নারায়ণগঞ্জ: ইতালি ফেরত স্বামী তানভীরের (ছদ্মনাম) সংস্পর্শে এসেই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন স্ত্রী সুমাইয়া(ছদ্মনাম)। মুন্সিগঞ্জের এই দম্পত্বি পরিবার-পরিজন নিয়ে ভাড়ায় থাকতো নারায়ণগঞ্জ শহরের আল এস এম মালেহ রোডের আল জয়নাল প্লাজায়। স্বামীর বয়স ৩৫ আর স্ত্রীর বয়স ২৩ বছর। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ইতালী থেকে চলে আসেন তানভীর। বাসায় প্রথমে জ্বর অনুভব হলে তাকে নেয়া হয় নারায়ণগঞ্জ শহরের একটি ডায়গনিষ্টিক সেন্টারে । সেখানে তাদের রক্ত, কপ, ইউরিনসহ অন্যান্য পরীক্ষা দেয়া হয়। ওই ডায়গনষ্টিক থেকে ফোনে জানানো হয় আইইডিসিআর এ। পরে তাদের দুইজনকেই কঠোর গোপনীয়তায় নিয়ে আসা হয় ঢাকায়।
গত ৮ মার্চ আইইডিসিআর সংবাদ সম্মেলন করে দেশে করোনা (কোভিড-১৯) আক্রান্ত হওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এদিকে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার তিন দিন পর দেশে করোনা (কোভিড-১৯) আক্রান্ত (নারায়ণগঞ্জের স্বামী-স্ত্রীসহ) প্রথম তিন রোগীর অবস্থাই এখন ভালো বলে জানিয়েছে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর)।
প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক অধ্যাপক ড. মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা বলেন, ‘আক্রান্ত তিন জনের অবস্থাই এখন ভালো। এর মধ্যে দুই জন একেবারেই সুস্থ। তাদের ব্লাড পরীক্ষায় নেগেটিভ ফল পাওয়া গেছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী পর পর দুটি পরীক্ষায় করোনা নেগেটিভ না আসলে তাদের পুরোপুরি সুস্থ বলা যাবে না। তাই আমরা এখনই তাদের ছাড়ছি না।
বুধবারে বিকেলে গিয়ে দেখা গেছে, প্রথম করোনা আক্রান্তের খবরে নারায়ণগঞ্জে এখনো বিরাজ করছে আতংক। বিশেষ করে যে ফ্লাটে ইতালী প্রবাসী বসবাস করতো তার আশেপাশে জনগমাগম কমে গেছে। ওই প্লাজার নিচে অবস্থিত মার্কেটটি বন্ধ রয়েছে অন্যান্য প্লাটের বাসিন্দার রয়েছে কার্যত বন্দি।
এদিকে করোনা আক্রান্ত ইতালি প্রবাসী দেশে ফেরার পর তার সাথে দেখা করছে এমন ৪০জনের তালিকা করে তাদের পর্যাবেক্ষণে রাখা হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিক্যাল অফিসার মোঃ আসাদুজ্জামান এ তথ্য জানিয়েছেন ।
তিনি জানান, বিদেশ ফেরৎ আক্রান্তদের রাজধানী ঢাকায় চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে । তাদের বাসা নারায়ণগঞ্জ শহরের এসএম মালেহ রোডের আল জয়নাল প্লাজার ১৩ তলায় । আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সদর থানা সংলগ্ন জয়নাল প্লাজায় বিশেষ নজরদারীতে রাখা হয়েছে। অনেক এখানে ভীড় করলেও সকলের উচিৎ হবে এই বিষয়গুলি এড়িয়ে চলা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগের একটি নির্ভরযোগ সূত্র আরো জানায়, করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) আক্রান্ত রোগী অসুস্থ অবস্থায় প্রথমে শহরের পপুলার ডায়াগণষ্টিক সেন্টারে এবং পরে রাজধানীতে বিভিন্ন চিকিৎসা কেন্দ্রে উপস্থি হয়ে তার অসুস্থ্যতা ও বিদেশ ফেরতের বিষয়টি জানানোর পর পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ধরা পরে তিারা আক্রান্ত করোনা (কোভিড-১৯) ভাইরাসে। এদিকে বুধবার পর্যন্ত মোট ১২জন বিদেশ ফেরত ব্যাক্তিকে কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে।
সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ নয়াদিগন্তকে বলেন, বাংলাদেশে যে তিনজন আক্রান্ত হয়েছেন তাদের মধ্যে দুইজন নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা। তারা ঢাকার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন । তবে নারায়ণগঞ্জের লোকজনদের আতঙ্কিত না হবার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। সরকারিভাবে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেসব নির্দেশনা মেনে চলারও কথা বলেন তিনি ।
এর আগে আইইডিসিআরপ্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা জানান, জ্বর ও কাশি নিয়ে এই তিন ব্যক্তি (নারায়ণগঞ্জের দুজনসহ) গতকাল আইইডিসিআরের হটলাইনে যোগাযোগ করেন। এরপর গত ২৪ ঘণ্টায় তাদের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় তারা পজিটিভ প্রমাণিত হন। তবে তিনজনই ভালো আছেন। তারা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।
তিনজনেরই বিশেষ কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই। করোনার চিকিৎসা হচ্ছে সিম্পটোমেটিক অর্থাৎ লক্ষণ উপসর্গভিত্তিক। তারা সেই চিকিৎসাই পাচ্ছেন, তাদের অন্য কোনো সাপোর্টিভ চিকিৎসার প্রয়োজন হয়নি। তবে তারা আইসোলেশনেই থাকবেন। যতদিন পর্যন্ত পরপর দুটো নমুনাতে তারা নেগেটিভ প্রমাণ না হচ্ছেন ততদিন পর্যন্ত তারা আইসোলেশনেই থাকবেন।
এদিকে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে নারায়ণগঞ্জে অতিরিক্তভাবে কোয়ারেন্টাইনের ৫০ শয্যা প্রস্তুত রাখা হয়েছে। শহরের শায়েস্তা খান সড়কে নির্মিত জুডিশিয়াল ভবনে ওই ৫০টি শয্যার ইউনিট খোলা হয়েছে। এর আগে শহরের ১০০ শয্যা ও ৩০০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে ৫টি করে ১০ শয্যার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখন এ ১০ শয্যার সঙ্গে নতুন করে ৫০ শয্যা যুক্ত হয়েছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে নারায়ণগঞ্জের ৩০০ শয্যা হাসপাতাল ও নারায়ণগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে (১০০ শয্যা হাসপাতাল) ৫টি করে ১০টি শয্যার ব্যবস্থা করা হয় প্রতিরোধ এবং চিকিৎসার জন্য।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নারায়ণগঞ্জে জেলা মাল্টিসেক্টরাল কমিটি গঠন করা হয়েছে। জেলা প্রশাসক মো. জসিম উদ্দিনকে সভাপতি এবং জেলা সিভিল সার্জন ডা. ইমতিয়াজ আহম্মেদকে সদস্য সচিব করে এ কমিটি করা হয়।
এদিকে করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে অতিরিক্ত মূল্যে মাস্ক বিক্রি করায় ও অবৈধ ওষুধ মজুদ রাখায় নারায়ণগঞ্জ শহরের কালিরবাজারের বিভিন্ন ওষুধের ফার্মেসীতে অভিযান চালিয়ে ১জনকে ১মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড ও ৮ ফার্মেসীকে ১লাখ ৫হাজার টাকা জরিমানা করেছে ভ্রাম্যমাণ আদালত।একই সঙ্গে বিভিন্ন ফার্মেসীকে মুচলেকার মাধ্যমে সতর্ক করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মেহেদী হাসান ফারুক বলেন, করোনা ভাইরাসকে কেন্দ্র করে সার্জিকেল মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজারের মূল্য অধিক পরিমাণে বৃদ্ধি করেছে। বৃদ্ধির ফলে জনগনের মধ্যে একটা প্যানিক তৈরী হয়েছে। সেই প্যানিক দূর করতেই আমাদের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. জসিমউদ্দিনের নির্দেশনায় এখানে এসে ৩জন ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান পরিচালনা করি।
নারায়ণগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. মুহাম্মদ ইমতিয়াজ নয়াদিগন্তকে বলেন, নারায়ণগঞ্জে সন্দেহজনক যদি কেউ করোনা ভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে যায় তাহলে তাৎক্ষনিক যাতে আমরা রাখতে পারি এজন্য আইইডিসিআর এর পরামর্শ অনুযায়ী ৫০ শয্যা করোনা সেল ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা প্রয়োজন হতেও পারে আবার নাও হতে পারে। প্রয়োজন হলে যেন তাৎক্ষনিক ব্যবস্থা নিতে পারি এজন্য করে রাখা হয়েছে।
সিভিল সার্জন আরো বলেন,করোনা ভাইরাস পজেটিভ কিংবা নেগেটিভ পরীক্ষার যন্ত্রাংশ দেশের কোন জেলাতেই নাই। শুধু মাত্র ঢাকাতেই আছে। প্রথমে যদি সন্দেহ হয় আপনি করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত কিংবা আপনি, আপনার ভাই বা আত্মীয় স্বজন ১০ থেকে ১৫ দিন আগে করোনা আক্রান্ত দেশ থেকে ভ্রমণ করে এসেছে তখনই আমরা তাকে সন্দেহ করবো। তখনই তাকে আমরা এ ৫০ শয্যার আইসোলেশন ইউনিটে রাখবো। এখানে চিকিৎসা দিবো ও রক্ত পরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাবো। তখন ঢাকা থেকে যদি বলে সে করনো ভাইরাসে আক্রান্ত এবং তাকে এখানে রাখবো না ঢাকায় পাঠিয়ে দিবে তাদের নির্দেশ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়া হবে।