ভালোলাগা থেকেই একটি সম্পর্কের শুরু। আর সমাপ্তি বিয়ের মাধ্যমে। কিন্তু এই পবিত্র সম্পর্ককে আগলে রাখার দায়ভার কার? অবশ্যই দুজনের। এমনটিই মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। যদিও কৌশলগত কারণে এই দায়িত্ব-কর্তব্য দু’জনের জন্য ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। সম্পর্ক অনেকটা দাঁড়িপাল্লার মতো। যার দু’টো দিক সমান হলে ভারসাম্য বজায় থাকে। আর যখন রকমফের হয় তখনই আত্মহত্যা কিংবা খুনের মত ঘটনা ঘটে।
বর্তমান সময়ে যেটা হরহামেশাই হচ্ছে।
সম্প্রতি রাজধানীর সিদ্ধেশ্বরী থেকে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী রুবাইয়াত শারমিন রুম্পার লাশ উদ্ধার করা হয়। শান্তিবাগে যে বাড়িতে রুম্পা থাকতেন সেখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে সিদ্ধেশ্বরী সার্কুলার রোডের আয়েশা শপিং কমপ্লেক্সের পেছনে তার মরদেহ পাওয়া যায়। শপিং সেন্টারের পাশাপাশি আরও দুটি বাড়ি রয়েছে সেখানে। এগুলোর যেকোনো একটির উঁচু থেকে মাটিতে আছড়ে পড়ে রুম্পার দেহ। তার বাবা রোকন উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, আমার মেয়েকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। সে আত্মহত্যা করতে পারে না।
রুম্পার মৃত্যুর ঘটনায় তার বন্ধু সৈকতকে গ্রেপ্তার করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। এই হত্যাকাণ্ডে সৈকতের সম্পৃক্ততার বিষয়টিও গুরুত্ব নিয়ে বিবেচনা করা হচ্ছে।
ওদিকে নরসিংদীর শিবপুরে নিখোঁজের দুই দিন পর সাবিনা আক্তার (২১) নামের এক যুবতীর মরদেহ উদ্ধার ঘটনার রহস্য উদঘাটন করেছে র্যাব। ধর্ষণে বাধা দেয়ায় সাবিনাকে শ্বাসরোধে হত্যা করে প্রেমিক সাইফুল। আসামি সাইফুল শিবপুর উপজেলার দুলালপুর খালপাড় গ্রামের মৃত হানিফ ফকিরের ছেলে। ওদিকে অক্টোবর মাসে রাজশাহীর বাগমারা থেকে এক কলেজছাত্রীকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়েছে। পরে তার লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয় গাছে। ওই ছাত্রীর লাশ উদ্ধার করে নাটোরের নলডাঙ্গা থানা পুলিশ। সে নলডাঙ্গার একটি কলেজের একাদশ শ্রেণির ছাত্রী ছিল। তার বাবার অভিযোগ- মেয়েকে অপহরণের পর ধর্ষণ শেষে হত্যা করে লাশ গাছে ঝুলিয়ে রাখে প্রেমিক শান্ত ও তার সহযোগীরা। তিনি বলেন, তার মেয়ের সঙ্গে পুঠিয়া উপজেলা সদরের শান্ত ইসলামের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তারা দু’জনই বিয়ের জন্য অভিভাবকদের চাপ দিয়ে আসছিল। তবে দুই পরিবারের কেউই বিয়ের ব্যাপারে রাজি ছিলেন না।
পারিবারিক পছন্দে বিয়ে ঠিক হয়েছিল নাহিদের। বাবা-মা তাদের পছন্দের পাত্রীর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দেবেন এমনটিই পাকা কথা দিয়েছিলেন মেয়ে পক্ষকে। এদিকে পাত্রীর পরিবার চাইছে অন্তত আংটি বদল হয়ে যাক। কিন্তু নাহিদের বাবা মায়ের একই কথা কোনো আংটি বদল নয়। একসঙ্গে বিয়ের কাজ সম্পন্ন করবেন। দুই পরিবারেই চলছে বিয়ের জোগাড়। হঠাৎ করে বেঁকে বসে নাহিদ। এই বিয়েতে তার মত নেই। কারণ অন্য এক মেয়ের সঙ্গে তার ভালোবাসার সম্পর্ক রয়েছে। যেটা পরিবার জানে না। অবশেষে বাবা-মা বাধ্য হয়ে ঘটক পাঠিয়ে মেয়ের পরিবারকে জানান এই বিয়ে হচ্ছে না।
একসময় প্রেমে জড়িয়ে পড়া মানে ছিল বিয়ের প্রতিশ্রুতিতে আবদ্ধ হওয়া। বিশ্বায়নের এই মুক্ত যুগে পশ্চিমের হাওয়া ঢুকে পড়েছে দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে। না চাইতেই দেখা মেলে প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার। ক্ষণে ক্ষণে মন বদলায় তরুণ-তরুণীদের। সকালে সম্পর্ক তৈরি হয় তো বিকেলে ভেঙ্গে যায়। ফলে কমিটেড সম্পর্কের বাইরে এমন সম্পর্কেও মানুষ জড়াচ্ছে, যেখানে জীবন সঙ্গী হওয়ার অঙ্গীকার নেই। যেখানে ভালোবাসার নামে একান্ত সান্নিধ্যে সময় পার করা ছাড়া আর কিছুই নয়। পক্ষান্তরে অনেক প্রেমিক কিংবা প্রেমিকা একই সঙ্গে একাধিক সম্পর্ক চালিয়ে যেতে থাকেন। যার পরিণতি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মৃত্যু।
তীব্র আবেগ, অন্তরঙ্গতা আর কমিটমেন্ট এই তিনটি বৈশিষ্ট্য একটি সম্পর্ককে পরিপূর্ণতা দেয়। ‘কেউ যদি সম্পর্কের পরিণতি প্রত্যাশী হন, কিন্তু অপরপক্ষে অনীহা দেখান, তবে সে সম্পর্ক ধীরে ধীরে গুটিয়ে ফেলা বা সঙ্গীর প্রতি নির্ভরশীলতা কমিয়ে আনাই ভালো। কারণ ভালোবাসার সর্বগ্রাসী প্রকৃতির জন্য আবেগে বাঁধ দেয়া কঠিন। না হলে পরবর্তীকালে হৃদয়ভাঙার কষ্টটা আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে। এমনটিই মনে করেণ বিশেষজ্ঞরা। প্রকৃত ভালোবাসায় কমিটমেন্ট থাকবেই। যদি কেউ কোনো কারণে সম্পর্কের পরিণতি দিতে উৎসাহী না হন, তাহলে প্রেমের সম্পর্কে না জড়ানোই উত্তম। প্রেম করব কিন্তু বিয়ে নয়, এমন সম্পর্ক যেমন স্থায়ী হয় না, তেমনি আবার ভালোবাসা নেই কিন্তু কথা দিয়েছি এমন সম্পর্কও সুখের হয় না।
প্রেমের কোনো বয়স নেই। সাদা, কালো, ভাল, মন্দ এই সব প্রেম নির্বাচন করতে পারেনা। যে কোন বয়সে যার তার সঙ্গে প্রেমে পড়তে দেখা যায়।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান বললেন, সম্পর্ক দুপক্ষের ব্যাপার। অনেক সময় আমরা সাধারণ কথাবার্তাকে প্রেম বলে মনে করি। এটাকে কেউ যদি মনে করে তাদের মধ্যে প্রেম হয়ে গেছে তাহলে সেটা এক পক্ষের ভাবনা বা ভালোবাসা। প্রেমের ক্ষেত্রে ডেমোক্রেসি বা একটি কথা প্রচলিত আছে যেটাকে ‘ফ্রিডম অব চয়েস বলে’। এই ভ্যালুসের চর্চা আমাদের দেশে নেই। এটার খুব অভাব। আমরা আগে থেকে ভেবে নেই প্রস্তাব দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে সে রাজি হয়ে যাবে। এবং আমি যা বলবো সে তাই করবে। কিন্তু অপরপক্ষের ফ্রিডম অব চয়েস বলে কথা আছে। সে সময় নিতে পারে। কোনো কারণে হয়তো সে সরে যেতেও পারে। সেই অধিকার তার আছে। কাউকে বাধ্য করা এবং তার কথাই শুনতে হবে এগুলো স্বৈরাচারী কথা। স্বৈরাচারী শক্তি প্রয়োগ করে আর যাই হোক প্রেম হবে না। প্রেম বিষয়টি হচ্ছে দুজনের মিউচ্যুয়াল বিষয়। এটা কখনো এগোবে কখনো পেছাবে। প্রেমের ক্ষেত্রে প্রভিশনাল পিরিয়ড (প্রাথমিক পর্যায়) বলে একটি সময় থাকে। তখনই আমরা প্রেমে পড়ার মত ভুল কাজটি করে থাকি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম এম এ সালাউদ্দীন কাউসার বলেন, ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সোশ্যাল মিডিয়া ইত্যাদির সুবাদে এখন মানুষের কাছে অনেক বেশি তথ্য থাকে। এই কারণে মন ভাঙ্গার মত ঘটনা বেশি ঘটে। সোশ্যাল, মোরাল এবং আদর্শের যে বিষয়গুলো সেগুলো না থাকার কারণেও এটা হয়ে থাকে। আগে আমরা বাবা-মায়ের কথা শুনতাম। এখন আমরা ফেসবুক, ইন্টারনেটসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়ার হাজার হাজার ইনফরমেশন নেয়ার কারণে মোরাল ডেভেলপমেন্ট বা নীতিগত উন্নতি হচ্ছে না। আদর্শিক জায়গাটা নষ্ট হচ্ছে। ফলে কোনটি আদর্শ কোনটি সত্য বা মিথ্যা এই জ্ঞান আমাদের ছেলে মেয়েদের নেই। ছেলে মেয়েরা কনফিউসড হয়ে যায়। এনজয়মেন্টের বিষয়ে চলে আসে। কোনো কমিটমেন্ট নেই। কমিটমেন্টের জায়গাটি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এ সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে প্রথম যে কাজটি করতে হবে সেটা হল স্কুল-কলেজ, অভিভাবকত্ব সংস্কার করতে হবে। এমনকি ধর্ম এখানে বিশাল ভূমিকা রাখতে পারে।