প্যারিস (ফ্রান্স) থেকে নজমুল কবির: তার শান্ত স্বভাব, স্বল্প এবং মৃদুভাষী বৈশিষ্ট্যের কারনে সমষ্টির মাঝেও সে আলাদা। তাকে আলাদা করে চিনবার আরো কিছু বিশেষন দেবার আছে। সে একজন নিঃস্বার্থ পরোপকারী। সময়ানুবর্তিতা আর কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীলতা তার জীবনবোধে শক্তভাবেই ক্রিয়াশীল।
কৈশোরের দূরন্তপনার মাঝেই বাবার সুবাদে মায়ের হাত ধরে ফ্রান্সে আসা। এদেশে পড়াশুনা করে, ব্রিলিয়ান্ট রেজাল্ট করেও বাংলাদেশী বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত অন্যান্যদের মত ফরাসী সেজে বসেনি। ফরাসী স্ট্যান্ডার্ড বজায় রেখেও তাই তাকে দেখা যায় বাংলাদেশী কমিউনিটিতে তার মিশে যেতে। তিনি নয়ন এনকে। বাংলাদেশ থেকে দশ বছর বয়সে বাবা মায়ের সাথে আসা বালক নয়ন এখন ফ্রান্সের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক। ফরাসী ভাষায় বলে ‘Enseignant’. এবছরই মাস্টার্স শেষ করে তিনি শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছেন এমাসেই। তার কাছে এসেছে, আসছে! অন্যদিকেও তার ব্যস্ততা রয়েছে। ফ্রান্সের সরকারী বিভিন্ন শাখায় যেমন, OFII, OFPRA, Préfecture, Hôpital প্রভৃতি স্থানে দোভাষী হিসেবে কাজ করেন।
নয়ন তার বাবার সূত্রে মা এবং আরো দুই ভাইবোনের সাথে ফ্রান্স আসেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে নয়ন সবার ছোট। বড় বোন প্যারিসের একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাশন ডিজাইনের ওপর সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভ করেন। ভাই Université d’EVRY থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পাস করে EROP নামে একটি প্রতিষ্ঠানে Concepteur Industriel হিসেবে কর্মরত আছেন।
মানিকগঞ্জের সন্তান নয়ন, ডাবল মাস্টার্স সম্পন্ন করেছে। নয়ন কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরন করেন তার মামা সাত্তার ফরাজীকে যিনি প্যারিসে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে কাজ করেন। নয়ন জানান, তাদের ভাই-বোন সকলের পড়াশুনায় ভাল ফলাফলের পেছনে তার মামার অনুপ্রেরণা, উপদেশ এবং উৎসাহ বিরাট ভূমিকা রেখেছে। নয়ন আরো কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন তার ভগ্নিপতি ফয়সাল আহমেদ সেতুর প্রতি। সর্বোপরি তার বাবা মায়ের প্রতি তার অশেষ কৃতজ্ঞতা আজকের এই অবস্থানে আসবার জন্য।
নয়নের এর অন্য একটি জগৎ আছে। ফ্রান্সের আলো বাতাসে বড় হয়ে এবং উচ্চশিক্ষা লাভ করেও বাঙালী কমিউনিটিকে নিজের অস্তিত্বের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারেনি। এই বৈশিষ্ট্যটি তাকে অন্যান্য শেকড়বিচ্ছিন্ন প্রবাসী সন্তানদের থেকে আলাদা করেই চেনা যায়। বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত হয়েও তারা কমিউনিটিতে ভুল করেও পা রাখে না। তাদের চিনিয়ে না দিলে কেউ চিনবে বলেও মনে হয় না। সেই দিক থেকে এই নিরহংকারী মানুষটি বিবেকতাড়িত হয়ে এবং দায়বদ্ধতার উপলব্ধির থেকেই তিনি কমিউনিটিতে তার সময় এবং শ্রম ঢেলে দিয়ে চলেছেন।
নয়ন নিজেই একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন দাড় করিয়েছেন ২০১৫ সালে। France Association of ChildEduc Bangladesh নামের এই সংস্থাটি ফরাসী সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষের থেকে নিবন্ধনকৃত। কেন তিনি এমন একটি সংগঠন গড়ে তুললেন, এমন প্রশ্নে তিনি স্মৃতিমন্থন করে জানালেন, ২০১০ সালে বোনের বিয়েতে দেশে গিয়েছিলেন। সেসময়ে তিনি দেখতে পান একটি রেস্টুরেন্টে কিশোর বয়সীরা কাজ করছে! এ বয়সে তো তাদের স্কুলে শিক্ষা নেবার কথা। কেন তারা তা না করে কাজ করছে! তার কিশোর মনে প্রবলভাবে নাড়া দেয়। তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেন, এই সব খেটে খাওয়া কিশোরদের জন্য তার কিছু একটা করতেই হবে। তারা যাতে অন্ততঃ শিক্ষাবঞ্চিত না হয়। সেই উপলব্ধির থেকেই একটি সংগঠন গড়ে তোলা। ২০১৬ সালে এই সংস্থার মাধ্যমে তিনি মানিকগঞ্জে ৮ টি স্কুলে ৬২০ জন মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীকে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করেন।
নয়ন ২০১৭ সালে বাংলাদেশ কমিউনিটি ইন ফ্রান্স (বিসিএফ) এর সাথে যুক্ত হন। বিসিএফ ফ্রান্সের প্রধানতম সংগঠনগুলোর একটি যারা বাংলাদেশ কমিউনিটির নানা সমস্যা সমাধানে এবং কল্যাণে কাজ করছে। নয়ন এই সংগঠনেরই একজন সক্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। ফ্রান্সে বেড়ে ওঠা বাংলাদেশী জেনারেশন, যারা তার বাবা মায়ের সূত্রে এদেশে বড় হয়, তারা বাংলাদেশ কমিউনিটিকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু নয়নকে দেখা যায় স্রোতের বিপরীতে! তিনি জানান, বিসিএফ নিরলস এবং নিঃস্বার্থভাবে কমিউনিটির নানা সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। আমি এমন একটি প্লাটফর্মই চেয়েছি। উল্লেখ্য, নয়ন এবং আকাশ হেলাল – এই দুজন এদেশে পড়াশুনা করেও বিসিএফ এর সাথে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে এবং তারা দুজনই বিসিএফ এর এক্সিকিউটিভ মেম্বার। নয়ন বিসিএফ এর প্রশাসনিক এবং আকাশ হেলাল আইনগত দিকটি দেখভাল করেন।
নয়ন বিসিএফকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখেন তার নিজস্ব সংস্থাটি নিয়েও। নয়নদের মত বাংলাদেশী কিম্বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফরাসীরা যত শেকড়সন্ধানী হবে, নাড়ীর টান অনুভব করবে, কমিউনিটির জন্য ততই মঙ্গল।
বাঙ্গালী বাবা-মায়ের সূত্রে এদেশে জন্মে বড় হয়ে, শিক্ষা নিয়ে কোন একটা কাজে ঢুকে পড়ে। ব্যাস, কাজ আর নিজ ভূবন – এই নিয়েই তার জীবন! বাংলাদেশ কমিউনিটি এই সন্তানদের কাছে একটি অপার বিস্ময় আর তাচ্ছিল্যের নাম। নয়নদের মত হাতে গোনা ২/৪ জনই এই কমিউনিটিকে উপেক্ষা করতে পারে না। ভাবতেও পারে না।
বাংলাদেশী বা বাংলাদেশী বংশোদ্ভূত ফরাসীদের পরিচিতিতেও সেই ছাপ, সেই দায়, সেই অরিজিন শনাক্তকরণ চিহ্ন আমরা কি করে লুকাবো? এদেশে আমরা খোদ ফরাসী হবো কী করে? আমাদের পরিচিতিও বাংলাদেশী ফ্রেন্স, আলজেরিয়ান বা আফ্রিকান ফ্রেন্স! এই পরিচয় ঘোচাবার কৃত্রিম নিয়মটি ধোপে টিকবে?
তাই ফরাসী হলেও বাংলাদেশের পরিচয় মুছে ফেলা অসম্ভব। নয়নরা তা জানে। তাই ওরা কমিউনিটিতে আলাদা একটা শান্তি খুঁজে পায়।
আমাদের অন্তর্গত রক্তের ভেতরে খেলা করে’ আমাদেরই পূর্বপুরুষের রক্ত। আমরা তার গর্বিত উত্তরাধিকার। ফ্রান্সে বাংলাদেশ কমিউনিটিকে উপেক্ষা করা তাই বেদনাদায়ক। নয়নরা এটি খুব উপলব্ধি করে। তাই ওরা কমিউনিটিতে এসে নানা সমস্যায় জর্জরিত কমিউনিটির হাত ধরে ওপরে তুলবার অনলস চেষ্টা করে যায়। কমিউনিটির পাশে থাকে, কমিউনিটিকে পাশে রাখে।