উৎকণ্ঠায় শুরু হলো নতুন বছর

Slider টপ নিউজ

57188_f3

ঢাকা: রাজনৈতিক অস্থিরতা নিরসনে কোনো উদ্যোগ না থাকায় উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যদিয়ে শুরু হলো নতুন বছর। দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় সচেষ্ট থাকায় সহিংসতা এখন
সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। একতরফা নির্বাচন করেও পূর্ণ মেয়াদ ক্ষমতায় থাকার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে সংলাপের সব সম্ভাবনা শেষ হয়ে যাওয়ায় রাজপথের আন্দোলনের মাধ্যমেই সরকার হটানোর ঘোষণা দিয়েছে বিএনপি। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে রাজনৈতিক সমঝোতা অধরাই থেকে গেল।
বছরের শুরুতেই ৫ জানুয়ারি ‘গণতন্ত্রের বিজয় দিবস’ পালনে রাজপথে নামার ঘোষণা দিয়েছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে বিএনপি একে ‘কালো দিবস’ আখ্যায়িত করে ঢাকার রাজপথ দখলে নেয়ার চেষ্টা করবে। দুই দলের পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে সহিংসতার আশঙ্কা করছে সর্বস্তরের জনগণ।
প্রধান দুই দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করে জানা যায়, সহসা কোনো সমঝেতার আশা করছেন না তারা। উভয় দলের নেতাই তাদের নিজেদের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে কোনো রকম ছাড় দেয়ার বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। গত বছরের শেষ দিন পর্যন্ত সমঝোতার কোনো লক্ষণ ছিল না।
বিদায়ী বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বেশ কয়েকটি জনসভা এবং বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমঝোতায় পেঁৗছাতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। পাশাপাশি এও বলেন, সংলাপের জন্য বিএনপি অনন্তকাল অপেক্ষা করবে না। অন্যদিকে সংলাপের বিষয়ে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিদায়ী বছরে কখনো আন্তরিকতা দেখাননি। বরং গত জুলাই মাসে বিদেশি একটি গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে সংলাপের বিষয়টি সরাসরি নাকচ করেন। এরপর গত অক্টোবরে সংবাদ সম্মেলনে পরিষ্কার জানিয়ে দেন বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়।
শীর্ষ এই দুইনেত্রীর কথার সঙ্গে মিল রেখে একই রাস্তায় হেঁটেছেন দল দুইটির অন্য শীর্ষ নেতারাও। বছরের শেষ দিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পেঁৗছাতে তার দল সবচেয়ে আন্তরিক বলে জানান। কিন্তু আওয়ামী লীগের সভাপতিম-লীর সদস্য ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম জানান, বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। আর খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, শুধু এখনই নয় বর্তমান সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও বিএনপির সঙ্গে কোনো সংলাপ হবে না। কারণ একাদশ নির্বাচনে বিএনপি নির্বাচনকালীন সরকারে থাকতে পারবে না। তারা সংসদে নেই। এ জন্য তাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা বা সংলাপের প্রয়োজন নেই। আগামী নির্বাচন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অধীনেই হবে।
এ অবস্থায় সমঝোতার সম্ভাবনা নাকচ করেই বসে নেই দেশের রাজনীতিবিদরা। বরং গত বছরের শেষ দিকে এক দল আরেক দলকে ঘায়েল করার প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে নতুন উদ্বেগের জন্ম দেয়। বিগত সময় প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করার সংস্কৃতি চালু ছিল। কিন্তু এখন শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত করার হুমকি দেয়া হচ্ছে। আর এ রাজনৈতিক উত্তাপের সূত্রপাত হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি উক্তিকে কেন্দ্র করে। এরপর এই ইস্যুতে বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেতারা পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিতে শুরু করেন। একদিকে ইতিহাস বিকৃতির জন্য তারেক রহমান ক্ষমা না চাইলে দেশের কোথাও বিএনপিকে সমাবেশ করতে না দেয়ার হুমকি দেন আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ। জবাবে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহল কবির রিজভীও বলেন, আওয়ামী লীগকেও দেশের কোথাও নির্বিঘ্নে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না। এসব বক্তব্যের এক পর্যায়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বিএনপির জ্যেষ্ঠ নেতাদের নেড়িকুত্তার মতো পেটানোর হুমকি দেয়ায় সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে।
দুই দলের পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের ব্যাপারে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ড. আকবর আলি খান বলেন, অনিশ্চয়তা দেশকে ঘিরে রেখেছে। প্রায় দুই যুগ ধরে সংঘাতময় রাজনীতি চলছে। শিগগিরই সঙ্কট সমাধান হবে বলে মনে করেন না তিনি।
এদিকে রাজনৈতিক সমঝোতা অধরা থাকার কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশ্লেষকদের সঙ্গে আলোচনা এবং ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশের ইতিহাসে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রথম সমঝোতা হয়েছিল এরশাদবিরোধী আন্দোলন যখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এ সমঝোতা ত্রিদলীয় রূপরেখা নামে জাতীয় রাজনীতির একটি মাইলফলক হিসেবে সবার কাছে স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় সমঝোতাটি মূলত প্রথমটিরই বাস্তবায়ন। সেটি হলো: সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তন। এ বিলটি সংসদে পাস হওয়ার পর তখনকার সংসদ সদস্যদের মধ্যে যে শুভেচ্ছা বিনিময় হয় সেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন। এরই উল্টো চিত্র দেখা যায় নির্দলীয়-নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান দাবিতে ১৯৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগের আন্দোলনের সময়। সেই সময় লাগাতার হরতাল ও অসহযোগ আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়ায় আন্তর্জাতিক মহল থেকে এক ধরনের সমঝোতায় পেঁৗছানোর জন্য বিবদমান পক্ষগুলোকে চাপ দেয়া হয়। এক পর্যায়ে কমনওয়েলথ মহাসচিব স্যার নিনিয়ান স্টিফেন মধ্যস্ততাকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি আন্দোলনরত আওয়ামী লীগ ও সরকারি দল বিএনপির মধ্যে সমঝোতার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। প্রায় এক দশকের বিরতিতে ২০০৬ সালের শেষ দিকে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের মেয়াদান্তে গ্রহণযোগ্য ভোটার তালিকা প্রণয়ন ও বিচারপতি কেএম হাসানের প্রধান উপদেষ্টা হওয়াকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ দেশ অচল করা আন্দোলন শুরু করে। তখনো বাংলাদেশের শুভাকাঙ্ক্ষী রাষ্ট্র কিংবা সংস্থাগুলোর চাপে প্রয়াত আবদুল জলিল ও আবদুল মান্নান ভূঁইয়া সংলাপে বসেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমঝোতা হয়নি। এর সাত বছর পর রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে আবারো ব্যর্থ সংলাপ দেখা যায়। ২০১৩ সালে কাছে-দূরের বন্ধুরাষ্ট্র আর বন্ধুসংস্থা ও সুশীল সমাজের চাপে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ও সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম পরস্পরকে ফোন করে ও চিঠি দিয়ে সমঝোতার জন্য সংলাপের আমন্ত্রণ বিনিময় হয়। কিন্তু সেটিও খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনার তিক্ত ফোনালাপের মাধ্যমে থেমে যায়।
ঐতিহাসিক এই পরিসংখ্যানের পর রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মত হচ্ছে, ১৯৯০ এবং ১৯৯১ সালে রাজনীতিবিদরা যে জাতীয় ঐকমত্যে পেঁৗছতে পেরেছিলেন সেটার মূলে ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর নিজেদের মধ্যকার স্বতঃস্ফূর্ত। উভয় ক্ষেত্রেই তাদের পরস্পরের সঙ্গে মতের আদান-প্রদান হয়েছিল সরাসরি। কোনো ক্ষেত্রেই কোনো মেডিয়েটর বা সালিশ প্রয়োজন হয়নি। আঞ্চলিক বা বৈশ্বিক কোনো রাষ্ট্র কিংবা সংঘের সহযোগিতা এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোকে প্রণোদনা বা তাগিদ দেয়নি। এই সমঝোতার ফল দীর্ঘমেয়াদে টেকসই ও ইতিবাচক হয়েছে। অন্যদিকে ১৯৯৬, ২০০৬ আর ২০১৩ সালের অভিজ্ঞতা বলে, রাজনৈতিক পক্ষগুলো যখন মারমুখী অবস্থানে থাকে তখন দেশি-বিদেশি প্রভাবে সংলাপে বসলেও সফল হয় না।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ১৯৯৬ ও ২০০৬ সালের চাইতে বর্তমান পরিস্থিতি অনেক বেশি জটিল। নাশকতা, সহিংসতা আর বর্বোরচিত নারকীয়তা হয়েছে এবং হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃপ্রণোদিত উদ্যোগ দরকার। কারো মধ্যস্থতা নয়, রাজনৈতিক দলগুলোর স্বতঃস্ফূর্ত তখনই আসবে যখন জনতার চাপ প্রবল হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *