পরিবহণ শ্রমিকের সাথে বিরোধের জেরে গাজীপুরে খুন হয়েছে ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল শরীফ আহাম্মেদ। খুনীরা শরীফকে বাসে উঠিয়ে নিয়ে হাত-পা বেঁধে গলা কেটে ও মাথায় আঘাত করে হত্যার পর লাশ ন্যাশনাল পার্ক এলাকায় মহাসড়কের পাশে ফেলে দেয়। এ ঘটনার মূলহোতাসহ পরিবহণের তিন শ্রমিককে আটক করেছে র্যাব-১ এর সদস্যরা। রোববার র্যাব-১’র অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফী উল্লাহ বুলবুল এ তথ্য জানিয়েছেন।
গ্রেফতারকৃতরা হলো- ময়মনসিংহের তারাকান্দা থানার মোজাহাদী গ্রামের আব্দুল মালেকের ছেলে মো: মোফাজ্জল হোসেন (২৮), একই গ্রামের মৃত জবান আলীর ছেলে মাসুদ মিয়া (২৫) ও নেত্রকোনা জেলার কমলাকান্দা থানার দরিয়াকোনা এলাকার আব্দুল করিমের ছেলে মনির হোসেন (৩০)। এদের মধ্যে মোফাজ্জল ও মনির গাজীপুরের তাকওয়া পরিবনের এবং ভাড়াটে খুনী মাসুদ ময়মনসিংহের ত্রিহুইলার চালক।
র্যাব জানায়, গত ৪ মার্চ গাজীপুরের ভাওয়াল ন্যাশনাল পার্কের ৪নং ও ৫নং গেইটের মাঝামাঝি গিভেন্সী কারখানা এলাকায় ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশ (পূর্ব) থেকে গলাকাটা ও গলায় নাইলনের রশি পেঁচানো অবস্থায় এক অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার করা হয়। শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে লাশের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরিচয় শনাক্তের জন্য নিহতের ফিঙ্গারপ্রিন্ট সংগ্রহ করা হয়। নিহতের পরিচয় না পাওয়ায় গত ৮ মার্চ গাজীপুর সিটি করপোরেশনের পূর্ব চান্দনা কবরস্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে তার লাশ দাফন করা হয়। বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের তিন দিন পর আদালতের মাধ্যমে ১২ মার্চ রাতে কবর থেকে উত্তোলন করে শরীফ আহাম্মেদের লাশ শনাক্ত করা হয়।
নিহত শরীফ আহাম্মেদ (৩৩) গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে কর্মরত (কন্সটেবল নম্বর ৬২৩) ছিলেন। তিনি ময়মনসিংহের ত্রিশাল থানার ঝিলকি এলাকার আলাউদ্দিন ফকিরের ছেলে। প্রায় ছয় মাস আগে শরীফ গাজীপুর মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক দক্ষিণ বিভাগে যোগদান করেন।
নিহত শরীফের বাবাও পুলিশ সদস্য। তিনি ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা শহর পুলিশ ফাঁড়িতে কন্সটেবল পদে কর্মরত রয়েছেন।
র্যাব-১ জানায়, গাজীপুরের ট্রাফিক পুলিশের কনস্টেবল শরীফ হত্যাকান্ডের মূল হোতা শ্রীপুর থানাধীন গড়গড়িয়া মাষ্টারবাড়ী এলাকায় আত্মগোপন করে আছে। এ গোপন সংবাদ পেয়ে র্যাব-১ এর একটি টিম শনিবার রাতে সেখানে অভিযান চালিয়ে মোফাজ্জল হোসেনকে আটক করে। পরে তার দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে ময়মনসিংহের তারাকান্দা এলাকায় অভিযান চালিয়ে মাসুদ ও মনিরকে আটক করে। এসময় হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত তাকওয়া পরিবহনের একটি বাস, রক্তমাখা গাড়ির হুইল রেঞ্জ, একটি চাকু এবং নিহতের তিনটি মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা হত্যাকান্ডের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে মর্মান্তিক ও লোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দেয়।
র্যাব’র জিজ্ঞাসাবাদে আটককৃতরা জানায়, পুলিশ কনস্টেবল শরীফের সাথে মোফাজ্জল ও গাজীপুরের তাকওয়া বাসের চালক মনিরের পূর্ব পরিচয় ছিল। কয়েকদিন আগে তাদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়। এর জেরে শরীফকে হত্যার পরিকল্পনা করে মোফাজ্জল ও মনির। পরিকল্পনা অনুযায়ী কনস্টেবল শরীফকে খুন করার জন্য মাস্টারমাইন্ড মোফাজ্জল তার আত্মীয় কুখ্যাত ভাড়াটে খুনী মাসুদকে ১০ হাজার টাকার চুক্তিতে ভাড়া করে অগ্রীম ৫ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়। মাসুদ একজন থ্রি হুইলার ড্রাইভার, সে শম্ভুগঞ্জ-ময়মনসিংহ রোডে গাড়ি চালায়। তারা শরীফকে খুনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে মাসুদকে ২ মার্চ গাজীপুরে নিয়ে আসে। ৩ মার্চ দুপুরে মনির ৯৯ টাকার মার্কেট থেকে একটি চাকু ক্রয় করে মাসুদকে দেয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাত সাড়ে ১১টার দিকে মোফাজ্জল কৌশলে কনস্টেবল শরীফকে ভোগড়া বাইপাস এলাকায় এনে তাকওয়া পরিবহনে উঠিয়ে শ্রীপুরের মাওনার উদ্দেশ্যে রওনা হয়। পথে তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ভবানীপুর বাজার থেকে ইউটার্ন নিয়ে পুনরায় চান্দনা চৌরাস্তার দিকে যেতে থাকে। এসময় মনির বাসটি চালাচ্ছিল।
রাত দেড়টার দিকে বাসটি গাজীপুর সদর উপজেলার হোতাপাড়া এলাকায় পৌছলে দরজা-জানালা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসময় মাসুদ বাসের লোহার হুইল রেঞ্জ দিয়ে পিছন থেকে শরীফের মাথায় পর পর আঘাত করতে থাকে। এতে গুরুতর আহত হয়ে শরীফ জ্ঞান হারিয়ে গাড়ির মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে। পরে মোফাজ্জল ও মাসুদ নাইলনের রশি দিয়ে প্রথমে শরীফের দুই হাত বেঁধে গাড়ির পিছনের দিকে নিয়ে যায়। এরপর মোফাজ্জল অচেতন শরীফের বুকের উপর বসে এবং মাসুদ চাকু দিয়ে ভিকটিমকে গলাকেটে খুন করে। শরীফের মৃত্যু নিশ্চিত হলে তারা তিনজন শরীফের সাথে থাকা মোবাইল ফোন ও টাকা ভাগাভাগি করে নেয়। রাত দু’টার দিকে নিহতের লাশ ন্যাশনাল পার্কের ৪নং গেইটের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের পাশে ফেলে পালিয়ে যায়। পালিয়ে যাওয়ার সময় তারা হত্যাকান্ডে ব্যবহৃত রক্তমাখা চাকু পার্কের ঝোপে ফেলে দেয়।
পুলিশ কনস্টেবল শরীফকে হত্যার পর রাত আড়াইটার দিকে বাসটি বাসন এলাকার মাম সিএনজি পাম্পের সামনে নিয়ে পাম্পের পানি দিয়ে গাড়ির রক্ত ধুয়ে-মুছে পরিষ্কার করে হত্যাকারী তিনজন। তারা তাদের রক্ত মাখা জামা-কাপড় পলিথিন ব্যাগে ভরে গাড়ির টুলবক্সে রেখে দেয়। পরে তারা তিনজন মনিরের নাওজোরস্থ বাসায় গোসল করে একত্রে রাতের খাবার খেয়ে রাত্রিযাপন করে। পরদিন ৪ মার্চ সকালে তাদের রক্তমাখা জামা-কাপড় কড্ডা ব্রিজের নিচে তুরাগ নদীতে ফেলে দিয়ে মাসুদ তার বাড়ি চলে যায় এবং মোফাজ্জল ও মনির তাদের স্বাভাবিক কাজকর্মে যোগ দেয়।