চট্টগ্রাম: পুলিশও কাঁদে! এমন শিরোনামে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়েছে ফেসবুকে। অসংখ্য বন্ধুদের শেয়ার করা এ ভিডিওতে লাইক কমেন্টসও পড়েছে অনেক। যেখানে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে সাধুবাদ জানিয়েছেন ফেসবুক বন্ধুরা।
ভিডিওটিতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের মানবিক পুলিশ শাখার টিম লিডার মুহাম্মদ শওকত হোসেনের। তার বাড়ি নোয়াখালী জেলার কবিরহাটে। ভিডিওতে তিনি তার ব্যক্তিগত জীবন ও অসহায় মানুষের দুঃখ-দুর্দশার কথা তুলে ধরে কান্না করেন।
শওকত হোসেন জানান, ২০০৫ সালে ২৪তম ব্যাচে পুলিশের কনস্টেবল হিসেবে যোগ দেন তিনি। তখন তার মূল বেতন ছিল ২ হাজার ৮৫০ টাকা। সব মিলিয়ে বেতন পেতেন ৫ হাজার টাকা। ওইসময় আর্থিক অনটনে ছিলেন তিনি।
বর্তমানে ২৫ হাজার টাকার মতো বেতন পান তিনি।
তবে ব্যক্তি জীবনে চাকরির সব বেতন তিনি অসহায় মানুষের সেবায় খরচ করেছেন। এ সময়ে নতুন একটি শার্ট কিনে পরেননি। অসহায় মানুষের জন্য বলে বন্ধুদের কাছ থেকে চাওয়া জামা-কাপড় পরতেন। নিজের বেতনের টাকায় অসহায় মানুষকে কাপড় চোপড় কিনে দিতেন। বহু অনুষ্ঠানে সহকর্মী বন্ধুর শার্ট গায়ে দিয়ে গেছেন। শেরওয়ানি ভাড়া করে বিয়ে করেছেন। বিয়ের পর বউয়ের কক্সবাজার যাওয়ার আবদার পূরণ করতে পারেননি এখনো।
শওকত হোসেন বলেন, ২০০৫ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত আমি ঢাকায় কর্মরত ছিলাম। এরপর কিছুদিন রাঙ্গামাটিতে ছিলাম। সেখান থেকে বদলি হয়ে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশে আসি। সেখান থেকে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষার অধীনে মেডিকেলে তিন বছরের ডিপ্লোমা ও দুই বছরের প্যারা মেডিকেলের বিষয়ে লেখাপড়া করি। ফলে চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে ওটি ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব পাই। আমার দায়িত্ব ছিল রাঙ্গামাটি থেকে আসা আহত পুলিশ সদস্যের সেবা দেয়া। তখন থেকে রোগীর সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠে আমার।
শওকত হোসেন নিজের জীবনের স্মরণীয় মুহূর্তের ঘটনা তুলে ধরে বলেন, রাস্তার ধারে ডাস্টবিনে পড়ে থাকা অজ্ঞাত ভারসাম্যহীন এক অসুস্থ রোগীকে চিকিৎসার জন্য নিজ খরচে নিজেই ভ্যান গাড়িতে তুলে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই। কিন্তু হাসপাতালেও তাকে ভর্তি করাতে চাননি কেউ। সেবা দিতে চাননি নার্স-আয়া কেউ। কারণ তার পা ও ডান হাতে পঁচন ধরেছিল। সেখানে পোকায় কিলবিল করছিল। দুর্গন্ধ বের হচ্ছিল। তবুও পুলিশ হিসেবে ভয়ে ভর্তি করানো হয় ২৭ নং ওয়ার্ডে। কিন্তু একদিন পর খুঁজতে গিয়ে দেখা যায় ওই ওয়ার্ডে নেই রোগীটি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর হাসপাতালের ডাস্টবিনের পাশে দেখতে পাই সেই রোগীকে।
একপর্যায়ে সিদ্ধান্ত নিলাম নিজেই সেবা-শুশ্রƒষা, চিকিৎসা ও সার্জারি করবো। প্রয়োজনীয় উপকরণ কিনে পায়ের পাতা থেকে চার ইঞ্চি উপর পর্যন্ত পোকায় ধরা পচে যাওয়া মাংস কেটে ফেলা শুরু করি। নিজে গিয়ে ওষুধ খাইয়ে কয়েকদিন পর যখন উন্নতি দেখি, তখন নিজ কর্মস্থলের বিভাগীয় চিকিৎসককে বলে প্রায় তিন মাস চিকিৎসা করানো হয়। একপর্যায়ে সুস্থ হয়ে উঠেন ওই রোগী। যিনি এখন চট্টগ্রামের বদনা শাহ মাজারে ভিক্ষা করে জীবনযাপন করছেন। এরমাঝেও তাকে দেখতে যাই আমি। নিজ হাতে খাবার খাওয়ায়।
একবার সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত এক শিশুকে বাঁচাতে মধ্যরাতে ঘর থেকে বেরিয়ে নগরীর বেসরকারি হাসপাতালে আইসিইউ’র ব্যবস্থা করি। যার বিল পরিশোধ করতে গিয়ে নিজ গ্রামে থাকা দুটি ফার্মেসির দোকান বিক্রি করে দেই আমি।
এমনকি বিয়ের জন্য মেয়ে দেখার দিনেও সড়ক দুর্ঘটনায় আহত পরিবারের মা-বাবা ও ছেলেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করাতে গিয়ে সময়মতো পৌঁছাতে পারিনি। কোনোরকমে বিয়ে করলেও এখনো পর্যন্ত বউয়ের কক্সবাজার যাওয়ার আবদার পূরণ করতে পারিনি।
নিজের ছোট বোনের অপারেশনের সময়ও আরেক শিশুর সেবা শুশ্রƒষা করতে গিয়ে উপস্থিত থাকতে পারিনি। এ কারণে মা-বাবার অনেক বকাঝকা শুনতে হয়েছে। তবে তার সহধর্মিণী তাকে বোঝেন এমনটাই জানিয়েছেন শওকত।
শওকত বলেন, রাস্তার পাশে পড়ে থাকা রোগী, যাদের শরীর থেকে ছড়াতো উৎকট গন্ধ, এমন মানুষের পাশে কেউ যেতেন না। আমি মনে করতাম, এই মানুষটি তো আমার ভাই হতে পারতো। এই ভেবে নিজে উদ্যোগী হয়ে অসুস্থ রোগীদের হাসপাতালে এনে সুস্থ করে তুলতাম।
তিনি বলেন, প্রায় সময় এমন রোগী পেতাম কারও হাত, কারও পা ও কারও মুখ পচে গেছে। এসব রোগীর শরীর থেকে পোকাও বের হচ্ছে। এমন রোগীকে হাসপাতালে নিয়ে যেতাম। নিজের টাকায় কয়েক সেট কাপড় কিনে তাদের পড়াতাম। সেই কাপড়ে প্র¯্রাব, পায়খানা করলে কাপড়টি বদলিয়ে নতুন কাপড় পরাতাম নিজ হাতে। এভাবে সুস্থ করে তুলতাম।
শওকত বলেন, শত শত রোগীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে নিজের বেশির ভাগ টাকা চলে যাওয়ায় ১০ বছরে নতুন কোনো পোশাক কিনিনি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যেতাম সহকর্মীর পোশাক পরে। পরিচিতজনকে বলতাম, আমার কিছু গরিব মানুষের জন্য কাপড় চোপড় দরকার। তখন তারা যে কাপড়গুলো দিতো, তা থেকে অসুস্থ রোগীকে দিতাম, নিজেও পরতাম।