বিটের তালে তালে কাঁপছিলো চার দেয়ালে বদ্ধ বাতাস। সঙ্গে লেজার লাইটের ঝলকানি। হাতে হুইস্কি ও মদের গ্লাস। বাজছে হিন্দি-ইংরেজি মিশেল গান। স্টেজে স্বল্প বসনা ডিজে তরুণীর নাচ। আলো-আঁধারে মাতাল তরুণ তরুণীরা জড়িয়ে ধরছিলেন একে অপরকে। এ যেন অন্য এক দুনিয়া। উল্মাতাল রাত।
ইংরেজী নববর্ষ-২০২০ সালকে বরণ করে নিতে এমন চিত্রই ছিল রাজধানীর বেশ কিছু তারকা হোটেলে। প্রশাসনের কঠোর নির্দেশনা সত্ত্বেও রাতভর মাদকতা ও অশ্লিলতার মিশেলে চলে নানা অনুষ্ঠান। থার্টিফাস্ট নাইটের নিরাপত্তা নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে ডিএমপি কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছিলেন, তারকা হোটেলের ইনডোরে অনুষ্ঠান করতে হলে ডিএমপির অনুমতি নিতে হবে। ইনডোরে কোনো অশ্লিলতা না করে দেশীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অনুষ্ঠান করতে হবে। মাদকের অপব্যহার রোধ করতে বিশেষ অভিযান থাকবে। যদিও বাস্তবে চিত্র ছিল ভিন্ন।
ইংরেজী নববর্ষ-২০২০ সালকে বরণ করে নিতে আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল রাজধানীর সবকটি তারকা হোটেল। প্রতিটা হোটেলেই ছিল ভিন্ন ভিন্ন আয়োজন। হোটেল লা মেরিডিয়ানে থার্টিফাস্ট নাইটের বিশেষ আয়োজনের মধ্যে ছিল ডিজে পার্টি, ফ্যাশন-শো এবং ডান্স। থার্টিফার্স্ট উপলক্ষে বুফেতে বাড়তি ফুড আইটেমের ব্যবস্থা ছিল। ঢাকা রিজেন্সিতে ছাদ, বার এবং সেলিব্রেশন হলে ডিজে পার্টি, ফায়ারবক্স, ফ্যাশন শো এবং মিউজিক্যাল নাইটের ব্যবস্থা ছিল। সর্বনিম্ন ৩ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫ হাজার টাকা প্রবেশ মূল্য ছিল। ৫ হাজার টাকার প্রবেশ টিকেটের সঙ্গে খাবার ও ড্রিংকস ফ্রি দেয়া হয়। এই টিকেটে তিনটি স্থানেই অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ ছিল। প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে বিশেষ বুফের আয়োজনের পাশাপাশি মিউজিক্যাল নাইটের ব্যবস্থা ছিল। এছাড়া ডিজে পার্টিসহ বারবিকিউ স্পেশাল ছিল। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত সোনারগাঁও হোটেলে থার্টিফাস্ট নাইটের আয়োজন চলে। তবে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে থার্টিফাস্ট নাইটের বিশেষ কোনো আয়োজন ছিল না।
মঙ্গলবার রাত ১১টা। রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার একটি পাঁচতারকা হোটেল। বাইরে লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমা ধাচের পোশাক পরিহিত তরুণ-তরুণীরা। লম্বা লাইন এড়িয়ে লিফটের ১৬ তলার ছাদে গিয়ে দেখা যায় অন্য এক পরিবেশ। সুইমিং পুলের পাশে ছাদ বাগান। তার পাশে ফাঁকা জায়গায় আয়োজন করা হয়েছে ডিজে পার্টির। ডিজে সনিকা, ডিজে মেরাজ, ডিজে ফারজানা, ডিজে শাহরিন, ডিজে রুপা আরো একাধিক ডিজে গার্লরা স্ট্রেজ থেকে হিন্দি-ইংরেজী গানের সঙ্গে নেচে নেচে তরুণ-তরুণীদের উৎসাহ দিচ্ছিলেন। স্বল্প বসনা ডিজে গার্লদের নাচের তালে তালে বেসামাল হয়ে নাচছিলেন যুবকরাও। তাদের কারো হাতে ছিল হুইস্কির বোতল, কারো হাতে অ্যালকোহল। শিক্ষার্থী, ব্যবসায়ী, চাকরিজীবি, তারকা, মডেল, শিল্পী, খেলোয়াড়সহ নানা শ্রেণী পেশার ও বয়সের অতিথিদের সেখানে দেখা মেলে। এছাড়া পার্টিতে তুরস্ক, নেদারল্যান্ড, নাইজেরিয়া ও নেপালের নাগরিকের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। ঘড়ির কাটায় যখন রাত ১২ টা ১ মিনিট তখন হৈ-উল্লাস বাড়তে থাকে। উপস্থিত সবাই ‘হ্যাপি নিউ ইয়ার’ বলে চিৎকার করছিলেন। নতুন বছরকে বরণ করে নেয়ার পাশাপাশি সবাই যেন হারিয়ে যাচ্ছিলেন অন্য কোনো ভ্রমে। এরপর স্পিকারে বাজছিলো একের পর এক গান আর তালে তালে নেচে নেচে বেসামাল হয়ে যান তরুণ-তরুণীরা।
এই হোটেলের ছাদের একটি কক্ষের ভিতর চলছিলো অন্যরকম আরেক পার্টি। লাউড স্পিকারে হিন্দি-ইংরেজী গান বাজিয়ে নাচছিলেন পার্টি গার্লরা। সেই সঙ্গে বার সিঙ্গারদের গানের আয়োজন ছিল লক্ষণীয়। আবছা অন্ধকার কক্ষটিতে বসার ব্যবস্থা ছিল। সেখানে আয়েশ করে বসে অ্যালকোহল পান করছিলেন অতিথিরা। তাদের সঙ্গ দিচ্ছিলেন বার কন্যারা। অনেককে অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে দেখা গেছে। এই কক্ষটির সামনের কিছু অংশ ফাঁকা। এই ফাঁকা স্থানে পালাবদলে নাচছিলেন বার কন্যারা। আর দর্শক সারির মদ্যপ লোকেরা উঠে এসে করছেন টাকার বর্ষন। এই কক্ষে মেলে ১শ’ টাকার নোটের বাণ্ডিলের ছড়াছড়ি। এই টাকাগুলো ডিজে গার্লদের ওপর ছুঁড়ে মারতে দেখা যায় তাদের। একই সঙ্গে নাচের তালে তালে একটি একটি করে টাকার নোট দিতে থাকেন তাদের। এই টাকাগুলো ডিজে গার্লরা সংগ্রহ করে নিয়ে রাখেন নির্দিষ্ট একটি স্থানে। আর নিচে পড়ে যাওয়া টাকা সংগ্রহের জন্য আছে আলাদা লোক। ভোর চারটার দিকে থার্টিফাস্টের আয়োজনের সমাপ্তি ঘটে।
তার ঠিক পাশেই পাঁচতারকা মানের আরেকটি হোটেলে গিয়েও দেখা যায় প্রায় একই দৃশ্য। এই হোটেলটির ছাদ, বার ও সেলিব্রেশন হলে থার্টিফাস্টের আয়োজন ছিল। ডিজে তরুনীদের উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। বিটের তালে তালে আর লেজার লাইটের ঝলকানিতে আগত অতিথিদের মনোরঞ্জন করছিলেন তারা। স্বল্প বসনা তরুণীরা পার্টনার হিসাবে সঙ্গ দিচ্ছিলেন অনেক তরুণদের। এখানে মদ ও হুইস্কি ছিল হাতের নাগালেই। নির্দিষ্ট পরিমাণ বিল পরিশোধ করে টোকন দিয়ে অনেকেই সংগ্রহ করছিলেন।
এদিকে থার্টিফাস্টের পার্টিতে ছোটখাটো অপ্রীতিকর ঘটনার কমতি ছিল না। কয়েকজন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মদ্যপ অবস্থায় উন্মাতাল ছিলেন। নাচানাচির সময় হাত ছোড়াছুড়ির সময় অন্যের শরীরে হাত লাগাকে নিয়ে বাকবিতণ্ডারও সৃষ্টি হয়। একপর্যায়ে হাতাহাতির পর্যায়ে গেলে বাউন্সারদের মাধ্যমে সেটির সমাধান হয়। তারা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন সিগারেট, গাজা আর সেখান থেকে বিয়ার ও মদ কিনে পার্টিতে অংশ নেয় তারা। একটি তারকা হোটেলে কথা হয় একজন পার্টি গার্লের সঙ্গে। যারা বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে এসেছেন তাদের পোশাকে কিছুটা রাখঢাক থাকলেও নেই অন্যদের পোশাকে। কে কতোটা খোলামেলাভাবে আসতে পারেন যেন ছিল তার প্রতিযোগিতা। একজন পার্টি গার্ল বলেন, আমি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। টিকেট কেটে প্রবেশ করেছি। উদ্দেশ্য ডান্স পার্টনার ও অতিথিদের মনোরঞ্জন করে টাকা ইনকাম। বিভিন্নজনের সঙ্গে নেচে যে যা দেয় এই টাকা নিয়ে থাকি। আমার সারারাতে আয় হবে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা। এটা আমার পেশা না বাড়তি আয়ের জন্য এক রাতে এসেছি। আরেকজন বলেন, বিভিন্ন ডিজে পার্টিতে অতিথিদের সঙ্গ দেয়াই আমার কাজ। এভাবেই আমার সংসার চলে।