বাংলাদেশ সফরে আসা ভারতের পররাষ্ট্র সচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা বলেছেন, আমরাই বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার উভয়েরই একমাত্র সত্যিকার বন্ধু দেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরও জাতীয় বীর। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে যৌথ প্রযোজনায় বিশেষ চলচ্চিত্র নির্মাণসহ জন্মশতবর্ষের বিভিন্ন আয়োজনের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত। শ্রিংলা আরো বলেন, আমি আপনাদের আশ্বস্ত করছি যে, শুষ্ক মৌসুমে আমাদের পানিসংকটের সর্বোত্তম সমাধান খুঁজতে এবং আমাদের পানি ব্যবস্থাপনার মান উন্নয়ন করতে আমরা বদ্ধপরিকর, যেন অভিন্ন নদীগুলো আগামী প্রজন্মেও জীবিকার উৎস হয়ে থাকতে পারে। আজ ঢাকায় পৌঁছার পর তিনি বক্তব্য রাখেন। এখানে তার বক্তব্য হুবহু তুলে ধরা হলো:
বাংলাদেশের বন্ধুগণ:
ঢাকায় আসতে পারা আমার জন্য খুবই আনন্দের কারণ ঢাকা আমার কাছে নিজের শহরের মতোই। ঢাকা ও বাংলাদেশের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের সম্পর্ক। আমি হাই কমিশনার হিসেবে এখানে কাজ করেছি এবং আমার কর্মজীবনের অন্যতম সন্তুষ্টিদায়ক পোস্টিং ছিল এটি।
এখানে আসার আগেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক বিষয়ে কাজ করার সময়ে অনেকবার আমি এই সুন্দর দেশে এসেছিলাম। সুতরাং পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে প্রথম বিদেশ সফরে ঢাকা আসতে পেরে আমি আনন্দিত।
আমি প্রথমেই বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট ফর ইন্টারন্যাশনাল এন্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজকে এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার জন্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশে আমাদের প্রধানমন্ত্রীর দ্বিতীয় সফরের প্রস্তুতি নিতে ঢাকায় আসা হলেও এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এতসব পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ দেয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ।
আপনারা জানেন, আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে এই মাসে মুজিববর্ষের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আমরা এই সফরের প্রত্যাশায় রয়েছি কারণ, আমাদের প্রধানমন্ত্রী এই সম্পর্কের প্রতি অগ্রাধিকার দেন এবং এর চেয়েও বড় কারণ, বঙ্গবন্ধু একজন বিশ্বনন্দিত নেতা এবং বাংলাদেশ ও আমাদের উপমহাদেশের মুক্তির প্রতীক। ভারতে তাঁর নাম বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তিনি বাংলাদেশে যেমন সম্মান লাভ করেন তেমনি ভারতেও তিনি সমান শ্রদ্ধার পাত্র। সুতরাং আমি এই জ্ঞানী, নির্ভীক, দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং সর্বোপরি এমন একজন বীর যিনি শোষণের হাত থেকে একটি জাতিকে মুক্তি দিয়েছেন, সেই মহান বঙ্গসন্তানের জন্মশতবর্ষে আপনাদের শুভকামনা জানাই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, শেখ মুজিবুর রহমান আমাদেরও জাতীয় বীর। তাই বঙ্গবন্ধুর জীবনী নিয়ে যৌথ প্রযোজনায় বিশেষ চলচ্চিত্র নির্মাণসহ জন্মশতবর্ষের বিভিন্ন আয়োজনের অংশীদার হতে পেরে আমরা গর্বিত।
বন্ধুগণ,
দূরত্ব অনেকসময় দৃষ্টিভঙ্গিতে সহায়তা করে। সোনার বাংলা থেকে দূরে থাকার এই এক বছরে আমাদের সম্পর্কের মৌলিক বিষয়গুলোর প্রতি আলোকপাত করার সুযোগ হয়েছে আমার এবং আমি দৃঢ়প্রত্যয়ের সাথেই পুনর্ব্যক্ত করতে পারি যে, এই সম্পর্কের প্রতি ভারত সত্যিকার অর্থেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে থাকে। আমাদের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রয়াত শ্রীমতী সুষমা স্বরাজ দুই বছর আগে ঢাকায় বলেছিলেন যে, আমাদের জন্য “প্রতিবেশী প্রথমে” এই নীতির বাস্তবায়নে “বাংলাদেশই প্রথমে”। আমরা যতটা জল, স্থল আর ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে সংযুক্ত ততটাই সংযুক্ত আমাদের অভিন্ন ইতিহাস, সংস্কৃতি আর আত্মত্যাগের মাধ্যমে। বাংলার মাটি এবং বাংলার জল আমাদের দুই দেশকে সমৃদ্ধ এবং লালনপালন করে; আমাদের সমাজ ও আত্মাকে টিকিয়ে রাখে। এটা অনস্বীকার্য যে, আমাদের সম্পর্ক গড়ে উঠেছে গভীরতম সাদৃশ্যের ভিত্তিতে যাকে অন্য কিছু ভাবা অসম্ভব।
প্রায়ই আমরা এসব বৃহত্তর বাস্তবতা থেকে দৃষ্টি হারাই, বিশেষ করে ক্ষণিকের উত্তেজনায়। কিন্তু আমরা যারা নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে আছি, আমাদের দৃষ্টি সবসময় নিবদ্ধ থাকে বাংলাদেশের সাথে নিকটতম সম্পর্ক তৈরিতে।
এখন আমার প্রশ্ন হল: সম্ভাব্য নিকটতম সম্পর্ক বলতে আমরা কী বুঝাচ্ছি?
খুব সাধারণভাবেই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের শক্তিশালী, সমৃদ্ধ, শান্তিপূর্ণ এবং সম্প্রীতির বাংলাদেশ বিনির্মাণে আপনাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমাদের পূর্ণ সমর্থন একবারেই ভারতের জাতীয় স্বার্থে। বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক সূচক, যেমন: শিশুমৃত্যু থেকে নারী শিক্ষা, প্রাথমিক স্বাস্থ্য থেকে স্বাক্ষরতা ইত্যাদি উন্নয়নে আপনাদের অভূতপূর্ব সফলতা বিশ্বের অর্থনৈতিক উন্নয়নে গতি এনে দিয়েছে। আজকে এশিয়ার উন্নয়নে নেতৃত্ব দিচ্ছে বাংলাদেশ, যেটা সত্যিই প্রশংসনীয় অর্জন।
যখন আপনারা দেশ গড়ছেন এবং দেশের মানুষ দ্রুত উন্নয়নের সুফলগুলো পেতে শুরু করেছে, তখন বাংলাদেশের উচিত এর কৌশলগত অবস্থান এবং দ্রুত বর্ধনশীল সক্ষমতার সুফল নেয়া। স্থলে, জলে আপনাদের সবচেয়ে বড় প্রতিবেশী হওয়ার কারণে এবং আমাদের এই বন্ধনের জন্য এটা খুবই স্বাভাবিক যে, আমাদের অংশীদারিত্ব অনেক বেশি পরিমাণে পারস্পরিক লাভজনক সহযোগিতাকেন্দ্রিক হবে। আমাদের নেতাদের বিচক্ষণতার কারণেই আমরা সীমান্ত ও জমি বিনিময়সহ অনেক কঠিন সমস্যা যেগুলো প্রতিবেশীদের মধ্যকার সম্পর্ক নষ্ট করে, সেগুলো চিহ্নিত করে পরিপক্কতার সাথে সমাধান করতে পেরেছি। আমি বলব যে বাংলাদেশ এবং ভারত যেভাবে এ ধরনের সমস্যাগুলি সমাধান করেছে তা অন্যান্য দেশের জন্য অনুকরণীয়।
সামগ্রিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ বিশ্বে আমাদের বৃহত্তম উন্নয়ন অংশীদার ও এই অঞ্চলে আমাদের বৃহত্তম বাণিজ্য অংশীদার। আমাদের দুই দেশের সরকারের মধ্যকার সম্পর্ক একইসাথে বিস্তৃত ও সমন্বিত যার মধ্যে রয়েছে ৭৫টি আলোচনার বিষয় যা আমাদের স্থায়ী অংশীদারিত্বের একটি শক্তিশালী কাঠামো গঠনের জন্য আমাদের জনগণ ও সরকারকে যুক্ত করেছে। মানুষে মানুষে বন্ধনের এই পর্যায়ে সারা বিশ্বে বাংলাদেশেই রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বেশি ভিসা কার্যক্রম এবং ভারতে বিদেশী ভ্রমণকারীদের সবথেকে বড় সংখ্যক হচ্ছেন আমাদের বাংলাদেশী বন্ধুগণ।
আমি এ বিষয়ে আরো বিস্তারিত বলতে চাই।
সরকার, ব্যবসায়, নাগরিক সমাজ এবং জনগণের মধ্যে সবচেয়ে নিকটতম সহযোগিতামূলক সম্পর্কে একটা প্রক্রিয়া সৃষ্টি হয় যেখানে পারস্পরিক স্বার্থ থাকে। অন্যকথায়, একটা সত্যিকারের বিকশিত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক হচ্ছে যেখানে একপক্ষের স্বার্থ সংরক্ষিত না হলে অন্যপক্ষের স্বার্থ নষ্ট হবে।
সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে আমাদের একটা বিষয় বুঝতে হবে যে, আজকে আমরা একটা মধুর সমস্যার সম্মুখীন: যে গতিতে আমাদের সম্পর্ক বিকশিত হয়েছে তা আমাদের আশা এবং আমাদের সরকারের সক্ষমতা দুটোই ছাপিয়ে গেছে।
এটা সম্ভব হয়েছে উভয় পক্ষের কিছু অপ্রয়োজনীয় নিয়ম এবং নিয়ন্ত্রণ যা বাণিজ্য, মানুষের সম্পর্ক, পর্যটন এবং এমনকি নিরাপত্তা সম্পর্ক সম্প্রসারণেও প্রতিবন্ধক হয়েছে সেগুলো চিহ্নিত করে সংশোধনের আন্তরিক চেষ্টার ফলে। আমরা ধারাবাহিক এবং ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ জাতীয় অনেকগুলি সমস্যা সমাধান করেছি। কোন ধরনের দোষারোপ না করে ধারাবাহিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমাদের অংশীদারিত্বের প্রতিবন্ধকতাগুলো চিহ্নিত করে এসব সমস্যা সমাধান করেছি। তার মানে আমাদের একটা দ্রুত ও বাস্তবসম্মত সমাধান খোঁজার প্রচেষ্টা করতে হবে।
আমি কয়েকটা উদাহরণ দিচ্ছি।
বিগত কয়েক বছরে, ভারত ভ্রমণের জন্য যেখানে অনেক দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হতো ভিসার জন্য সেখানে আজকে আমরা এমন পর্যায়ে রয়েছি যেখানে অন্য যে কোনও দেশের তুলনায় বাংলাদেশ থেকেই ভারতে বেশি পর্যটক যাচ্ছে। এছাড়া, ১৯৬৫ সালের আগেকার ৬টি রেল সংযোগ ২০২১ সালনাগাদ আবারো চালু হবে, যার ফলে স্থলপথে যোগাযোগ উল্লেখযোগ্যভাবেই উন্নত হবে। প্রান্তিক ইমিগ্রেশন ও কাস্টমস পরিষেবা চালুর ফলে কলকাতা-ঢাকা এবং কলকাতা-খুলনা রুটে মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপেসের জনপ্রিয়তা অনেক বেড়েছে। আমি জেনে আনন্দিত যে, মৈত্রী ও বন্ধন এক্সপেসের সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। পাশাপাশি নতুন পরিষেবা চালুর বিষয়ে আমরা একসঙ্গে কাজ করার অপেক্ষায় রয়েছি।
আমাদের পক্ষে, যে সব জায়গায় যাওয়ার জন্য আলাদা অনুমতি প্রয়োজন হয় সেগুলো সরিয়ে ফেলার জন্য কাজ করছি যাতে স্থলপথে ভ্রমণ আরও সহজ হয়।
আমরা বাণিজ্য সহজীকরণ ও প্রসারণে আরও নিবিড়ভাবে কাজ করছি। আরও সহজ বাণিজ্য প্রক্রিয়াগুলো আমাদের উভয় পক্ষের সম্পদ সৃষ্টি এবং কর্মসংস্থান তৈরির সুযোগ করে দেবে। এছাড়াও, আমাদের একে অন্যের বাজারে ব্যবসা সম্প্রসারণেরও অনেক সুযোগ রয়েছে এবং সরকার হিসেবে আমাদের উচিত, ব্যবসায়ীদের ও উদ্যোক্তাদের সুবিধার্থে একে অন্যের দেশে ব্যবসা করার সুযোগ দেয়ার চেষ্টা করা।
এক্সেলেন্সিজ, ভদ্রমহিলা ও মহোদয়গণ, এবং বন্ধুগণ,
বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল বলেছিলেন, “আমরা সবাই সুখ-দুঃখ সমানভাবে ভাগ করে নিই”। এই বাণী যেন আমাদের সবাইকে উদ্বুদ্ধ করে যে, এই বিশ্বায়নের যুগে সুখ-দুঃখ কোন সীমান্ত মানে না এবং সবার দ্বারপ্রান্তেই আসে। বাংলাদেশের প্রতি আমাদের মনোভাব সবসময় এই চেতনা দিয়েই প্রকাশিত হবে। আমার বিশ্বাস, আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সফরটিতে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নিরন্তর শুভেচ্ছা, বিশ্বাস ও সম্মানের পূর্ণ প্রতিফলন হবে।
সবাইকে ধন্যবাদ।