প্রাণঘাতি নভেল করোনা ভাইরাস দাপট দেখাচ্ছে সারা বিশ্বজুড়ে। ছড়িয়ে পড়া এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ৫ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন। আক্রান্তের সংখ্যাও লাখ লাখ। বিশ্বজুড়ে এমন সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে বন্ধ হয়ে গেছে বিভিন্ন দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শুধু তাই নয়, এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের যোগাযোগ এখন বিচ্ছিন্ন প্রায়।
এ অবস্থায় বাংলাদেশও সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। সতর্কতা অবলম্বনের অংশ হিসেবে গণজমায়েতে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে। সরকারের তরফে ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদযাপন অনুষ্ঠান স্থগিত করে ঘরোয়াভাবে পালন করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
২৬শে মার্চ স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানও স্থগিত করেছে সরকার। এত এত সতর্ক অবস্থানে থাকলেও কেন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সর্বত্র। প্রতিবেশী দেশ ভারতেও বন্ধ হয়ে গেছে সব শিক্ষ প্রতিষ্ঠান। কিন্তু প্রথম দফায় ৩ জন ও দ্বিতীয় দফায় ২ করোনা আক্রান্তের খবর নিশ্চিত করেও স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলা রেখেছে বাংলাদেশ সরকার।
এ বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী একাধিক বক্তব্যে বলেন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের সিদ্ধান্ত হয়নি। আমরা আইইডিসিআর-এর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখছি।
কিন্তু ফ্লাইট বাতিলসহ সবকিছু বন্ধ ঘোষণা করা হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধে কেন সিদ্ধান্ত হয়নি সে ব্যাখ্যা সরকারের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করা হয়নি। এদিকে স্কুল কলেজ বন্ধ না হওয়ায় অনেক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে অভিভাবকদের মধ্যে। অনেকে ক্ষোভ প্রকাশ করে জানিয়েছেন, গণজমায়েত বন্ধ করা হলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তো জমায়েত হয়। শিক্ষার্থীরা এক কক্ষের মধ্যে ৬০ জনের বেশি একসঙ্গে ক্লাস করে। এ অবস্থায় তো ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা বেশিই থাকে। তাহলে কেন স্কুল বন্ধ হচ্ছে না?
মিরপুরের একটি স্কুলের শিক্ষার্থীর অভিভাবক জান্নাতুল মানবজমিনকে বলেন, আমার বাচ্চা ক্লাস থ্রিতে পড়ে। ক্লাস রুমে একসঙ্গে ৩৫ জন বসে। করোনা ভাইরাসের কথা যখন থেকে শুনেছি তখন থেকেই চিন্তায় পড়ি। দেশের সব বন্ধ হচ্ছে, এত সতর্কতা নেয়া হচ্ছে তাহলে কেন স্কুল খোলা রাখছে? এই রহস্যই বোঝা যাচ্ছে না। আল্লাহ না করুক যদি আমার বাচ্চার কোনো ক্ষতি হয়! আবার এমনও হতে পারে আমার বাচ্চা থেকে আরো অনেক বাচ্চা ক্ষতিগ্রস্ত হলো। এ দায় কে নেবে তখন? বাড্ডার একটি স্কুলের অভিভাবক রিয়াজ বলেন, ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর জীবন নিয়ে খেলা করা হচ্ছে নাকি? সারা বিশ্বে করোনার আতঙ্কে স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করেছে। আর আমাদের দেশে এটা ওটা স্থগিত করে কিন্তু স্কুল খোলা রেখেছে। আরে গণজমায়েত তো স্কুলে বেশি হয়। বাচ্চারা একই বেঞ্চে তিনজন করে বসে। তারা তো জানে না বোঝে না। ওদের কারো সংক্রমণ হলে সরকার কি দায় নেবে?
খিলগাঁওয়ের একটি স্বনামধন্য কলেজের শিক্ষার্থীর অভিভাবক ফারজানা জাহান বলেন, আমাদের বাচ্চাাদের নিরাপত্তা আগে নিশ্চিত করা জরুরি ছিল। গণজমায়েত বন্ধ করা হয়েছে। স্কুল কলেজে কি গণজমায়েত হয় না? আমরা অভিভাবকরা কলেজে-স্কুলে ছেলে-মেয়েকে দিতে আসলে একসঙ্গে কতজন মানুষ বসতে হয়। আমাদের মধ্য থেকেও ভাইরাস ছড়াতে পারে। বাদ দিলাম আমাদের কথা। বাচ্চারা তো এক রুমে ৫০ জনের মতো ক্লাস করে। তাদের মধ্যে ভাইরাসটি ছড়ানোর সম্ভাবনা বেশি। তাই আগে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা উচিৎ।
এ বিষয়ে লেখক, শিক্ষাবিদ ড. জাফর ইকবালের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজী হননি। তিনি বলেন, কোনো বিষয় নিয়ে বলতে হলে সে সম্পর্কে জানতে হয়। আমি তো চিকিৎসক নই। এ ব্যাপারে আমার কোনো ‘সে’ (বক্তব্য) নেই।
এদিকে করোনা প্রতিরোধে স্কুল কলেজ বন্ধ না হওয়া নিয়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে প্রশ্ন তুলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুলও ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। তিনি তার স্ট্যাটাসে লেখেন, সরকারের ভেতরে বা তার ধারে কাছে থাকার সুবাধে কোটিপতি হওয়া ব্যক্তিদের অনেকের সন্তান পড়ে বিদেশে বা দেশের বিদেশী মানের স্কুলগুলোতে। ফুল অটো গাড়ি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, মাস্ক, স্কুলের পরিবেশ সব মিলিয়ে তারা থাকে কম ঝুঁকিতে।
কিন্তু বাংলাদেশে আমজনতার বিপুল সংখ্যক সন্তানরা স্কুলে আসে গণপরিবহনে। স্কুলে থাকে না টয়লেট, হাত ধোয়ার পানি আর সাবানের সুব্যবস্থা। স্কুলের সামনে ফেরী করা খাবার থাকে উন্মুক্ত ও নোংরা। ফলে এদের করোনায় সংক্রামিত হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেশী।
সরকারের এসব না জানার কথা না। প্রশ্ন হচ্ছে তাহলে এতোকিছুর পরও কেন স্কুল বন্ধ দেয়া হচ্ছে না? আমাদের শিশুদের এবং তাদের পরিবারগুলোকে এমন ঝুকির মুখে ঠেলে দেয়ার অধিকার কে দিয়েছে এ সরকারকে? কেউ কেউ কিন্তু এরসাথে ১৭ মার্চ পালনের কোন সম্পর্ক আছে কিনা এ সন্দেহ করছে। যদি সত্যি তা হয় তাহলে এটি হবে বঙ্গবন্ধুরই জীবন দর্শনের বিরাট অবমাননা।
একই প্রশ্ন তুলে সাংবাদিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সামিয়া রহমানও এক ফেসবুক পোস্টে তিনি বলেন, কেন সচেতনতার দড়ি টেনে টেনে আজও ১৫ মার্চ পর্যন্ত স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় খোলা? কেন জনসমাগম এড়ানোর কথা মুখে বলে শিক্ষার্থীদেরকে, মানুষকে জনসমাগমের মধ্যে ঠেলে দেয়া? এই দ্বিমুখী আচরণ কেন? কার সুবিধার জন্য? বোকার স্বর্গে কি আছি আমরা? নাকি আসলেই জনগণ আমরা অতি বোকা?
প্রসঙ্গত, ইউনেস্কোর হিসাবে সারাবিশ্বে ৪৯টির মতো দেশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণা দিয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে ৬৫ হাজারেরও বেশি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী রয়েছে। এছাড়া বেসরকারি স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তো রয়েছেই। যার কোনোটিই বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়নি।