চীন থেকে উৎপত্তি হওয়া করোনাভাইরাস এখন বিশ্বের শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। রোববার সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বাংলাদেশের নাম। প্রথমবারের মতো প্রাণঘাতী এই ভাইরাসে বাংলাদেশেও তিনজন রোগীর সন্ধান পাওয়া গেছে। নতুন এই ভাইরাসের প্রকোপ থেকে বাঁচতে অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে খাদ্য সামগ্রী, মাস্ক এবং স্যানিটাইজার মজুদ করছেন। কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় মাস্কের দরকার নেই। বরং মাস্ক ব্যবহারের কারণে এই ভাইরাসে সংক্রমিত হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে। আপাতত করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় হাত ধোঁয়াসহ সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ অনুসরণ করার পরমার্শই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
করোনায় প্রাণহাণির সংখ্যা গড়ে মাত্র ৩.৪ শতাংশ। যা প্রত্যেক বছরের মৌসুমী অন্যান্য ফ্লুবাহিত রোগের প্রাণহানির মতোই। অযথা আতঙ্কিত না হয়ে বরং একটু সচেতনতা অবলম্বন করলেই এই ভাইরাস তেমন কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। করোনাভাইরাসে বিশ্বে এখন পর্যন্ত ৩ হাজার ৮০০’র বেশি মানুষ মারা গেছেন; যাদের অধিকাংশই আগে থেকে ডায়াবেটিস, কিডনি কিংবা অন্যান্য জটিল রোগে আক্রান্ত এবং বৃদ্ধ। এমন পরিস্থিতিতে অযথা আতঙ্ক ছড়িয়ে মাস্ক কিংবা অন্যান্য প্রতিরোধ সামগ্রী মজুদ করে বৈশ্বিক সঙ্কট তৈরি না করাই সচেতন মানুষের কাজ বলে মন্তব্য করেছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
করোনাভাইরাস মোকাবিলায় করণীয় বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ফোর্বস ম্যাগাজিনে লিখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বিজ্ঞান, মেডিসিন, স্বাস্থ্য এবং ভ্যাকসিন বিশেষজ্ঞ তারা হায়েলে। সেখানে তিনি অযথা মাস্ক না পরার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। এমনকি আপনার পাশেই যদি কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন, তাহলেও আপনার সার্জিক্যাল মাস্ক, এন৯৫ মাস্ক, শ্বাসযন্ত্রের মাস্ক কিংবা অন্য কোনো ধরনের মাস্ক পরার দরকার নেই। এগুলোর কোনো কিছুরই দরকার নেই। বরং সংক্রমিত ব্যক্তি মাস্ক পরলে সেটি অন্য কারও মাঝে সংক্রমণ ঘটাতে পারবে না।
বিশেষজ্ঞ এলি পেরেনসেভিচ বলেন, যারা স্বাভাবিকভাবে সুস্থ আছেন তাদের মাস্কের দরকার নেই, মাস্ক পরা উচিত নয়। সুস্থ মানুষ মাস্ক পরার পর করোনা থেকে রক্ষা পাবেন; এমন কোনো প্রমাণ নেই। তারা এই মাস্ক ভুলভাবে পরছেন। আর এতে বরং সংক্রমণের ঝুঁকি আরো বেশি বাড়ছে। কারণ তারা মাস্ক পরার পর বারবার মুখ স্পর্শ করছেন। শুধুমাত্র অসুস্থ হলেই মাস্ক পরুন, অন্যথায় নয়।
মুখ এবং নাকে যাতে কোনোভাবেই করোনাভাইরাস পৌঁছাতে না পারে; সে লক্ষ্যেই অধিকাংশ মানুষ মাস্ক ব্যবহার করছেন। করোনাভাইরাস হাঁচি এবং কাঁশির মাধ্যমে ছড়ায়; বাতাসের মাধ্যমে নয়। এর অর্থ হচ্ছে আপনি এলোমেলোভাবে নিশ্বাস নিতে পারবেন না। এ কারণে মানুষ যে ধরনের মাস্ক পরছে তাতে সংক্রমণ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে না। আর এসব মাস্ক নকশা করা হয়েছে হাঁচি-কাঁশির জীবাণু ভেতরে রাখার জন্যই এবং এর মাধ্যমে যাতে অন্যরা সংক্রমিত না হন।
একমাত্র সেই সময়ই কোনো ব্যক্তি মাস্ক পরতে পারে; যখন তিনি অসুস্থ এবং বাসা থেকে বাইরে যাবেন। বিশেষজ্ঞ এলি পেরেনসেভিচ বলেছেন, আপনি যদি মনে করেন যে ফ্লুতে ভুগছেন অথবা করোনাভাইরাস সংক্রমিত হয়েছেন, তবেই অন্যদের সুরক্ষার জন্য মাস্ক পরুন। বাড়িতে আপনি যদি নিজেকে অসুস্থ বলে মনে করেন, তাহলে পরিবারের সদস্যদের রক্ষার জন্য আপনার মাস্ক পরা উচিত।
মার্কিন এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরো বলছেন, কোনো ব্যক্তি যদি বাড়িতে করোনা আক্রান্ত কারো সেবা করেন, সেক্ষেত্রে ওই ব্যক্তির কাছে যাওয়ার সময় আপনার মাস্ক পরাটা হবে বুদ্ধিমানের কাজ। এ সময় সংক্রমিত ব্যক্তিকেও মাস্ক পরতে হবে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঘটার পর থেকেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মাস্কের সংকট দেখা দিয়েছে। চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের সুপার মার্কেটগুলোতে মাস্ক নেই, এমন প্ল্যাকার্ড দেখা গেছে। তবে মাস্ক কী আসলে করোনাভাইরাস প্রতিরোধ করতে পারে? তবে বিশ্বের কোথাও করোনাভাইরাসের কোনো প্রতিষেধক আবিষ্কার না হওয়ায় হাত ধোঁয়াসহ সতর্কতামূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ অনুসরণ করার পরমার্শই দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি)।
যুক্তরাষ্ট্রের ভ্যানডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের মেডিসিনের অধ্যাপক ডা. উইলিয়াম স্ক্যাফনার বলেছেন, মানুষ মনে করে যে- নিজের নাক ও মুখ স্কার্ফ বা মাস্ক দিয়ে ঢেকে রাখলে চারপাশে ঘুরতে থাকা এসব ভাইরাস থেকে কিছুটা হলেও মুক্তি মিলবে। কিন্তু শ্বাসযন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন রোগ যেমন ফ্লু এবং করোনাভাইরাসের (কোভিড-১৯) ক্ষেত্রে এটি কার্যকর নয়। যদি তাই হতো তাহলে সিডিসি বহু বছর আগেই এমন পরামর্শ দিতো। কিন্তু তারা এমনটি করেনি, কারণ তারা বিজ্ঞানভিত্তিক সুপারিশ করে থাকে।
যুক্তরাষ্ট্রের সেন্টার ফর ডিজিস কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) বলছে, সংক্রমণ ঘটাতে পারে এমন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা যেগুলো বাতাসে ঘুরে বেড়ায় তা সার্জিক্যাল মাস্ক পরলেও আটকানো সম্ভব না। এমনকি এসব মাস্ক চেহারার চারপাশে স্নাগসিলও তৈরি করে না। বরং যাদের মধ্যে ইতোমধ্যে করোনার লক্ষণ দেখা গেছে এবং বাইরে যেতে হবে, তাদের মাস্ক পরেই বাইরে যাওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সিডিসি; কেননা করোনার লক্ষণযুক্ত ব্যক্তি যখন বাইরে যায়, তখন ওই ব্যক্তির কাঁশি বা হাঁচিতে যেন তার চারপাশের মানুষজন সুরক্ষিত থাকতে পারে। এজন্যই করোনায় আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ দেখা গেলে ওই ব্যক্তিকেই মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি করোনায় আক্রান্ত ব্যক্তিদের সেবাকারী ব্যক্তিদের ক্ষেত্রেও এসব মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছে সিডিসি।
এমনকি স্বাস্থ্যকর্মী ছাড়া অন্যদের ক্ষেত্রে এন-৯৫ রেসপিরেটরস মাস্ক ব্যবহারের পরামর্শও দেয়নি সিডিসি। এরইমধ্যে মাস্ক কেনা বন্ধে মানুষজনকে আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। গত ২৯ ফেব্রুয়ারি মার্কিন সার্জন জেনারেল ডা. জেরোমি অ্যাডামসও মাস্ক কেনা বন্ধ করতে মানুষের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, এসব মাস্ক সাধারণ মানুষের করোনায় সংক্রমিত হওয়া ঠেকাতে পারবে না। কিন্তু স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসার সময় মাস্ক না পরলে বরং আশেপাশের মানুষ ঝুঁকিতে পড়বে।
ফক্স অ্যান্ড ফ্রেন্ডসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ডা. জেরোমি অ্যাডামস বলেন, এমনকি মাস্ক পরলে ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তিনি বলেন, যারা সঠিকভাবে মাস্ক পরতে পারে না তাদের মুখে হাত দেয়ার প্রবণতা বেশি এবং এর কারণে করোনা ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
উল্লেখ্য, এখন পর্যন্ত বিশ্বজুড়ে ১ লাখ ১০ হাজার ৬৬ জন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। বিশ্বব্যাপী মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৮৩০ জনে। তবে আশা জাগানিয়া তথ্য হচ্ছে এরই মধ্যে এ রোগে আক্রান্ত ৬২ হাজার ২৭৮ জন চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছেন।