ইরানের মেজর জেনারেল কাসেম সোলাইমানি হত্যার ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়েছে। সেখানে এই অস্থিরতার প্রভাব বাংলাদেশের মতো ক্রমবর্ধমান অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর পড়ার আশঙ্কা করছেন কূটনৈতিক বিশ্নেষক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, এ মুহূর্তে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম প্রধান সামরিক ক্ষমতাধর ইরান ওই হামলার জবাব দেবে শক্তভাবেই। এখন এ আশঙ্কাই প্রবল হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞরা আরও বলেন, মূলত যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার অভিশংসন থেকে দেশটির নাগরিকদের দৃষ্টি ফেরাতে এবং ইরানের উত্থান ঠেকাতেই এ হামলা পরিচালনা করেছেন। তবে তার এই হামলা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় একটি কূটনৈতিক ভুল। কারণ ইরান তার মিত্র রাশিয়া, চীন, তুরস্কসহ আরও কয়েকটি বড় অর্থনীতির দেশকে নিয়ে আগের চেয়ে অনেক সুসংহত অবস্থানে রয়েছে। অন্যদিকে, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতির বাস্তবতায় যুক্তরাষ্ট্রের ঘনিষ্ঠ মিত্ররাও এ হামলাকে ভালো চোখে দেখছে না। ফলে হামলার পর যুক্তরাষ্ট্র কূটনৈতিকভাবে স্পষ্টতই বেকায়দায় পড়েছে।
এ ব্যাপারে সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ওয়ালিউর রহমান সমকালকে বলেন, ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর মধ্যপ্রাচ্য কূটনীতিতে তিনটি বড় ভুল করেছেন। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমলে পরমাণু অস্ত্র তৈরি না করার বিষয়ে জেনেভায় জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্য রাষ্ট্র এবং জার্মানির সঙ্গে ইরানের যে অন্তর্বর্তী সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল, তা থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে প্রথম বড় ভুল করেন তিনি। কারণ ওই চুক্তি অনুযায়ী ইরান তার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ ৫ শতাংশে সীমিত রাখার কথা বলেছিল; নতুন কোনো সেন্ট্রিফিউজ চালু না করা এবং নতুন পারমাণবিক চুল্লির নকশা আন্তর্জাতিক আণবিক সংস্থার কাছে সরবরাহ করতে দায়বদ্ধ থাকার কথাও বলেছিল। কিন্তু ট্রাম্প চুক্তি বাতিল করে ইরানকে সব দায়বদ্ধতা থেকে মুক্ত করে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিপদ ডেকে আনেন। এরপর ট্রাম্প নতুন করে ইরানের ওপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেন, যেটা ছিল দ্বিতীয় ভুল। কারণ জাতিসংঘ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবরোধ তুলে নেওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের এবারের অবরোধ খুবই দুর্বল কূটনৈতিক চিন্তাভাবনাকেই তুলে ধরে। তাছাড়া ইরানের সঙ্গে তার শক্তিশালী মিত্ররা থাকার কারণে এবারের এই অবরোধ তাদের একেবারেই বিচলিত করার মতো ছিল না। এবার ইরানের এক জনপ্রিয় সামরিক কমান্ডারকে হত্যা করে ট্রাম্প তৃতীয় বড় কূটনৈতিক ভুলটি করেছেন। কারণ এ হামলায় কৌশলগত দিক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো লাভ নেই।
ওয়ালিউর রহমান আরও বলেন, ইরানের বর্তমানে যে সুসংহত অবস্থা এবং তাদের সভ্যতার ঐতিহ্য বলে দেয়, এই হামলার জবাব যে কোনোভাবেই দেবে। এর ফলে দীর্ঘমেয়াদে মধ্যপ্রাচ্যে আবারও বড় সংঘাতের জন্ম নিতে পারে। অভিসংশন থেকে নিজ দেশের নাগরিকদের দৃষ্টি অন্য দিকে ফেরাতেই ট্রাম্প এ হামলা চালিয়েছেন বলে দৃশ্যমান হচ্ছে।
কূটনৈতিক বিশ্নেষক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক শাহাব এনাম খান বলেন, ট্রাম্প শুধু অভিশংসন থেকে চোখ ফেরাতে এ হামলা চালিয়েছেন, এটা বলা যাবে না। আরও একটা বড় কারণ হচ্ছে, আইএসপরবর্তী সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে একটি বড় শক্তি হিসেবে উত্থান ঘটেছে ইরানের। মধ্যপ্রাচ্যে আইএসকে বিদায় করার পেছনেও ইরানের একটা বড় ভূমিকা আছে। ইরানের এই উত্থানে ট্রাম্প স্বাভাবিকভাবেই বিচলিত। এ কারণেই ট্রাম্প হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
তিনি বলেন, এ হামলার ফলে মধ্যপ্রাচ্যে গভীর সংকটের সৃষ্টি হবে এবং এ সংকট থেকে উত্তরণের উপায়ও এ মুহূর্তে দেখা যাচ্ছে না। ইরানের আনুষ্ঠানিক সামরিক শক্তির চেয়েও বড় শক্তি হচ্ছে লেবানন থেকে ইরাক পর্যন্ত বিস্তৃত মিলিশিয়ান নেটওয়ার্ক। এই নেটওয়ার্ক অত্যন্ত শক্তিশালী। ফলে এটা স্পষ্ট যে, ইরান এই হামলার জবাব দেবে এবং সেটা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় মাথাব্যথার কারণ হতে পারে।
কূটনৈতিক বিশ্নেষক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন কবীর বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সংকট গভীর হলে এর বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশের ওপর পড়বে। প্রথমত, সংকটের কারণে হরমুজ প্রণালি বন্ধ হয়ে গেলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল সরবরাহ বিঘ্নিত হবে এবং বিশ্বজুড়ে তেলের দাম বেড়ে যাবে। যার প্রভাবে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এ ছাড়া বড় আকারে সংঘাত শুরু হলে মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত বিশাল সংখ্যক বাংলাদেশি দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হতে পারে। এর ফলে রেমিট্যান্স প্রবাহে বিরূপ প্রভাব পড়বে। মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমবাজারও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সংঘাতের কারণে মুসলিম বিশ্বে একটা বিভাজন দেখা দিতে পারে। সেটাও বাংলাদেশের জন্য সুখকর হবে না।
তিনি আরও বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে সত্যিকার অর্থেই একটা সংঘাতময় অবস্থার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠছে। উত্তেজনা, উদ্বেগ বাড়ছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এখন বিশ্ব সংঘাত চায় না, যুদ্ধ চায় না। আরও একটি বড় যুদ্ধের ভার বহন করার মতো অবস্থা বর্তমান বিশ্বের নেই।
এদিকে গতকাল রোববার ঢাকায় ইরান দূতাবাসের সংবাদ বিজ্ঞপিতে বলা হয়েছে, মার্কিনিরা মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা ও সংঘাতের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে দিতে অত্যন্ত বর্বরোচিত হামলা চালিয়ে কাসেম সোলাইমানিকে হত্যা করেছে। তারা এই জঘন্য অপরাধের মাধ্যমে ইরাকের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করেছে, আন্তর্জাতিক রীতিনীতি পদদলিত করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করতে চেয়েছে। তবে এই জঘন্য অপরাধের নির্বোধ হোতারা যেন মনে রাখে, তারা তাদের অপরাধের দাঁতভাঙা জবাব পাবে। এই অপরাধের যারা হোতা তারা চিরদিন ইতিহাসে ধিক্কৃত হয়ে থাকবে।