ঢাকা: পাবলিক পরীক্ষায় একশ্রেণির শিক্ষকের কর্তব্যকর্মে অবহেলা ও গাফিলতির কারণে বড় ধরনের মাশুল দিতে হচ্ছে পরীক্ষার্থীদের। প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে পুরো পরীক্ষা ব্যবস্থাপনা। বাজারে নিষিদ্ধ নোট-গাইড বই থেকে প্রশ্ন করছেন শিক্ষকরা। পরীক্ষার হলে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের মধ্যে সরবরাহ করছেন অনিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পুরোনো সিলেবাসের প্রশ্ন। পরীক্ষার সময়ও ইচ্ছানুযায়ী বাড়াচ্ছেন বা কমাচ্ছেন তারা।
এ ছাড়া পরীক্ষার হলে ইচ্ছাকৃতভাবে খাতা বা প্রশ্ন বিতরণে দেরি এবং দায়িত্ব পালন বা পরিদর্শনের সময় উচ্চ স্বরে নিজেদের মধ্যে গল্প করা ছাড়াও কেন্দ্রে মোবাইল ফোন নিয়ে আসার মতো গর্হিত অপরাধ করছেন শিক্ষকরা। কোথাও কোথাও পরীক্ষার হলে নৈর্ব্যক্তিক অংশের প্রশ্নের উত্তর বলে দেওয়ার মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও ঘটিয়েছেন তারা।
চলমান এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণের ঘটনায় পরীক্ষার্থী ও অভিভাবকরা ক্ষুব্ধ হন। ২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষার সময়ও একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল। সমালোচনার মুখে বিভিন্ন শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, নির্দিষ্ট খাতাগুলো চিহ্নিত করে রাখা হয়েছে। সেগুলো বিশেষভাবে দেখা হবে। কোনোভাবেই পরীক্ষার্থীদের ক্ষতি হবে না। তবে একাধিক শিক্ষা বোর্ডের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভুল ধরা পড়লেই কেবল সেসব খাতা চিহ্নিত করে রাখা হয়। কিন্তু ভুল ধরা না পড়লে বা শিক্ষকরা সেগুলো বোর্ডের নজরে না আনলে খাতা আলাদা করে রাখা সম্ভব হয় না। এতে পরীক্ষার্থীরা চড়া মূল্য দেয়।
বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন ‘বাংলাদেশ পরীক্ষা উন্নয়ন ইউনিটের’ (বেডু) ঊর্ধ্বতন বিশেষজ্ঞ (পরীক্ষা ও মূল্যায়ন) রবিউল কবির চৌধুরী বলেন, একটি সফল পরীক্ষা সম্পন্ন করার দুটি অংশ রয়েছে। প্রথমটি প্রশাসনিক, দ্বিতীয়টি গুণগত মান। ভুল প্রশ্ন সরবরাহের ঘটনা পরীক্ষার ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্ত। এটি সংশ্নিষ্ট শিক্ষকদের গুরুতর অবহেলাজনিত ঘটনা। এটির সঙ্গে মূল্যবোধও জড়িত। তিনি বলেন, বেডু থেকে তারা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এসব সমস্যা সমাধানের আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। ট্রেনিং ম্যানুয়ালেও সবকিছু দেওয়া আছে। প্রশিক্ষণে যা শেখানো হচ্ছে, তার বাস্তব প্রতিফলন কর্তব্যকর্মে যদি না ঘটে, তার দায় প্রশিক্ষণার্থীর; প্রশিক্ষণের নয়।
এসএসসির প্রথম দিন গত ৩ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে অনুষ্ঠিত হয় বাংলা প্রথম পত্রের পরীক্ষা। সেদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে পরীক্ষার হলে শিক্ষকদের অবহেলায় ২০১৮ সালের পুরোনো সিলেবাসের প্রশ্নপত্র বিতরণের খবর পাওয়া যায়। কয়েকটি কেন্দ্রে ভুল ধরা পড়ার পর অবশ্য প্রশ্ন বদলে নতুন প্রশ্ন দেওয়া হয়। বরিশাল নগরীর হালিমা খাতুন বালিকা বিদ্যালয় কেন্দ্রের দুটি কক্ষে অর্ধশতাধিক পরীক্ষার্থীর পরীক্ষা ভুল প্রশ্নে নেওয়া হয়।
এ দুটি কক্ষে ছিল নগরীর জগদীশ সরস্বতী বালিকা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পরীক্ষার্থীরা। তারা সবাই এখন ফল বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছে। পরীক্ষার পর এ খবর জানাজানি হলে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. ইউনুস কেন্দ্র পরিদর্শন করে এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন। তিনি বলেন, পুরোনো প্রশ্নপত্রে পরীক্ষা নেওয়ার ঘটনায় কেন্দ্র সচিবসহ সংশ্নিষ্ট সবার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ঘটনার শিকার শিক্ষার্থীরা যাতে তাদের প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত না হয়, তাও দেখবে বোর্ড কর্তৃপক্ষ। এ বিষয়ে একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করে বোর্ড কর্তৃপক্ষ।
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রেও এসএসসি পরীক্ষার প্রথম দিন বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় শিক্ষকদের উদাসীনতার কারণে ২০১৮ সালের সিলেবাসের প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা শুরু হয়। প্রায় ৩০ মিনিট পরীক্ষা চলার পর ভুল প্রশ্নপত্র সরবরাহের বিষয় নজরে এলে পরীক্ষার্থীদের কাছ থেকে ২০১৮ সালের সিলেবাসের প্রশ্ন তুলে নিয়ে ২০২০ সালের প্রশ্নপত্র সরবরাহ করা হয়।
ঠাকুরগাঁও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রেও বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষায় ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র দিয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। আধঘণ্টা পর প্রশ্নপত্র পরিবর্তন করে পরীক্ষার সময় বাড়িয়ে পরীক্ষা নেওয়া হয়। ঠাকুরগাঁও বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক ও কেন্দ্র সচিব সালেহা খাতুন বলেন, অসাবধানতাবশত কয়েকটি কক্ষে ২০১৮ সালের প্রশ্নপত্র গেলেও সমস্যার দ্রুত সমাধান করা হয়।
২০১৯ সালের এসএসসি পরীক্ষায়ও কয়েকটি স্থানে এমন ঘটনা ঘটে। তখন সব শিক্ষা বোর্ড থেকে নতুন ও পুরোনো সিলেবাসের পরীক্ষার্থীদের আলাদা কক্ষে বসানোর নির্দেশ দেওয়া হয় কেন্দ্র সচিবদের প্রতি। তবে এ বছর তারা এ নির্দেশ মানেননি। বাধ্য হয়ে বোর্ড কর্তৃপক্ষ এ বছর আবারও একই নির্দেশের পুনরাবৃত্তি করেছে।
এ বিষয়ে আন্তঃশিক্ষা বোর্ড সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল কবির বলেন, যারা আদেশ মানেননি, তাদের শনাক্ত করা খুব কঠিন। সারাদেশে সাড়ে তিন হাজার পরীক্ষা কেন্দ্রে পরীক্ষা চলছে। তবে ভুল প্রশ্ন বিতরণ করে এবার যারা চিহ্নিত হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রশাসনিক অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ঢাকা বোর্ডের বাংলা প্রশ্নে গাইড বই থেকে প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন বরিশালের বাকেরগঞ্জের শিক্ষক নাজনীন আক্তার। তাকে বরিশাল শিক্ষা বোর্ড কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে কারণ দর্শাও নোটিশ দিয়েছে।
ঢাকা বোর্ড চেয়ারম্যান বলেন, ভুল প্রশ্ন বিতরণ থেকে রক্ষা পেতে আগামী এইচএসসি পরীক্ষা থেকে পুরোনো সিলেবাসের শিক্ষার্থীদের আলাদা ‘ডিজিটাল রোল নম্বর’ দেওয়া হবে। এতে তাদের চিহ্নিত করা সহজ হবে।
সার্বিক বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেন, ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়া কোনো পরীক্ষার্থীরই ক্ষতি হবে না। এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার সেসব খাতা শনাক্ত করে আলাদা রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। বিশেষভাবে তা মূল্যায়ন করা হবে। তিনি বলেন, সারাদেশে ৫২ হাজার কক্ষে এসএসসি ও সমমান পরীক্ষা আয়োজন করা হচ্ছে। তার মধ্যে ১৫টি কক্ষে ভুল প্রশ্নপত্র বিতরণ করা হয়েছে। পরীক্ষার প্রথম দিন প্রশ্নপত্র বিতরণ করতে ভুল হওয়ার ঘটনা ঘটেছে।
শিক্ষামন্ত্রী বলেন, যদিও নিয়মিত ও অনিয়মিত পরীক্ষার্থীদের প্রশ্ন বিতরণ করার আগে তা আলাদা করা শিক্ষকদের দায়িত্ব, পরীক্ষার্থীরাও প্রশ্ন পাওয়ার পর একনজর তা দেখে নিলে এই ভুল ধরা পড়ে। কিন্তু এটি পরীক্ষার হলে দায়িত্বরত শিক্ষকেরই দায়। তাদেরই ভালোভাবে দেখে প্রশ্নপত্র বিতরণ করার কথা। তিনি বলেন, এমন ভুল কেউ অমনোযোগী হয়ে করেছে, নাকি তা নিছক ভুলেই হয়েছে- তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। কোনো শিক্ষকের ভুল শনাক্ত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ভুল প্রশ্নে পরীক্ষা দেওয়া কোনো পরীক্ষার্থীরই ক্ষতি হবে না। সেসব খাতা বিশেষভাবে মূল্যায়ন করা হবে।
এসএসসি পরীক্ষায় গাইড বই থেকে হুবহু পরীক্ষার প্রশ্ন করার বিষয়ে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, এবার এসএসসি ও সমমান পরীক্ষার জন্য প্রায় ছয় হাজার সেট প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। তার মধ্য থেকে নির্বাচন করে দুই হাজার ৮৯০ সেট প্রশ্নপত্র ছাপানো হয়েছে। এ জন্য অনেক মডারেটর কাজ করেছেন। কে ভুল করেছে, তাৎক্ষণিক সে বিষয়টি শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তিনি বলেন, গাইড বইয়ের অনেক প্রশ্ন কমন পড়তে পারে, তবে তা হুবহু মিলতে পারে না। তাই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। অপরাধ শনাক্ত করার পর সংশ্নিষ্ট শিক্ষকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।