ছোট্ট তাসনিম জয়া। দ্বিতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী। মোহাম্মদপুর প্রিপারেটরী স্কুলের এই শিক্ষার্থীর নিত্যদিনের রুটিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে যাওয়া আসা। কিন্তু আর মায়ের হাত ধরতে চায় না সে। নেট দুনিয়ায় সজাগ জয়া জেনে গেছে হাত মেলানো মানা। স্কুলে যেতেও চায় না সে।
জয়া যেমন স্কুলে যেতে চায় না। ঠিক তেমনি ইচ্ছার বিরুদ্ধে স্কুলে নিয়ে যেতে বাধ্য হন মা রেবেকা জাহান। তিনি বলেন, স্কুল খোলা থাকলে না নিয়ে উপায়টাই বা কী? পিছিয়ে পড়ার ভয়ে নিয়ে যেতে বাধ্য হই।
তিনি বলেন, অনেকেই নিয়ে আসছেন না তাদের সন্তানকে। কিন্তু ভয়ে ভয়ে হলেও নিয়ে আসি আমি।
করোনার ভয়ে কাঁপছে পুরো বিশ্ব। হু হু করে বাড়ছে আক্রান্তের সংখ্যা। থেমে নেই মৃত্যুর মিছিল। অবরুদ্ধ বিশ্বগ্রাম। বিভিন্ন দেশে করোনার প্রভাবে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া ঘর থেকে বাইরে যাওয়া বারণ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ।
কিন্তু বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকায় ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ উৎকণ্ঠা। গতকাল রাজধানীর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা যায় ধীরে ধীরে উদ্বেগ আতঙ্কে রূপ নিচ্ছে। উৎকণ্ঠার মাঝে ক্লাস করছেন শিক্ষার্থীরা। ধীরে ধীরে কমছে শিক্ষার্থীর সংখ্যা। এমন অবস্থায় কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। এ দাবিতে অনশনে বসেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার শিক্ষার্থী। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে রাজধানীর নামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্কলাস্টিকা।
ধানমণ্ডির একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সকলের আতঙ্ক ও আলোচনা করোনা কেন্দ্রিক। একটি ক্লাসের হাজিরা খাতা থেকে দেখা যায়, ১১ই মার্চ ২৩ জন শিক্ষার্থীর মাঝে উপস্থিত ছিলেন ১৮ জন। ১২ই মার্চ ১২ জন। আর গতকাল এসেছেন ৭ জন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ৬ জন শিক্ষার্থী ইতোমধ্যে রাজধানী ছেড়েছেন। আরেকটি বিভাগের ক্লাসে গিয়ে দেখা যায় ক্লাস করছেন মাত্র ১২ জন। সেই বিষয়ে মোট শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৪০। বৃহস্পতিবার উপস্থিত ছিলেন ১৭জন।
ধানমণ্ডির আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, বেশ সতর্ক তারা। শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তা ছাড়া অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে বাধা দেয়া হচ্ছে সকলকে। ওয়াশরুমে হ্যাণ্ডওয়াশ এবং বারবার হাত ধোয়ার জন্য নির্দেশনা। এছাড়াও ক্লাসরুমে ঢুকতে হ্যাণ্ড স্যানিটাইজার দিয়ে হাত পরিষ্কার করতে হচ্ছে। এই নিয়ম মানতে হচ্ছে ক্লাসরুমে প্রবেশের সময়েও।
বিশ্ববিদ্যালয়টির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী রাউফ খান বলেন, জনসমাগম এড়িয়ে চলার কথা বলা হচ্ছে। বন্ধ করে দেয়া হচ্ছে পূর্ব নির্ধারিত অনুষ্ঠান। সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কেন খোলা থাকবে? কোন যুক্তিতে? তিনি আরো বলেন, সরকারের এখনই কমপক্ষে কয়েক সপ্তাহের জন্য হলেও বন্ধ ঘোষণা করা উচিত।
বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা। লালমাটিয়ার চাইল্ডহুড কিন্টারগার্ডেন স্কুল ছুটির পরে দেখা যায়, অধিকাংশ শিশু ফেস মাস্ক পড়ে বের হচ্ছে। অভিভাবকরাও মাস্ক পড়ে সন্তানের অপেক্ষায়। ব্যবসায়ী বাবা ইসতিয়াক আহমেদ বলেন, এটা যেন সন্তানকে নিয়ে জুয়া খেলা। বুঝছি এখনও দেশের অবস্থা অনেক দেশের থেকে ভালো। তাই বলে কী আমরা ভীতিকর পরিস্থিতির অপেক্ষা করব?
এই সচেতনা অনেকটাই কম দেখা যায় শুক্রাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এখানে অধিকাংশ শিক্ষার্থী নিজে নিজেই যাতায়াত করে। তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী প্রনব কর্মকার বলে, ক্লাসে ম্যাডাম বলেছে পরিষ্কার থাকতে। ভালো করে হাত ধুতে। প্রনবের কাছে জানা যায়, তার ক্লাসের অধিকাংশ শিক্ষার্থীই কয়েকদিন ধরে অনুপস্থিত।
সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়লে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে- শিক্ষামন্ত্রী: শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি গতকাল বঙ্গবন্ধু ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক জাতীয় স্কুল হকি প্রতিযোগীতা অনুষ্ঠানে বলেন, আমাদের এখানে স্থানীয় পর্যায়ে কোন সংক্রমণই নেই। বিদেশ থেকে সংক্রমণ বয়ে নিয়ে আসা সেটি আমরা বন্ধ করার চেষ্টা করছি। সমস্ত জায়গায় খুব ভালো ব্যবস্থাও করা হয়েছে। স্থলবন্দরগুলোও বন্ধ আছে। আর বিমানবন্দরগুলোতেও ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে এবং যারা আসছেন তাদের ও কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তো আমরা আশা করছি দেশের বাইরে থেকে সংক্রমণ আসাটাও বন্ধ হবে।
তিনি আরো বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি। যদি কখনো এমন অবস্থা দেখা যায় যে স্থানীয় পর্যায়ে সংক্রমণ ছড়িয়ে যাচ্ছে সেক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে, যদি প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত স্কুল-কলেজ বন্ধ করার মতো কোনো কারণ তৈরি হয়নি। আর অনেকেই কিছুটা আতঙ্কিত হচ্ছেন। তাই সবার কাছে বিনীত অনুরোধ করবো আতঙ্কিত হবেন না এবং আতঙ্ক ছড়াবেন না।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, আসুন আমরা সবাই ব্যক্তিগত পর্যায় থেকে সতর্ক হই যেন এই করোনা ভাইরাস এখানে না আসে এবং কোনভাবেই ছড়িয়ে না পড়ে। আমরা সর্তকতা অবলম্বন করি তাহলে পুরোটা ঠেকাতে পারব। এ ব্যাপারে আমাদের সবার সচেষ্ট হতে হবে। অর্থাৎ আতঙ্ক নয় সতর্ক হোন।
ক্লাস-পরীক্ষা বন্ধ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে: এরই মাঝে ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনের ডাক দিয়েছে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। ক্লাস বর্জন করার পর গতকাল বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা (বুয়েট) ক্লাসে উপস্থিত হননি। এছাড়াও ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি), রাজশাহী প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (রুয়েট), শের-ই-বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (শেকৃবি), নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (নোবিপ্রবি), সাভারের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং এণ্ড রিসার্চ (নিটা)।
এছাড়াও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি)’র একাধিক বিভাগ ক্লাস পরীক্ষা বর্জন করেছে। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিদ্ধান্ত না হলেও অধিকাংশ শিক্ষার্থী ক্লাস পরীক্ষা বর্জনের পক্ষে মত দিয়েছেন। একই অবস্থা খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে (খুবি)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দুটি বিভাগের শিক্ষার্থীরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জন করেছেন আর অধিকাংশ শিক্ষার্থীর মত বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণার। কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুবি) বন্ধের ঘোষণা না দিলেও শিক্ষার্থীরা বন্ধ চাইছেন।
স্কলাসটিকা স্কুল বন্ধ ঘোষণা: গতকাল রাজধানীর স্কলাস্টিকা স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। স্কুল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকদরে মাঝে মেইলের মাধ্যমে জানানো হয়, ১৮ই মার্চ থেকে ২৮শে মার্চ পর্যন্ত বন্ধ থাকার নির্দেশ। এটিকে তারা বসন্তকালীন ছুটি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য: করোনা ভাইরাসের পরিপেক্ষিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করার কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি বলে জানিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। মন্ত্রণালয় বলেছে, এই বিষয়ে কোন সিদ্বান্ত নিলে সাথে সাথে সকলকে অভিহিত করা হবে। তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছে বলে একটি মহল গুজব ছড়াচ্ছে। এ বিষয়ে বিভ্রান্ত না হতে অনুরোধ করেছে মন্ত্রণালয়। গতকাল রোববার শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবুল খায়েরের পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বিষয়টি জানানো হয়।