চট্টগ্রামের প্রভাবশালী মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন। এতে কোনো সন্দেহ নেই। নানা কারণে তিনি আলোচিত-সমালোচিত। চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে দু’টি ধারা। এক পক্ষে আ জ ম নাছির গ্রুপ ও অন্য পক্ষে ছিলেন প্রয়াত মেয়র এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরীর গ্রুপ। যার নিয়ন্ত্রক শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। চট্টগ্রাম মহানগর, ওয়ার্ড ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে মারামারি, খুনোখুনির ঘটনা এই দুই গ্রুপের মধ্যেই।
২০১৫ সালে চসিক নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আ জ ম নাছিরের সমর্থকরা শক্ত অবস্থান নেন।
ফলে প্রতিপক্ষের সাথে বাড়তে থাকে দাঙ্গা-হাঙ্গামা। এ নিয়ে চরম বিতর্কে পড়েন আ জ ম নাছির উদ্দিন। চট্টগ্রামের উন্নয়ন ও সেবা কাজে দৃষ্টি দিলেও সমালোচিত হন তিনি। এই সমালোচনায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা রাখেন নগর আওয়ামী লীগের কতিপয় সিনিয়র নেতা। এরমধ্যে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন, নগর আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ ও চউক চেয়ারম্যান আবদুচ ছালাম, নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, সাবেক প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী নুরুল ইসলাম বিএসসি, এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী পত্নী হাসিনা মহিউদ্দিন ও চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত মন্ত্রী-এমপিদের একটি বড় অংশ আ জ ম নাছির উদ্দিনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন।
আসন্ন চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ করেন ১৯ নেতা। যাদের অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে অভিযোগ। কেউ কেউ চরম বিতর্কিত।
সে হিসেবে বিতর্কের অনেক বাইরে ছিলেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. এম রেজাউল করিম চৌধুরী। যাকে আসন্ন চসিক নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। শনিবার রাতে সাক্ষাৎকার শেষে এই দলীয় মনোনয়ন ঘোষণা করা হয়।
মনোনয়নের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর চট্টগ্রামের তৃণমূল আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ-সংগঠনের নেতাকর্মীরা অনেকটা বিস্মিত হন। অনেকের ধারণা বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে মূলত একজন পরিচ্ছন্ন রাজনীতিবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ডা. রেজাউল করিম চৌধুরীকে দলের প্রার্থী হিসেবে বেছে নিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নেতাকর্মীদের মতে, রেজাউল করিম চৌধুরী ছাত্রজীবন থেকেই ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। ১৯৬৯-১৯৭০ সালে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সমপাদক ও ১৯৭০-১৯৭১ সালে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সমপাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ছাত্রাবস্থায় তিনি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহন করেন। ১নং সেক্টরের বিএলএফ এর মাধ্যমে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন। ১৯৭৩-১৯৭৫ সালে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সমপাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন রেজাউল করিম চৌধুরী। পড়াশোনার জন্যে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে। কিন্তু ৭৫ এর পট পরিবর্তনের কারণে সামরিক দুঃশাসনের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ লড়াইয়ে নেমে ফাইনাল পরিক্ষা দিতে পারেননি তিনি। পরে ১৯৮০ সালে চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৭-২০০৬ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা বিষয়ক সমপাদক, ২০০৬-২০১৪ সালে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সমপাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। বর্তমানে তিনি নগর আওয়ামী লীগের সিনিয়র যুগ্ম-সাধারণ সমপাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। ১৯৫৩ সালে তিনি চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার পূর্ব ষোলশহর ওয়ার্ডের ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন জমিদার বংশ বহরদার পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মরহুম হারুন-অর-রশীদ চৌধুরী ছিলেন একজন উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও দাদা ছালেহ আহমদ ছিলেন ইংরেজ শাসিত ভারত এবং পাকিস্তান আমলে চট্টগ্রামের একজন খ্যাতিমান আইনজীবী ও চট্টগ্রামে ব্রিটিশ আমলে প্রতিষ্ঠিত বিলুপ্ত কমরেড ব্যাংকের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি পাকিস্তান আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
তার বড় ভাই অধ্যাপক সুলতানুল আলম চৌধুরী ছিলেন একজন রাজনীতিবিদ। তিনি ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া তার পূর্ব পুরুষেরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ২৩টি মসজিদ প্রতিষ্ঠাসহ অসংখ্য জনকল্যাণমূলক কাজ করেছেন। পারিবারিক জীবনে দুই মেয়ে ও এক ছেলে সন্তানের জনক রেজাউল করিম। তার বড় মেয়ে তানজিনা শারমিন নিপুন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন। আর বর্তমান মেয়র আ জ ম নাছিরের জন্য সবচেয়ে বড় বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে সামপ্রতিক সময়ে মীরসরাই থেকে উঠে আসা এক রাজনৈতিকের সখ্যতা। যা আ জ ম নাছিরের ইমেজে বড় ধরনের প্রভাব ফেলেছে বলে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।
বিশ্লেষকদের মতে, আ জ ম নাছির উদ্দিন এবার মনোনয়ন পাবেন না এমন খবর আগে থেকেই পাওয়া যাচ্ছিলো। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেও আ জ ম নাছির প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যক্তিগত সাক্ষাত করতে ব্যর্থ হন। এছাড়া চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নাছির বিরোধী বলয়ের শক্তিশালি প্রচারণা আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচনে প্রভাব ফেলেছে। এদিকে আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী মনোনয়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সমপাদক আ জ ম নাছির উদ্দিন।
একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম রেজাউল করিম চৌধুরীকেও অভিনন্দন জানান মেয়র। মেয়র নাছিরউদ্দিন প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তকে দূরদর্শী ও সমযোপযোগী উল্লেখ করে বলেন, মেয়র নির্বাচনের জন্য তিনি রাজনীতির একজন তৃণমূল কর্মীকেই বেছে নিয়েছেন। তাঁর সিদ্ধান্তে রাজনীতি রাজনীতির হাতেই থাকলো। এর মধ্যদিয়ে তৃণমূলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা নতুন করে আশাবাদী হয়ে ওঠবে বলেও মেয়র মন্তব্য করেন। বলেন, আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী এম. রেজাউল করিম চৌধুরী একজন সৎ ও যোগ্য প্রাথী। তার জয়লাভ সুনিশ্চিত করার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগ ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে চট্টগ্রামের মেয়র পদটি উপহার দেওয়াই হবে এখন আমাদের প্রধান লক্ষ্য। এজন্য সকল মতভেদ ভুলে দলীয় নেতাকর্মীদের এক কাতারে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।