ঢাকা: টানা দুই মাস আন্দোলনের পর ২০১৩ সালের ২৫শে ডিসেম্বর দেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলনে করেছিলেন বিরোধী জোট নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। ২৯শে ডিসেম্বর গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’ কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন তিনি। পরদিন থেকেই খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসভবন ও রাজনৈতিক কার্যালয়ে পুলিশি কড়াকড়ি বাড়ানো হয়। ২৬শে ডিসেম্বর রাত ৯টার দিকে গুলশানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে যান খালেদা জিয়া। ওই রাতে ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের একাংশের সভাপতি রুহুল আমিন গাজীর নেতৃত্বে সাংবাদিকদের একটি প্রতিনিধি দল খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। এরপর সাংবাদিকদের প্রতিনিধি দলটি বেরিয়ে যাওয়ার পর একঘণ্টা একাকী কার্যালয়ে কাটিয়ে রাত ১২টায় বাসায় ফেরেন তিনি। ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে কেন্দ্র করে ২৬শে ডিসেম্বর থেকেই নয়াপল্টনের দু’টি প্রবেশমুখেই কাঁটাতারের ব্যারিকেড দেয়া হয়। ২৭শে ডিসেম্বর রাত ৮টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের বাসভবন গুলশান ২-এর ৭৯ নম্বর সড়কের ১ নম্বর বাড়ি ‘ফিরোজা’র সামনের রাস্তার দুদিকে দুটি বালুর ট্রাক দিয়ে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়। বাসার সামনে কয়েক স্তরে বিপুল সংখ্যক আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মোতায়েন করা হয়। খালেদা জিয়ার পুলিশ প্রটোকল প্রত্যাহার করে নেয় সরকার। ওই সময় বাসা থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাকে আটকে দেন। এরপর থেকেই কার্যত গৃহবন্দি হয়ে পড়েন সাবেক তিন বারের প্রধানমন্ত্রী। ২৮শে ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ বলেন, যথসময়েই নয়াপল্টনের মার্চ ফর ডেমোক্রেসিতে উপস্থিত হবেন খালেদা জিয়া। রাত সোয়া ১০টায় রুহুল আমিন গাজী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ ও ইলিয়াস খানসহ ৬ সাংবাদিক নেতা খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওইদিন রাতে আরও ৩টি বালুর ট্রাক খালেদা জিয়ার বাসার সামনের রাস্তার দুইপাশে আড়াআড়িভাবে রাখা হয়। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি ঠেকাতে রাজধানীর প্রতিটি প্রবেশমুখসহ বিভিন্ন জেলায় চৌকি বসায় পুলিশ। পাশাপাশি বিভিন্ন স্টেশনে অবস্থান নিয়ে পাহারা দেয় সরকারদলীয় কর্মী-সমর্থকরা।
২৯শে ডিসেম্বর ‘মার্চ ফর ডেমোক্রেসি’কে কেন্দ্র করে রাজধানীতে সারা দেশে উত্তেচনা ছড়িয়ে পড়ে। রাজধানীজুড়ে কড়া নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। নাইটিঙ্গেল মোড় থেকে ফকিরাপুল মোড় পর্যন্ত প্রতিটি গলিরমুখ কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আটকে দেয়া হয়। কয়েক স্তরে পুলিশ, র্যাব ও সাদা পোশাকধারী গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। পুলিশ ভ্যান, এপিসি ও জলকামানের টহল দেয়া হয়। সকাল থেকেই নয়াপল্টনে যাওয়ার প্রস্তুতি নেন খালেদা জিয়া। বেলা ২টা ৫৩ মিনিটে তিনি বাসা থেকে নিচে নামেন নয়াপল্টনে যাওয়ার জন্য। কিন্তু পুলিশ বাসা থেকে তার গাড়ি বের করতে দেয়নি। গাড়িতে বসে অপেক্ষার পর তিনি নেমে পতাকা হাতে বাসা থেকে বের হতে চান। এতেও বাধা দেয় পুলিশ। দীর্ঘ প্রায় এক ঘণ্টা পুলিশের বাধা উপেক্ষা করে নয়াপল্টনে যাওয়ার চেষ্টা করেন তিনি। ওইসময় দেয়াল টপকে সাংবাদিকরা বাসায় প্রবেশ করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ওপর প্রচণ্ড ক্ষোভ ঝাড়েন খালেদা জিয়া। তিনি বলেন, শেখ হাসিনা রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিচ্ছেন। এই রক্তের গঙ্গার ওপর দিয়ে তিনি তার নৌকায় চড়ে ক্ষমতায় বসবেন। এই আশা দুরাশা। সেটা ভুলে যেতে বলেন। দেখবো কতদিন আটকে রাখতে পারেন। কর্মসূচি চলবে যতদিন এ রকম করা হয়। ওদিকে রাজধানীর মালিবাগ, প্রেস ক্লাব, সুপ্রিম কোর্ট চত্বর ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকার দলীয় লোকজনের সঙ্গে বিরোধী জোটের নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। এতে মালিবাগে পুলিশের গুলিতে এক শিবির কর্মী মারা যান। সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে ৩০শে ডিসেম্বর থেকে সারা দেশে সড়ক, রেলপথ ও নৌপথে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি ঘোষণা বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান মেজর (অব.) হাফিজউদ্দিন আহমেদ। প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে বেরিয়ে যাওয়ার সময় তাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৩০শে ডিসেম্বর দুপুরে সুপ্রিম কোর্টে চত্বরে যুব মহিলা লীগ ও বিএনপি সমর্থিত আইনজীবীদের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও ইট পাটকেল নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে। সন্ধ্যায় অবরুদ্ধ বিএনপি চেয়ারপারসনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন বাংলাদেশে নিযুক্ত বৃটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন। বৈঠক শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান শমসের মবিন চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। রাতেই তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এর আগে দুপুরে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে বিএনপির তিন মহিলা নেত্রী সেলিমা রহমান, রাশেদা বেগম হীরা এমপি ও সাবেক এমপি নেওয়াজ হালিমা আর্লিকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে সন্ধ্যায় ছেড়ে দেয়া হয় তাদের। বিকাল পৌনে ৫টায় বিএনপি চেয়ারপারসনের দুই উপদেষ্টা রিয়াজ রহমান ও সাবিহউদ্দিন আহমেদ খালেদা জিয়ার বাসভবনে গিয়ে সাক্ষাৎ করেন। রাতে বারিধারার বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে ১লা জানুয়ারি থেকে ফের অবরোধের ঘোষণা দেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এড. খন্দকার মাহবুব হোসেন। পরদিন দুপুরেই মাহবুব হোসেনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ৩১শে ডিসেম্বর অবরুদ্ধ খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান ডব্লিউ মজিনা। এসময় সঙ্কট সমাধানে গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খোঁজা উচিত মন্তব্য করে গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত। ১লা জানুয়ারি নিজ বাসভবনে এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান সেলিমা রহমান অভিযোগ করেন, বিরোধী নেতা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে। রাতেই সেলিমা রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ২রা জানুয়ারি গুলশানের নিজ বাসায় অবরোধের চিত্র তুলে ধরে সংবাদ সম্মেলন করেন বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. এম ওসমান ফারুক। এসময় তিনি অভিযোগ করেন, সরকার দেশকে গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। ৩রা জানুয়ারি তৎকালীন বিরোধী দলীয় চিফ হুইপ ও বিএনপির প্রচার সম্পাদক জয়নুল আবদিন ফারুকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল প্রেসিডেন্ট মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এসময় তারা বিএনপি চেয়ারপারসন গ্রেপ্তার না গৃহবন্দি তা পরিষ্কার করার আহ্বান জানান। ৩রা জানুয়ারি অবরোধের তৃতীয় দিন দুর্বৃত্তদের ছোড়া পেট্রল বোমায় দুইজন নিহত ও শতাধিক গাড়িতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। সন্ধ্যায় গুলশানের বাসায় অবরোধের মধ্যেই ৪ঠা জানুয়ারি সকাল ৬টা থেকে ৫ই জানুয়ারি সন্ধ্যা ৬টা ৪৮ ঘণ্টা সর্বাত্মক হরতালের ঘোষণা দেন ড. ওসমান ফারুক। এসময় ৫ই জানুয়ারি একতরফা নির্বাচন বন্ধের পাশাপাশি খালেদা জিয়াকে মুক্তির দাবি জানান তিনি। এদিকে রাতে এক বিবৃতিতে দেশবাসীকে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন বর্জনের আহ্বান জানান খালেদা জিয়া। একইসঙ্গে তাকে গৃহবন্দি করে রাখা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। রাত সাড়ে ৮টায় পুলিশি বাধার কারণে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারেননি নিউ ইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরো চিফ এলেন ব্যারি। ৪ঠা জানুয়ারি বিকালে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার বাসভবনে যাওয়ার চেষ্টা করেন বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট ও হাইকোর্টের জাতীয়তাবাদীপন্থি আইনজীবীরা। কিন্তু পুলিশ তাদের ফিরিয়ে দেয়।
ঢাকা: সন্ধ্যার পর বিরোধী নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তার বাসভবনের সামনে যান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ ও সাবেক সচিব আসাফ্-উদ্দৌলাহ্। তাদেরকেও ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়নি পুলিশ। নির্বাচনের পরদিন ৬ই জানুয়ারি রাতে বালুর ট্রাকের পাশাপাশি ব্যারিকেড দিয়ে রাখা জলকামানটি সরিয়ে নেয়া হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়িও শিথিল করা হয়। এরপর ৮ই জানুয়ারি দ্বিতীয় দফায় সরিয়ে নেয়া হয় সেখানে মোতায়েন করা নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের। বাসার সরকারি প্রটোকল সরিয়ে নেয়ার পর নিয়মিত কিছু নিরাপত্তা কর্মী তার বাসভবনের নিরাপত্তা দেখভাল করেন। দীর্ঘ ১৫ দিন অবরুদ্ধ থাকার পর ১১ই জানুয়ারি গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্ত আলোয় আসেন খালেদা জিয়া। ওইদিন রাতে বাসভবন থেকে দলীয় কার্যালয়ে আসেন তিনি। সাক্ষাৎ করেন দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে।