টঙ্গী: বাংলাদেশে তাবলিগ জামাতের চলমান বিরোধের কারণে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হচ্ছে। বিদেশী তাবলিগ সাথীরা এখন বাংলাদেশে আসতে আগের মতো আর আগ্রহী নন। বিশ্ব ইজতেমায় বিদেশী তাবলিগ সাথীদের কাক্সিক্ষত জমায়েত হচ্ছে না। মসজিদ থেকে বের করে দেয়ার মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না এবং কোনো ধরনের হাঙ্গামা হবে না- বাংলাদেশে আসার আগে তারা এমন নিশ্চয়তা চাচ্ছেন। দ্বিতীয় পর্বের ইজতেমায় হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমির ও ইসলামী ঐক্যজোটের সাবেক চেয়ারম্যান মুফতি ইজহারুল ইসলাম চৌধুরী এসব কথা জানান।
মুফতি ইজহার বলেন, একটা স্যরি বললেই যদি সমাজে বড় বড় অপরাধ ক্ষমা হয়ে যায়, সেখানে মাওলানা সা’দ সাহেব আনুষ্ঠানিকভাবে চারবার লিখিত প্রত্যাহারনামা পাঠালেন, তিনবার বড় বড় সমাবেশে বললেন, আমার বক্তব্য প্রত্যাহার করলাম। তারপরও কি আমাদের বাংলাদেশের ওলামায়ে কেরাম তাকে রেহাই দেবে না? ইজহার বলেন, ওলামা ও মসজিদ-মাদরাসা তো ভারত পাকিস্তানেও আছে। লাখ লাখ ওলামা, হাজার হাজার মাদরাসা আছে। তারা কি এ ধরনের হাঙ্গামা করে মসজিদ থেকে কাউকে বের করে দেন? নিজামুদ্দিনের অনুসারীদেরকে কেউ কি মসজিদ থেকে বের করে দিয়েছে?
মুফতি ইজহার বলেন, বাংলাদেশ ভৌগোলিকভাবে একটি ছোট্ট মুসলিম রাষ্ট্র। এ দেশকে বিশ্বের মানুষ তেমন চিনত না। বিগত ৫০ বছরে তাবলিগের এ মোবারক মেহনতের কারণে সারা পৃথিবীতে পরিচিতি লাভ করে বাংলাদেশ। আমেরিকা, ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, জার্মানি, রাশিয়াসহ সারা বিশ্বের অসংখ্য মুসলমান এখানে আসতেন। সারা দুনিয়া একযোগে জানতো, টঙ্গী মানেই বিশ্ব ইজতেমা। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তাবলিগ জামাতের আজকের এই চলমান বিরোধের কারণে বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা তলানিতে এসে ঠেকেছে।
মুফতি ইজহার আরো বলেন, বাংলাদেশে আলেম সমাজের শীর্ষ আলেম হেফাজতপ্রধান হাটহাজারি মাদরাসার প্রিন্সিপাল আল্লামা আহমদ শফী আমার ওস্তাদ। তার রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক যেকোনো বিষয়ে আমি তার বড় খাদেম ছিলাম। আমি হেফাজতে ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা নায়েবে আমির হিসেবে যেকোনো আপদে-বিপদে আমি তার পাশে দাঁড়িয়েছি। তিনি ইচ্ছা করলে উভয়পক্ষকে ডেকে তিন দিনের মধ্যেই তবলিগের এই বিরোধটা মিটিয়ে দিতে পারতেন।
ইজহার বলেন, আমি যখন পৃথিবীর শীর্ষ ওলামাদের চিঠি নিয়ে তার (হেফাজত আমির) সাথে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলাম তখন তিনি আমাকে চিনতে অস্বীকার করেন। এমনকি আমার নিয়ে যাওয়া চিঠিরও কোনো মূল্যায়ন করেননি। তিনি ইচ্ছা করলে মুরব্বি হিসেবে বিষয়টির সমাধান করতে পারতেন। কিন্তু তা না করায় বিরোধটি রয়েই গেছে।
মাওলানা সা’দ সম্পর্কিত বিতর্ক নিয়ে মুফতি ইজহার বলেন, গত আগস্ট মাসের শেষে আমরা বাংলাদেশের প্রায় ২৫ হাজার পুরাতন তাবলিগ সাথী, জিম্মাদার, দায়িত্বশীল দিল্লির নিজামুদ্দিনে গিয়েছিলাম। ওখান থেকে পরামর্শসাপেক্ষে তিন শতাধিক সাথী নিয়ে আমি দেওবন্দ মাদরাসায় যাই। অনেক দায়িত্বশীল তখন আমার সাথে ছিলেন। আমি দেওবন্দের অনেকের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। দেওবন্দ মাদরাসার প্রিন্সিপাল হজরত আবুল কাসেম নোমানীসহ অনেক শীর্ষ আলেমের সাথে সাক্ষাৎ করেছি। তারা বলেছেন, দেওবন্দ কোনো দিন বলেনি, মাওলানা সা’দ সাহেব গোমরাহ হয়েছেন। বরং তারা বলেছেন, তার (সা’দ) কোনো কোনো বিষয়ে ওনাদের দ্বিমত আছে। এর বাইরে তারা কিছু বলেননি। এরপরও মাওলানা সা’দ সাহেব চারটা লিখিত প্রত্যাহারনামাপত্র দেওবন্দে পাঠিয়েছেন। এমনকি তিনটি বড় বড় সমাবেশে মাওলানা সা’দ সাহেব প্রকাশ্যে বলেছেন, ‘আমার কোনো বক্তব্য নিয়ে যদি শীর্ষ আলেমদের কোনো আপত্তি বা অভিযোগ থাকে তাহলে আমি তা প্রত্যাহার করে নিলাম।’
মুফতি ইজহার নিজের সম্পর্কে বলেন, আমি বড় উত্তাল তরঙ্গের রাজনৈতিক কর্মী ছিলাম। কোনো ধরনের প্রতিপক্ষ বা প্রতিপক্ষের কোনো কর্মী সে যত বড় সন্ত্রাসীই হোক বাংলাদেশের ইতিহাসে রেকর্ড নেই আমার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আফসোস; আমার নিজ এলাকার মসজিদে দা-লাঠি নিয়ে ঢুকে আমাদের ওপর হামলা চালানো হলো। সাথীদেরকে আহত করে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়া হলো। আজকে কোথা থেকে তারা এত বড় দুঃসাহস পেল তাবলিগের মুরব্বিদের গায়ে হাত দেয়ার। এসব নোংরামি তারা কোথায় পেয়েছে? আজকে দুঃখ ও আফসোস হয়, আমাদের মুরব্বিরা এসব নিয়ে কিছু বলেন না। তিনি বলেন, যারা নিজামুদ্দিনকে মানে তারা আলেমদের ব্যাপারে কোনো বিরূপ মন্তব্য বা কোনো হাঙ্গামা করেছে, মসজিদ থেকে কাউকে বের করে দিয়েছে এমন দৃষ্টান্ত কেউ দেখাতে পারবেন না।
মুফতি ইজহার প্রত্যয় ব্যক্ত করে বলেন, আমরা এখনো হতাশ নই। তারা যদি আলোচনা করতে চান, তাবলিগের মুরব্বিদের সাথে বসতে চান, আমরাও রাজি আছি। মুসলিম উম্মার স্বার্থে এই বিরোধ মিটে যাওয়া উচিত। আজকে সারা দুনিয়াতে মুসলমানদের যেখানে দুর্দশা চলছে সেখানে এ ধরনের বিরোধ জিইয়ে রাখা কোনো মুসলমানের কাম্য হতে পারে না। তিনি বলেন, এই অস্থির বিশ্বে কত ইস্যু বাংলাদেশে ও বাংলাদেশের বাইরে আছে সেসব বিষয়ে কথা না বলে আমরা পরস্পর বিরোধে জড়িয়ে যাচ্ছি।
মুফতি ইজহার বলেন, গ্রামেগঞ্জে মহল্লায় কত হাজারো লাখো যুবক বিপদগামী ছিল, নামাজ পড়ত না, নারী উত্ত্যক্ত করত, আরো কত লাইনে বিপদগামী ছিল। আজকে তাবলিগের মেহনত দ্বারা হাজার হাজার, লাখ লাখ ছেলে হেদায়েত পেয়েছে। আজকে তাদেরকে দেখলে মাদরাসার ছাত্রদের মতো মনে হয়। তাবলিগের বদৌলতে অনেক ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছাত্রকেও দেখতে আলেম-ওলামার মতো মনে হয়।
সৌজন্যে ; দৈনিক নয়া দিগন্ত