ঢাকা: পদোন্নতির কাঠামোয় ভারসাম্য চায় পুলিশ। তাদের বিবেচনায় অন্যান্য ক্যাডারের তুলনায় পুলিশে গ্রেড-১, গ্রেড-২, গ্রেড-৩ পদ কম। তাই পুলিশের সাংগঠনিক কাঠামো অসামঞ্জস্যপূর্ণ। এতে পদোন্নতি ও পদায়নে দীর্ঘসূত্রতা দেখা দিচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় সার্বিক তত্ত্বাবধায়ন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, পুলিশ হবে জনতার’ এই স্লোগানকে উপজীব্য করে আজ রোববার রাজারবাগ পুলিশ লাইন্সে ছয় দিনব্যাপী পুলিশ সপ্তাহ-২০২০-এর উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সংশ্নিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এবারের পুলিশ সপ্তাহে বাহিনীর পদোন্নতির কাঠামোয় ভারসাম্য আনার বিষয়টি তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতো পুলিশও সুদমুক্ত গাড়ি কিনতে ঋণ সুবিধা চাইবে। পুলিশ সপ্তাহ ঘিরে এবার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে আরও কিছু দাবি-দাওয়া তুলে ধরা হবে।
একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা জানান, প্রশাসন ক্যাডার, ফরেন সার্ভিস, শুল্ক্ক ও আবগারি এবং কর ক্যাডারের তুলনায়ও পুলিশের উচ্চতর পদে ঘাটতি রয়েছে। পুলিশে গ্রেড-১ পদ দুটি। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তুলনা করলে থাকার কথা ৩৮টি। পুলিশে গ্রেড-২ পদ মাত্র ১৩টি। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তুলনা করলে থাকার কথা ২২৭টি। গ্রেড-৩-এ (যুগ্ম সচিব) পুলিশে পদ রয়েছে ৬২টি। প্রশাসন ক্যাডারের সঙ্গে তুলনা করলে থাকার কথা ৩৬৫টি। গ্রেড-৫-এ পুলিশের জনবল রয়েছে ৬৫৩টি। একই বিবেচনায় এ ক্ষেত্রে পুলিশের পদ থাকার কথা ৮০৪টি। ওপরের দিকে পদ কম থাকায় দীর্ঘদিন ধরে একই পদে অনেকে চাকরি করছেন। তিন বছর আগে পুলিশে পাঁচটি পদকে গ্রেড-১ হিসেবে অনুমোদনের দাবি করা হয়েছিল। সেই দাবি মানা হলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। পাঁচটি পদের মধ্যে অ্যাডিশনাল আইজি (অ্যাডমিন অ্যান্ড অপারেশন) এবং অ্যাডিশনাল আইজি-এসবিকে গ্রেড-১ পদে উন্নীত করা হয়। র্যাব মহাপরিচালক, সিআইডির সাবেক অ্যাডিশনাল আইজি, সাবেক ডিএমপি কমিশনার ও সারদা পুলিশ একাডেমির প্রিন্সিপালকে সুপার নিউমারারি (গ্রেড-১) পদে উন্নীত করা হয়। পুলিশের কেউ কেউ বলছেন, বর্তমান সরকারের আমলে পুলিশে জনবল বাড়লেও উচ্চতর পদের সংখ্যা কাঙ্ক্ষিত অনুপাতে বাড়েনি।
প্রশাসন ক্যাডারের মতো পুলিশ কর্মকর্তারা সুদমুক্ত গাড়ি কেনার ঋণ চান। গত বছর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী পুলিশ ক্যাডারকে এই সুবিধা দেওয়ার আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। বর্তমানে উপসচিব থেকে শুরু করে তারও উচ্চ পদে গাড়ি কেনার জন্য সরকার এককালীন ৩০ লাখ টাকা করে ঋণ পাওয়ার সুবিধা দিয়ে আসছে। ‘বিশেষ অগ্রিম’ নামের এই ঋণের বিপরীতে তাদের কোনো সুদ পরিশোধ করতে হবে না। আবার সেই টাকা দিয়ে কেনা গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণ, জ্বালানি খরচ ও চালকের বেতন বাবদ সরকার মাসে আরও ৫০ হাজার টাকা করে দিচ্ছে। পুলিশের একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, পুলিশ ক্যাডারের কর্মকর্তাদের অপারেশনাল কাজে বেশি গাড়ি ব্যবহার করতে হয়। অনেক সার্কেল এসপির চলাচলে উপযুক্ত ভালো গাড়ি নেই। এ ছাড়া বর্তমানে এসপিরা যে গাড়ি পাচ্ছেন, তার ভেতরে বাড়তি ফোর্স রাখার ব্যবস্থা নেই। চালকের পাশে কেবল একজন বসতে পারেন। পুলিশ সুপারকে যে গাড়ি দেওয়া হয় তা জেলার নন-ক্যাডারভুক্ত অনেক কর্মকর্তাও পেয়ে আসছেন। গাড়ি নিয়ে বৈষম্যের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে পুলিশ সপ্তাহে তুলে ধরা হবে।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন ধরে পুলিশের কিছু ভাতা একই জায়গায় রয়েছে। চুল কাটা, ধোপা ভাতা বাড়ানোর বিষয়টিও এবার সামনে আসবে। কর্তব্য পালনরত অবস্থায় কোনো সদস্য মারা গেলে তার জন্য পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা যে ক্ষতিপূরণ পান সে ক্ষেত্রে বৈষম্য রয়েছে বলে মনে করা হয়। বর্তমানে দায়িত্ব পালনকালে কোনো পুলিশ কর্মকর্তা মারা গেলে তার পরিবার পাঁচ লাখ টাকা পায়। তবে চাকরিরত অবস্থায় (ছুটিতে থাকলেও) কোনো ক্যাডারের সরকারি কর্মকর্তা মারা গেলে তার পরিবারকে আট লাখ টাকা দেওয়া হয়। চাকরিরত অবস্থায় মৃত্যুর ক্ষেত্রে ক্ষতিপূরণ বাড়ানোর বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরা হবে। এ ছাড়া পুলিশ বাহিনীর জন্য স্বতন্ত্র মেডিকেল কলেজ, শতভাগ রেশন, আলাদা পুলিশ বিভাগ, পুলিশের মহাপরিদর্শক পদকে ফোর স্টার জেনারেলের পদমর্যাদায় উন্নীত করার দাবিও জানানো হবে।
পুলিশের একাধিক কর্মকর্তা জানান, জেলায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন নাশকতামূলক কার্যক্রম প্রতিরোধ এবং মামলা নিষ্পত্তি কার্যক্রম পর্যালোচনায় ‘জেলা আইনশৃঙ্খলা রিভিউ কমিটি’ গঠন করা হয়েছে। গত ২ ডিসেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা শাখা থেকে এ-সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে প্রধান করে ওই কমিটি গঠন করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা রিভিউ কমিটির সভাপতি হতে চান পুলিশ সুপাররা।
পুলিশের মাঠপর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, অপারেশনাল কার্যক্রমে পুলিশের অনেক কর্মকর্তা সরাসরি নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। অনেক কর্মকর্তা জীবনও দিয়েছেন। কিন্তু তাদের জন্য ঝুঁকি ভাতা নেই।
এবার পুলিশ সপ্তাহে জনবল বাড়ানোর দাবিও আসবে। একাধিক কর্মকর্তার ভাষ্য, দীর্ঘদিন পুলিশ অবহেলিত ছিল। তবে বর্তমান সরকারের আমলে জনবল বাড়ানো, নতুন নতুন ইউনিট তৈরিসহ পুলিশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। তাদের জন্য আলাদা ব্যাংক চালু হয়েছে। তাদের অনেক যৌক্তিক দাবি মেনে নিয়েছে সরকার। আবার দাবি পূরণের আশ্বাস দেওয়ার পর তা বাস্তবায়নের নামে দিনের পর দিন ঝুলিয়েও রাখা হচ্ছে। অনেক ফাইল আটকে থাকে মন্ত্রণালয়ে। এমন অনেক বৈষম্য দূর করার কার্যকর উদ্যোগ চায় পুলিশ।