ঢাকা: ২৫ মাস পর মুক্তি পাচ্ছেন সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আজ দুপুরে তিনি মুক্তি পেয়ে সোজা ফিরবেন নিজ বাসভবনে ফিরাজোয়। গুলশানের এই বাসভবনেই তিনি থাকবেন। তাকে চিকিৎসা করার জন্য ইতোমধ্যেই একটি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিম বেগম জিয়ার চিকিৎসা করবেন। এই তথ্য জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
দুই বছর এক মাস ১৬ দিন কারাভোগের পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া আজ মুক্তি পাচ্ছেন। এই খবর চাউর হওয়ার পর বিএনপির নীতি-নির্ধারকরা যেন জোরে নিঃশ্বাস নিয়েছেন। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, মুক্তি যেভাবেই হোক, যত দিনের জন্যই হোক এটি নিশ্চিতভাবেই নেতাকর্মীদের জন্য আনন্দের খবর। উদ্বেগে দিন কাটানো বেগম খালেদা জিয়ার পরিবারের সদস্যরাও এতে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। তারা এ জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।
এর আগে গতকাল মঙ্গলবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এক সংবাদ সম্মেলনে সরকার শর্ত সাপেক্ষে বেগম খালেদা জিয়াকে মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ছয় মাসের জন্য বেগম খালেদা জিয়ার সাজা স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলায় ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে খালেদা জিয়ার কারাভোগ শুরু হয়। প্রথম ১১ মাস তিনি ছিলেন পুরনো ঢাকার পরিত্যক্ত কেন্দ্রীয় কারাগারে একমাত্র বন্দী হিসেবে। সাবেক তিনবারের প্রধানমন্ত্রী নির্জন এই কারাগারে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে উচ্চ আদালতের নির্দেশে গত বছরের ১ এপ্রিল চিকিৎসার জন্য তাকে নিয়ে আসা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের কেবিন ব্লকে।
এই দীর্ঘ সময়ে খালেদা জিয়ার মুক্তি দাবিতে আইনি ও রাজনৈতিক কর্মসূচি দিয়েও কোনো সুবিধা করতে পারেনি বিএনপি। দলীয় চেয়ারপারসনের দুই বছরেও মুক্তি না হওয়ায় কর্মী-সমর্থকরাও ছিলেন ক্ষুব্ধ ও শঙ্কিত। নেতারাও কোনো হিসাব মেলাতে পারছিলেন না খালেদা জিয়ার মুক্তির প্রশ্নে।
দুই মাস আগে খালেদা জিয়ার মুক্তির বিষয়ে সর্বশেষ জামিন আবেদন সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের ফুল বেঞ্চ শুনানি করে খারিজ করে দিলে আইনি পথে তার মুক্তির পথ বন্ধ হয়ে যায়। এরপরই গত ২৪ জানুয়ারি বিএসএমএমইউতে খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তার সেজ বোন সেলিমা ইসলাম সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তার বোনের মুক্তির বিষয়ে নতুন করে আবেদন করা হবে। পরে অসুস্থতার কথা উল্লেখ করে সেই আবেদন করা হয়।
পরিবারের সদস্যরা জানান, হাত-পায়ে রিউমেটিক আর্থারাইটিস, ডায়াবেটিসসহ নানা জটিল রোগে আক্রান্ত খালেদা জিয়া। এখন কারো সহযোগিতা ছাড়া তিনি হাটতে পারেন না, খেতেও পারেন না। এরকম অবস্থায় তার মুক্তির খবর নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক।
বেগম খালেদা জিয়ার বোন সেলিমা ইসলাম এ জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। আর দলের নেতাকর্মীদের শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। গতকাল সন্ধ্যায় গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের সামনে সাংবাদিকদের সামনে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় এ আহ্বান জানান তিনি।
ফখরুল বলেন, এখন করোনা ভাইরাস আক্রমণের এই সময়ে দলের নেতাকর্মীরা শান্ত থাকবেন। কেউ যেন আক্রান্ত না হন খেয়াল রাখবেন। এই মুহূর্তে সবাই স্বাস্থ্যের প্রতি যতœবান হবেন। খালেদা জিয়াকে ছয় মাসের শর্তসাপেক্ষে মুক্তির সরকারি সিদ্ধান্তের বিষয়ে ফখরুল বলেন, দেশনেত্রীর মুক্তি নিয়ে সারাদেশের মানুষ উদ্বিগ্ন ছিল। তারা কিছুটা স্বস্তি পাবেন, অন্তত ছয় মাসের জন্য হলেও তিনি মুক্ত থাকবেন। তবে ব্যক্তিগতভাবে তিনি চিন্তিত এই জন্য যে, দেশের বাইরে যেতে না পারলে তার চিকিৎসার কী হবে। সে সুযোগ নেই দেখলাম।’ তবে বিএনপির মহাসচিব জানান, তারা নেতা এবং আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।
খালেদা জিয়াকে শর্তসাপেক্ষে আইন মন্ত্রণালয়ের সুপারিশক্রমে নির্বাহী আদেশে ছয় মাসের জন্য মুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখন আইনি প্রক্রিয়াগুলো শেষ হলেই মুক্তি পাবেন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যে খালেদা জিয়ার মুক্তির সুপারিশের ফাইলটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পৌঁছেছে। আইনি প্রক্রিয়াগুলো আজ বুধবার দুপুরের মধ্যে শেষ হতে পারে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের সচিব মো: শহীদুজ্জামান। খালেদা জিয়া তার ৩৮ বছরের রাজনৈতিক জীবনে মামলার সাজা নিয়ে এবারের টানা কারাবাস প্রথম হলেও আরো একবার প্রায় একবছর তিনি কারাবন্দী ছিলেন। ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে সংসদ ভবন এলাকায় বিশেষ কারাগারে বন্দী ছিলেন তিনি। এ ছাড়া আশির দশকে স্বৈরাচারী এরশাদের শাসনামলে ১৯৮৩, ১৯৮৪ ও ১৯৮৭ সালে খালেদা জিয়াকে ঢাকা সেনানিবাসের শহীদ মইনুল সড়কের বাসায় গৃহবন্দী করে রাখা হয়েছিল। ১৯৮৭ সালে পূর্বাণী হোটেলে দলীয় নেতাদের সাথে বৈঠক থেকে প্রথম খালেদা জিয়াকে পুলিশ ঘেরাও করে আটক করে।
যে প্রক্রিয়ায় মুক্তি পাবেন : এ দিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আদেশের অনুলিপি কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে পৌঁছানোর পরই বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি মিলবে। এমন তথ্য জানিয়েছেন বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন।
খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমি আগেই বলেছিলাম সরকার চাইলে খালেদা জিয়াকে ফৌজদারি আইন অনুসারে মুক্তি দিতে পারে। বহু দিন পরে হলেও সরকার সে প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তাকে মুক্তি দিচ্ছে। সাজা স্থগিত থাকা অবস্থায় খালেদা জিয়া পূর্ণ পুলিশি নিরাপত্তায় থাকবেন কি না জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ এ আইনজীবী জানান, সাজা স্থগিত থাকা অবস্থায় পুলিশি নিরাপত্তার কোনো বিধান আইনে নেই। তবে নিরাপত্তাজনিত কারণে তার জন্য পুলিশি নিরাপত্তা রাখা হবে।
খালেদা জিয়া দেশের বাইরে যেতে পারবেন না : এ দিকে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, খালেদা জিয়া ঢাকায় নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করবেন। দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে দিন তার আবেদন গ্রহণ করবে, সে দিন তিনি মুক্তি পাবেন।
আনিসুল হক বলেন, তার সাজা ছয় মাসের জন্য স্থগিত রেখে তাকে ঢাকার নিজ বাসায় থেকে চিকিৎসা গ্রহণ করার শর্তে এবং ওই সময়ে তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না এই শর্তে মুক্তি দেয়ার জন্য আমি মতামত দিয়েছি। তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে নির্দেশ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ হচ্ছে আইনি প্রক্রিয়ায় এই দুই শর্তে তার দণ্ডাদেশ স্থগিত রেখে তাকে মুক্তি দেয়া হোক।
তার মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না এ বিষয়ে তিনি বলেন, আগে ছয় মাস যাক, তারপর দেখা যাবে। তিনি বলেন, এখানে কিন্তু বলা হচ্ছে না তিনি হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারবেন না। সেটা তার অবস্থার ওপর নির্ভর করবে। তবে শর্ত হচ্ছে, তিনি দেশের বাইরে যেতে পারবেন না। সরকার মানবিক কারণে সদয় হয়ে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪০১ ধারা (উপধারা-১) অনুযায়ী এটা আইনি প্রক্রিয়ায় করা হয়েছে।