গ্রাম বাংলা ডেস্ক: ফের বাংলাদেশে ‘দুই বেগম’-এর লড়াই শুরু হয়েছে। এর মূল্য দিতে হচ্ছে দেশকে। দেশে রাজনীতির গতিপথ দেখে মনে হচ্ছে এ বছরটি এমনই চলবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি আগামী নির্বাচনের আগে বিএনপিকে ধ্বংস করে দিতে চান। বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া হয়েছে। এতে দেশের নিরপেক্ষ ভোটারদের সহানুভূতি বাড়ছে তার প্রতি। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী ম্যাগাজিন দ্য ইকোনমিস্টে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। ‘ড্রামা কুইনস’ শিরোনামে ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়- বাংলাদেশে এ অবস্থার দৃশ্যত কোন সমাধান নেই।
৫ই জানুয়ারি ফের ঢাকার রাজপথে দেখা মিলেছে বালুভর্তি বর্ণিল ট্রাক। এদিনটি ছিল মারাত্মক ত্রুটিপূর্ণ সাধারণ নির্বাচনের প্রথম বর্ষপূর্তি। ওই নির্বাচনে বিজয়ী হয় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় এতটা সুবিধা পায় তারা। এক বছর আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়াকে ঢাকায় তার বাসভবনে ট্রাক দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছিল। এবারও তাকে পুলিশি সহায়তায় ট্রাক দিয়ে তাকে তার অফিসে বেশ কয়েকদিন অবরুদ্ধ করে রাখে। বলা হচ্ছে, এটা করা হচ্ছে তার নিরাপত্তার জন্য। এছাড়া দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
বিএনপির অন্য নেতাদের বেশির ভাগই আত্মগোপনে রয়েছেন। দলটির দলীয় প্রধান কার্যালয় তালাবদ্ধ করতে পুলিশকে নির্দেশ দিয়েছে সরকার। পর্নোগ্রাফির অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে একটি টেলিভিশন চ্যানেলের মালিককে। এটা করা হয়েছে লন্ডনে স্বেচ্ছায় নির্বাসনে থাকা খালেদা জিয়ার ছেলে ও দলীয় সিনিয়র মহাসচিব তারেক রহমানের একটি বক্তব্য প্রকাশের পর। ওই বক্তব্যে তারেক সরকার পতনের আহ্বান জানিয়েছিলেন। ডেইলি স্টার পত্রিকার সম্পাদক মাহফুজ আনাম। তিনি বিএনপি বা বেগম খালেদা জিয়ার ভক্ত নন। বিরোধীদের ওপর নির্মম দমননীতির নিন্দা জানিয়েছেন তিনি। মাহফুজ আনাম বলেন, আমরা এ দেশটিকে গণতান্ত্রিক বলে দাবি করে। এমন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সেই দাবির সঙ্গে উপহাস করা হচ্ছে।
দীর্ঘদিন নিজের দলের লোকজনকে উজ্জীবিত করতে ও দেশের অন্য অংশগুলোতে তাদের অস্তিত্ব জানান দিতে দুর্বল বিএনপি অপেক্ষা করছিল। তারা ‘গণতন্ত্র হত্যা দিবস’ পালনের পরিকল্পনা নিয়েছিল নির্বাচনের বর্ষপূর্তিতে। আওয়ামী লীগ ও এর নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ছিল অন্য পরিকল্পনা। তারা আগেভাগেই দূরপাল্লার বাস চলাচল বন্ধ করেছিল। সমাবেশ নিষিদ্ধ করেছিল। একই সঙ্গে তারা ওই দিনটিকে ‘সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা দিবস’ পালন করে, যদিও ওই নির্বাচন ছিল প্রহসনমূলক। এটা শুধু বিএনপি বর্জন করেছিল বলেই নয়। নির্বাচনের দিনে সাবেক স্বৈরশাসক ও তৃতীয় বৃহত্তম দলের নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ আটক ছিলেন একটি সেনা হাসপাতালে। চতুর্থ বৃহত্তম দলটিকে তাদের ইসলামী গঠনতন্ত্রের জন্য নির্বাচনে অংশ নিতে দেয়া হয় নি।
সব সময়ের মতো, সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে গ্রামে বসবাসকারী মানুষকে দেশটির অভিনয় ভাবাপন্ন পরস্পরবিরোধী রাজনীতিকদের নতুন নতুন দ্বন্দ্বের মূল্য দিতে হচ্ছে। নাটোরে বিএনপির দুই কর্মীকে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা গুলি করে হত্যার পর বিএনপি অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আহ্বান করে। এখন পর্যন্ত এবার সারা দেশে নিহত হয়েছেন ৭ জন এবং আহত হয়েছেন কয়েক শ’ মানুষ।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। তিনি ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের মাধ্যমে ক্ষমতায় ফেরেন। কিন্তু জনগণের সেই ম্যান্ডেট তিনি ব্যবহার করেছেন বিরোধীদের শিকারে, নিজের সুবিধা হয় এমনভাবে সংবিধান সংশোধন করেছেন এবং গণতন্ত্রকে দুর্বল করেছেন- ঠিক তার আগে ২০০১ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে ক্ষমতায় থাকতে যেমনটা করেছিলেন খালেদা জিয়া। আওয়ামী লীগ অর্থনৈতিক যে দক্ষতার দাবি করে তা অপ্রাসঙ্গিক হতে শুরু করেছে। খালেদা জিয়ার মৌলিক অধিকার কেড়ে নেয়া ও তাকে খেয়াল-খুশি মতো অবমাননার কারণে নিরপেক্ষ ভোটাররা তার দিকেই ঝুঁকছেন। এরশাদের জাতীয় পার্টি তো এখন আওয়ামী লীগের মিত্র। নামমাত্র তারা সরকারিভাবে সংসদে বিরোধী দল। তারা মন্ত্রিপরিষদ থেকে নিজের দলের মন্ত্রীদের সরিয়ে আনার কথা বলেছে। আগামী নির্বাচন হওয়ার কথা ২০১৯ সালে। তার আগে রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে বিএনপিকে ধ্বংস করে দিতে দৃশ্যত প্রধানমন্ত্রী বদ্ধপরিকর। তার সরকার আদালত, নিরাপত্তা বিভাগ ও মিডিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা কোন সমঝোতায় আগ্রহী নয়। তারা আগামী চারটি বছর ক্ষমতায় থাকার বিষয়ে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই সেনাবাহিনী এলে তাতে বিএনপি একমাত্র পরিবর্তনের সুযোগ দেখতে পাচ্ছে। তবে সেটা হতে পারে যদি সেনাবাহিনী জনশৃঙ্খলা রক্ষায় হস্তক্ষেপ করে। তবে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে। তারা জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে লোভনীয় সুযোগ পেয়ে ও ব্যবসা করে বেশ সন্তুষ্ট। গত সপ্তাহে যেসব ঘটনা ঘটে গেল তা সহিংসতার আরেকটি সূচনা। ঢাকায় শোনা যাচ্ছে, খালেদা জিয়াকে সম্ভবত রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগে গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি নিচ্ছে সরকার।
তিনি এরই মধ্যে দুর্নীতির অভিযোগে বিচারের সম্মুখীন। যদি তাতে তিনি অভিযুক্ত হন তাহলে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হতে পারে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিদের পক্ষাবলম্বন করে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিরোধী দলের বেশ কয়েকজন নেতাকে শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। সেই রায় কার্যকর হলে স্থিতিশীলতা আরও হুমকিতে পড়তে পারে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অন্য কোন দেশ প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। তবে অস্বাভাবিকভাবে সংলাপের আহ্বান জানিয়েছে চীন। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের ওপর প্রকাশ্যে চাপ সৃষ্টি করা বন্ধ রেখেছে যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশের তৈরী পোশাকের বড় ক্রেতা জার্মানি। এই মুহূর্তে ঢাকায় তাদের রাষ্ট্রদূতও নেই। ভারতের নতুন সরকার এখনও শেখ হাসিনার ওপর থেকে তাদের সমর্থন হ্রাস করেছে বলে প্রতিভাত হয় নি। তাই তিনি সমঝোতার জন্য কমই চাপে আছেন। এ সপ্তাহে হয়তো পরিস্থিতিতে নতুন করে ছায়া ফেলবে। বালুর ট্রাক ও তালাওয়ালারা হয়তো আরও ব্যস্ত হয়ে উঠবে।