‘সুবিধাবঞ্চিত মানুষের মানবাধিকার রক্ষায় জনস্বার্থের মামলা (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) সহায়ক ভূমিকা রাখছে’- মন্তব্য করে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন বলেছেন, ‘এ পদ্ধতি অত্যন্ত প্রশংসিত। তবে পাবলিক তোষণ অবশ্যই বিচারকদের প্রভাবিত করবে না এবং ব্যক্তিগত অতিরঞ্জিতাও এড়িয়ে চলা উচিত। এ ক্ষেত্রে বিচারিক প্রক্রিয়ার পবিত্রতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতাও রক্ষা করতে হবে।’
শনিবার সুপ্রিম কোর্ট মিলনায়তনে ‘স্ট্যান্ডিং ইন পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন: অ্যান আউটলাইন’ (জনস্বার্থ মামলায় বর্তমান পরিস্থিতি:রূপরেখা) শীর্ষক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন এসব কথা বলেন। সুপ্রিম কোর্ট ও সুপ্রিম কোর্ট অনলাইন বুলেটিন (এসসিওবি) যৌথভাবে এই সেমিনারের আয়োজন করে।
সেমিনারে ৩১ পৃষ্টার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী। পরে মূল প্রবন্ধ নিয়ে আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, হাইকোর্টের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ।
এ ছাড়াও মুক্ত আলচনায় অংশ নেন হাইকোর্টের বিচারপতি এসএম এমদাদুল হক, বিচারপতি এ কে এম আবদুল হাকিম, বিচারপতি ওবায়দুল হাসান, বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান, বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন, বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল। অনুষ্ঠানে সমাপনী বক্তব্য দেন সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্টার জেনারেল (জেলা জজ) মো. আলী আকবর।
প্রধান অতিথির বক্তৃতায় প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আইন ও ন্যায় বিচারের মাধ্যমে জনস্বার্থের মামলার সক্ষমতা কাজে লাগাতে হবে। আমাদের জাতির সার্বিক উন্নয়নে এই পদ্ধতি বড় ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ মানবাধিকার বিষয়ক বিচার ব্যবস্থায় জনস্বার্থের মামলা দেশীয় মডেল হিসেবে বিচার বিভাগকে এগিয়ে নিতে সহায়তা করে।
তিনি আরও বলেন, জনসাধারণের ভুল, জনস্বার্থে ক্ষত ও সাংবিধানিক বিতর্ক সমাধানে জনস্বার্থ মামলা সাধারণ মানুষের নাগালে একটি কার্যকর বাহন।
মূল প্রবন্ধে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, জনস্বার্থের মামলা সুবিধাবঞ্চিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ন্যায় বিচার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে পথ খুলে দেয়। এই ব্যবস্থা মানুষের মৌলিক অধিকারকে রক্ষা করে এবং সম্প্রসারিত করে। আর জনস্বার্থমূলক মামলার মাধ্যমে উচ্চ আদালত বিচার বিভাগের সীমানাকেও প্রসারিত করে যাচ্ছে।
আপিল বিভাগের বিচারপতি ইমান আলী বলেন, স্যুয়োমুটো হাইকোর্ট বিভাগ দিতে পারবে কিনা, বিষয়টি আপিল বিভাগের নিষ্পত্তি হয়েছে। সংবিধানের ১০২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী হাইকোর্ট বিভাগ পোস্ট কার্ড, নিউজ পেপারসহ বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্যের ভিত্তিতে স্যুয়োমুটো দিতে পারে। তবে এক্ষেত্রে হাইকোর্টের সংশ্নিষ্ট বিচারককে অবশ্যই সেটিসফাইড (সন্তুষ্ট) হতে হবে। এ জন্য সংশ্নিষ্ট বিচারককে আলোচিত বিষয়ে রুল ইস্যু করার আগে অবশ্যই তথ্যের (পোস্ট কার্ড বা নিউজ) সত্যতা জেনে নিতে হবে। সেখানে জনস্বার্থ থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, চোখের সামনে মানুষ নিগৃহীত হচ্ছে, অথচ কারও কাছে যেতে পারছে না। এমন পরিস্থিতিতে আমরা (বিচারকরা) জেগে উঠি। তার মতে, জনস্বার্থ মামলার ব্যাপ্তি অনেক বড়। স্যুয়োমুটোর কিছু সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্ত জনস্বার্থ ইস্যুতে যে কেউ মামলা করতে পারেন। এটা নাগরিকের অধিকার।
বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ বলেন, ইদানিং দেখা যায় কিছু আইনজীবী নিজেকে প্রচারমাধ্যমে তুলে ধরতে বা নিজের প্রচারের জন্য জনস্বার্থে মামলা নিয়ে আদালতের এসে হাজির হন। এটি বাজে দৃষ্টান্ত। এর ফলে প্রকৃত জনস্বার্থের মামলা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তাই এসব ক্ষেত্রে লাগাম টেনে ধরা দরকার।
জনস্বার্থ মামলায় উচ্চ আদালতের আলোচিত কয়েকটি রায় ও আদেশের উদাহারন তুলে ধরে বিচারপতি শেখ হাসান আরিফ আরও বলেন, আদালত একটা নির্দেশনা দিয়ে দিল আর দায়িত্ব শেষ হয়ে গেলো, বিষয়টি তা নয়। আদালতকে নির্দেশনা বাস্তবায়নের বিষয়টিও মনিটরিং-এর মধ্যে রাখতে হবে। তাহলেই জনস্বার্থ সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। জনস্বার্থের মামলায় যেসব রায় এখনও বাস্তবায়ন হয়নি তা নিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশের ওপরেও গুরুত্বারোপ করেন তিনি।
মুক্ত আলোচনায় বিচারপতি একেএম আবদুল হাকিম বলেন, জনস্বার্থ মামলায় অনেক আদেশ আমরা দেই। কিন্ত এটা ফলোআপ করা প্রয়োজন। নদীর সীমানা নির্ধারন, শহীদ মিনারের পবিত্রতা রক্ষাসহ অনেক রায় বাস্তবায়নের বিষয়ে আমাদের যত্ন সহকারে দেখতে হবে।
বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, আমরা সংবিধানের রক্ষক। তবে বিদ্যমান আইন রক্ষা করা বিচারকের দায়িত্ব। আমরা আইনের ভুল বা সংশোধনের বিষয়টি সরকারের নজরে নিতে পারি। জনস্বার্থের মামলার এ বিষয়টিও খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমরা যখন কোনো বিষয়ে স্যুয়োমুটো আদেশ দেই, তখন অনেকেই ভাবে যে, আমরা (বিচারক) ওভার স্ট্রেপিং (ক্ষমতার বাড়াবাড়ি) করছি। আসলে তা না। তাদের বুঝতে হবে পরিস্থিতির প্রয়োজনেই আমরা স্যুয়োমুটো আদেশ দিয়ে থাকি।
বিচারপতি মো. রেজাউল হাসান বলেন, সংবিধান ও আইনের শাসন রক্ষা করা বিচারকের দায়িত্ব। কিন্ত জনস্বার্থ মামলা যারা নিয়ে আসেন তারা কিন্তু একটি পক্ষ নিয়েই শুনানি করেন। সেক্ষেত্রে বিচারকের অবশ্যই দৃঢ়তার সঙ্গে অবস্থান নিতে হবে।
বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, বিচারকদের দায়িত্ব রয়েছে তারা কোন মামলাটি জনস্বার্থ মামলা হিসেবে গ্রহন করবে, কোনটি করবে না।
জনস্বার্থের মামলায় তুরাগ নদ নিয়ে রায় প্রদানকারী অন্যতম বিচারপতি আশরাফুল কামাল বলেন, মৌলিক কাজ করতে পারলে আপনি কোন ভাষায় লিখছেন সেটা বিষয় নয়। তুরাগ নদ নিয়ে রায়টি বাংলায় রায় দেওয়া হলেও অস্ট্রেলিয়ায় একটি গবেষণা কাজে সেটি ইংরেজীতে ভাষান্তর করা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, জনস্বার্থ মামলায় আমরা যেন কিছু দিতে পারি সেই চেষ্টা আমাদের থাকতে হবে। প্রধান উদ্দেশ্য হলো জনগন। তাদের সুরক্ষা যেমন সংসদ করবে তেমনি আমাদেরও জনগনের স্বার্থে কাজ করতে হবে। তবে সীমা অতিক্রম করা যাবে না।