখানোও এই আইনের অধীনে নির্যাতন বলে গণ্য হয়েছে। অপরাধের মাত্রা বিবেচনায় ৫ বছরের কারাদণ্ড থেকে শুরু করে যাবজ্জীবন পর্যন্ত রাখা হয়েছে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় যদিও পুলিশ, র‍্যাব, বিজিবি, কাস্টমস, ইমিগ্রেশন, সি আই ডি, বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, আনসার ভিডিপি ও কোষ্টগার্ড সহ দেশে আইন প্রয়োগ ও বলবৎকারী সকল সরকারি সংস্থাকেই ধরা হয়েছে কিন্তু মজার বিষয় হল ২০১৩ সালে আইন প্রণয়নের পর ২০১৫ সালে কেবলমাত্র পুলিশের পক্ষ থেকেই আইনের ১৪টি ধারা ও উপধারা সংশোধন চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। প্রস্তাবে আইনটির ৭টি ধারা বিলুপ্ত করার কথা বলা হয়। পরবর্তীতে আবার ২০১৭ সালের পুলিশ সপ্তাহের উদ্বোধনের পর আইনটি বাতিলের দাবি তোলা হয়েছিল। তাদের সে দাবি নাকচের পর আইনটি সংশোধনের দাবি জোরালো হয়। অর্থাৎ শুরু থেকেই পুলিশ এই আইনের বিরোধিতা করে আসছে।

পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযুক্ত নির্যাতনের অভিযোগ বহুবার উত্থাপিত হবার পরও কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ভয়াবহ নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকারোক্তি আদায় পুলিশের পুরানো একটি কৌশল। রমনা থানা হেফাজতে বহুকাল আগে হত্যার শিকার হওয়া অরুন হত্যা মামলায়, চট্টগ্রামের থানা হেফাযতে সীমা হত্যা মামলায় কিংবা দিনাজপুরে পুলিশ হেফাজতে ইয়াসমিন হত্যা মামলার রায়ে হেফাজতে নির্যাতন ও হত্যা মামলার বিষয়ে তৎকালিন মাননীয় বিচারপতিগণ আইনি সূত্র ও ভিত্তি তৈরি করে দিয়েছিলেন যা কখনই মানা হয়নি। নির্যাতন বিরোধী আন্তর্জাতিক কনভেনসনে স্বাক্ষর, সংবিধানের ৩৫(৫) অনুচ্ছেদ, হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু নিবারন আইন, ২০১৩, দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায় সব থাকার পরও কমছেনা পুলিশের হেফাজতে এই নির্যাতন ও একটির পর একটি মৃত্যুর ঘটনা। তার কারণ আইন কেবল পাশ করলেই হয়না, আইন প্রয়োগও করতে হয়। দেশে কেবল আইন থাকলেই চলেনা, প্রয়োজন আইনের শাসন। পুলিশ আর প্রশাসন নির্ভর জন বিচ্ছিন্ন জবাবদিহিতাহীন সরকার দ্বারা যা কখনই সম্ভব নয়।

শেষ করছি কিছু প্রশ্ন রেখে।
(১) সংবিধান, আইন, সুপ্রিম কোর্টের রায় থাকার পরও কেন নিয়মিত ভাবে ঘটেছে হেফাজতে নির্যাতন আর মৃত্যুর ঘটনা?
(২) হেফাজতে নির্যাতন আর মৃত্যু নিবারণ আইন পাশ হল ২০১৩ সালে কিন্তু আজ অবধি এই আইনের অধীনে কয়টি মামলা হয়েছে?
(৩) বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়া ছাড়া গত ১১ বছরে আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন সদস্যের বিরুদ্ধে নির্যাতন বা মৃত্যুর জন্য ফৌজদারী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে কি?
(৪) যে আইনের কোন প্রয়োগ নেই সে আইন থাকা কিংবা না থাকায় কি আসে যায়?
(৫) শানু হাওলাদারের মত আরও অসংখ্য ঘটনায় (যাকির হোসেন মিলন, ২০১৮, খন্দকার আতরাব হোসেন শিপন, ২০১৩, মোহাম্মাদ শামিম সরকার, মোহাম্মাদ সাইফুল ইসলাম খান, ২০১৩, যাকির সাদিক, ২০১৩, মোহাম্মাদ মহসিন, ২০১৪, মোহাম্মাদ জনি, ২০১৪, আবু সালেম মোহাম্মাদ নোমান, ২০১৬, সোহেল রানা, ২০১৬, মৌলানা সাইদুর রাহমান, ২০১৭, রাসেল, ২০১৭) আজ অবধি কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
(৬) গত ১১ বছর কত জন মানুষ হেফাজতে নির্যাতন আর মৃত্যুর শিকার হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান কি সরকারের কাছে আছে?

সব শেষে যাবার আগে একটা নাম মনে করিয়ে দিয়ে যাই। পক্ষকাল ম্যাগাজিনের সম্পাদক শফিকুল ইসলাম কাজল পাপিয়া কাণ্ড নিয়ে সংবাদ প্রকাশের জের ধরে আজ প্রায় ২০ দিন যাবত নিখোঁজ। হেফাজতে নির্যাতন আর মৃত্যুর মতই এই ধরনের নিখোঁজ খবরেও আমাদের অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গেছে। এই অভ্যস্ততা বড় ভয়ঙ্কর, এই অভ্যস্ততা রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙ্গে পড়ার আওয়াজ শোনায়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *