খুলনা: খুলনার প্লাটিনাম জুট মিলের মেকানিক্যাল বিভাগের শ্রমিক সোহরাব (৫৫) মারা গেছেন। গতকাল সকাল সাড়ে ৭টায় তিনি খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক খলিলুর রহমান বলেন, প্লাটিনাম জুট মিলের মেকানিক্যাল বিভাগের শ্রমিক সোহরাব গতকাল সকালে মারা গেছেন। শ্রমিকদের অনশনকালে অসুস্থ হয়ে মনীষা ক্লিনিকে ভর্তি হন সোহরাব। সুস্থ হয়ে শনিবার মিলে কাজে যোগ দেন তিনি। নিউজপ্রিন্ট মিলগেটের বাসায় থাকা অবস্থায় অসুস্থ হলে ভোর সাড়ে ৬টায় খুমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয় তাকে। সেখানে চিকিৎসারত অবস্থায় সকাল সাড়ে ৭টায় তিনি মারা যান।
এর আগে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় খুলনায় আমরণ অনশনে অসুস্থ হয়ে প্লাটিনাম জুট মিলের তাঁত বিভাগের শ্রমিক আব্দুস সাত্তার (৫৫) মারা যান। গত মঙ্গলবার থেকে মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলের শ্রমিক।
রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে তারা এ অনশন কর্মসূচি পালন করেন। পরবর্তীকালে শ্রম প্রতিমন্ত্রী বেগম মন্নুজান সুফিয়ানের আহ্বানে শুক্রবার রাত সোয়া ১টায় তিনদিনের জন্য অনশন স্থগিত করেন শ্রমিকরা।
কাঁচা পাটের অভাবে খুলনার ৯টি পাটকলে উৎপাদন হ্রাস
ওদিকে পাটকল শ্রমিকদের ১১ দফা দাবির মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, পাট মওসুমে কাঁচা পাট ক্রয়ের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেয়া। অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় মিলগুলো কাঁচা পাট ক্রয় করতে পারে না। ফলে মিলগুলোতে কাঁচাপাটের ঘাটতি থেকে যায়। মিলগুলো দৈনিক ভিত্তিতে কাঁচা পাট কিনে উৎপাদন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় খুলনা অঞ্চলের মিলগুলোর উৎপাদন ৬৯ ভাগ হ্রাস পেয়েছে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) খুলনা অঞ্চলের ভারপ্রাপ্ত লিয়াজোঁ কর্মকর্তা বনিজ উদ্দিন মিঞা বলেন, ‘মিলগুলো যথাযথভাবে পাট কিনতে না পারার কারণে প্রয়োজনীয় উৎপাদন করতে পারছে না। এ কারণে মিলগুলোর উৎপাদন এক-তৃতীয়াংশে নেমে এসেছে’।
তিনি আরো বলেন, ‘উৎপাদন বন্ধ রেখে শ্রমিকদের অনশনের কারণে খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে প্রতিদিন প্রায় এক কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে। গত ৪ দিনে অনশনের কারণে প্রায় ৪ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) সূত্র জানায়, খুলনা অঞ্চলের রাষ্ট্রায়ত্ত ৯টি পাটকলে প্রতিদিন পাটজাত পণ্য উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২৭২ দশমিক ১৭ টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ৮৬ দশমিক ৩৯ টন। এর মধ্যে আলীম জুট মিলে দৈনিক উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ১০ দশমিক ৫০ টন। উৎপাদন হচ্ছে ৩ দশমিক ৬৩ টন। কার্পেটিং জুট মিলের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭ দশমিক ৬৮ টন, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ২ দশমিক ৯০ টন। ক্রিসেন্ট জুট মিলের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৭০ দশমিক ৫০ টন, উৎপাদন হচ্ছে ২৩ দশমিক ৬ টন। দৌলতপুর জুট মিলের উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ১১ টন, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ২ দশমিক ৪৫ টন। ইস্টার্ন জুট মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৩৪ টন, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৭ দশমিক ৯৭ টন। যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রিজে (জেজেআই) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ২২ দশমিক ২০ টন, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৮ দশমিক ১৫ টন। খালিশপুর জুট মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৪৭ দশমিক ৫০ টন, সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১২ দশমিক ৩০ টন। প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৫০ দশমিক ৫৪ টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ১৫ দশমিক ৯৮ টন। স্টার জুট মিলে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ৩৬ দশমিক ৮০ টন। সেখানে উৎপাদন হচ্ছে ৯ দশমিক ৯৫ টন।
খুলনা-যশোর অঞ্চলের ৯টি রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকলে দায়-দেনার পরিমাণ ১ হাজার ১৯৬ কোটি ৩২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। শ্রমিক-কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন বাবদ ১৪ কোটি ২৫ লাখ ৭১ হাজার টাকা, মজুরি বাবদ ৪৮ কোটি ১৪ লাখ ৩৬ হাজার টাকা পরিশোধ করা হয়েছে।
পাটকল সূত্রে জানা যায়, ৯টি মিলে পিএফ বাবদ ৯২ কোটি ৬৮ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, পাটের দেনা বাবদ ১৭৩ কোটি ৭০ লাখ ৫ হাজার টাকা, ব্যাংকের কাছে ৫৬২ কোটি ১৯ লাখ ৮৬ হাজার টাকা এবং অন্যান্য খাতে ৬৯ কোটি ৮৪ লাখ ৮৭ হাজার টাকা দেনা রয়েছে। সব মিলিয়ে মিলগুলোর দায়-দেনার পরিমাণ ১ হাজার ১৯৬ কোটি ৩২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা।
সূত্র জানায়, পাটকলগুলোর উৎপাদিত ৩০ হাজার ২০৭ টন পণ্য এখনো মজুত রয়েছে। যার মূল্য ২৭০ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। এসব কারণে মিলগুলো চরম আর্থিক সংকটে পড়েছে।
প্লাটিনাম জুট মিলের সিবিএ সভাপতি শাহানা শারমিন বলেন, ‘পাটকলগুলো আর্থিক সংকটে থাকায় শ্রমিকরা কাজ করেও নিয়মিত মজুরি পাচ্ছে না। আর এ কারণেই আন্দোলন করতে হচ্ছে।’
ক্রিসেন্ট জুট মিলের সিবিএ নেতা মো. মুরাদ হোসেন বলেন, ‘মূলত মজুরি কমিশন বাস্তবায়নের জন্যই আন্দোলন কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে।’
প্লাটিনাম জুট মিলের প্রকল্প প্রধান মো. গোলাম রব্বানী বলেন, ‘শ্রমিকরা কাজে যোগদানের সঙ্গে সঙ্গে কাঁচা পাট ক্রয়ের বিষয়টি চিন্তায় নিতে হয়েছে। কারণ কাঁচা পাট না থাকলে তো শ্রমিকরা কাজ করতে পারবে না। তাই কাঁচা পাট কেনার ওপর জোর দিতে হচ্ছে’।
স্টার জুট মিলের প্রকল্প প্রধান রইজ উদ্দিন আহম্মেদ জানান, মিলের শ্রমিকদের ১০ সপ্তাহ আর কর্মচারীদের ২ মাসের বকেয়া মজুরি ও বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। যা ৪ঠা ডিসেম্বরে শ্রমিকদের নিজ নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে চলে গেছে। শ্রমিকরা ওই টাকা উত্তোলনও করছেন। তবে কর্মকর্তাদের পাওনা টাকা মজুত পাট পণ্য বিক্রি করে পরিশোধ করা হবে। এ ছাড়াও ওই টাকা দিয়ে প্রয়োজনীয় কাঁচা পাট ক্রয়ের নির্দেশনাও রয়েছে।
উল্লেখ্য, মজুরি কমিশন বাস্তবায়নসহ ১১ দফা দাবিতে গত ১৭ই নভেম্বর ৬ দিনের কর্মসূচির ডাক দেয় রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদ। গত ২৫শে নভেম্বর থেকে কর্মসূচি শুরু হয়। ১০ই ডিসেম্বর থেকে আমরণ অনশন কর্মসূচি শুরু করে রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল শ্রমিকরা। রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল সিবিএ-নন সিবিএ সংগ্রাম পরিষদের ডাকে তারা টানা ৪ দিন অনশন কর্মসূচি পালন করে। আন্দোলনরত খুলনা অঞ্চলের পাটকলগুলো হচ্ছে, ক্রিসেন্ট জুট মিল, খালিশপুর জুট মিল, দৌলতপুর জুট মিল, প্লাটিনাম জুবিলী জুট মিল, স্টার জুট মিল, আলিম জুট মিল, ইস্টার্ন জুট মিল, কার্পেটিং জুট মিল ও যশোর জুট ইন্ডাস্ট্রি