গাজীপুর: ১৯৭১ সনের ১৫ ডিসেম্বর গাজীপুর হানাদার মুক্ত হয়। দীর্ঘ ৪৭ বছরেও আজকের এই দিনটিকে যথাযথভাবে পালন করা হয়নি। এই প্রথম গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম গাজীপুর মহানগরের ১ হাজার ২শ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দিলেন।
আজ রোববার সকাল ১১টায় গাজীপুর শহরের বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে এই অনাঢ়ম্বর সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত হয়।
গাজীপুর কর্পোরেশনের আয়োজনে অনুষ্ঠিত এই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র এডভোকেট মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, আপনারা জীবনের বিনিময়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন, আপনারা আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস-ঐতিহ্য ধরে রাখতে নগরীর প্রতিটি রাস্তা মুক্তিযোদ্ধাদের নামে হবে। সব মুক্তিযোদ্ধাদের হোল্ডিং ট্যাক্স ফ্রি করা হবে। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের কার্ড প্রদর্শন করলে নগরীর সকল সরকারি ও বেসরকারি হসপিটালে তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেয়া হবে। তাদের সন্তানদের চাকুরী, ব্যবসা ও কর্মসংস্থানে সহযোগিতা করা হবে। এ নগরীতে কেউ বেকার থাকবে না।
রবিবার সকালে শহরের বঙ্গতাজ অডিটরিয়ামে গাজীপুর মহানগরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে মেয়র এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে ম্ুিক্তযোদ্ধাদের পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন মুক্তিযোদ্ধা আব্দুস সাত্তার মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রউফ নয়ন, মুক্তিযোদ্ধা মো: মহর আলী, মুক্তিযোদ্ধা ইমান উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান, মুক্তিযোদ্ধা মো: লিয়াকত আলী, মুক্তিযোদ্ধা আবু হানিফ, মুক্তিযোদ্ধা ডা: মোজাফ্ফর আহমেদ প্রমুখ।
মেয়র বলেন, প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধাদের উপহার ও শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি পরিবারকে ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হবে। কোন অস্বচ্ছল মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি নির্মাণ করে দেয়ারও সহযোগিতা করা হবে। গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সব সময় যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান দেখাতেই এই অনুষ্ঠানে কাউকে প্রধান বা বিশেষ অতিথি করা হয়নি, মুক্তিযোদ্ধারাই আজকের অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও বিশেষ অতিথি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্যে গাজীপুরে আন্তর্জাতিক মানের একটি হাসপাতাল এবং মুক্তিযুদ্ধ গবেষণাগার গড়ে তোলার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধমন্ত্রীর প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
পর্যালোচনায় দেখা যায়, ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চের আগে ১৯ মার্চ গাজীপুরে প্রথম স্বশস্ত্র প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হয়। আর ১৬ ডিসেম্বরের আগের দিন ১৫ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করে গাজীপুরকে হানাদার মুক্ত করা হয়। এই জন্যই গাজীপুরকে বলা হয় শুরুর আগে শুরু আর শেষের আগে শেষ করার গৌরবোজ্জ্বল গাজীপুর। আর এই দুটি ঐতিহাসিক যুদ্ধে যারা অংশ গ্রহন করেছিলেন তাদের বলা হয় বীর সেনানী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দুটি দিন বিশেষ স্থান দখল করে আছে। কিন্তু বিগত সময়ে এই দুটি দিন যথাযথভাবে পালিত হয়নি। কয়েক বছর ধরে ১৯ মার্চ পালিত হয়। কিন্তু ১৫ ডিসেম্বর তেমনভাবে পালিত হয়নি। তবে স্বাধীনতার ৪৭ বছর পর এই প্রথম ১৫ ডিসেম্বরে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের আয়োজনে গাজীপুর মহানগরের ১ হাজার ২শ শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবার ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের সংবর্ধনা দেয়া হল।
১৯৭১ সালের ঐতিহাসিক ১৫ ডিসেম্বরের পটভূমি:
১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সূতিকাগার জয়দেবপুর যা বর্তমানে গাজীপুর। ওই দিন পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলে জয়দেবপুরবাসী। সে দিন শহীদ হন নিয়ামত, হুরমত, মনু খলিফা আর আহত হন অনেকে। সারাদেশে সে দিন স্লোগান উঠেছিল ‘জয়দেবপুরের পথ ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন কর’।
১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে গাজীপুরবাসীর রয়েছে বীরত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা। ২৫ মার্চ কালরাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনী বাঙালিদের ওপর অতর্কিতে হামলা করার পর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে গাজীপুরের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মী, ছাত্র, শ্রমিক-জনতা ভারতে চলে যান। ভারতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ শেষে তারা এলাকায় এসে বিভিন্ন পয়েন্টে অপারেশনে অংশগ্রহণ করেন। নভেম্বর মাসে এলাকায় পাক হানাদার বাহিনীর অবস্থানের ওপর মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালায়। ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী তাদের আক্রমণ আরো জোরদার করে। ১৩-১৪ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা গাজীপুর সেনানিবাসে সম্মিলিতভাবে আক্রমণ চালায়। এতে পাক হানাদার বাহিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে পাক বাহিনী গাজীপুর ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। গাজীপুর এবং সমরাস্ত্র কারখানা ও রাজেন্দ্রপুর অর্ডিন্যান্স ডিপো থেকে পাক হানাদাররা ঢাকার পথে চান্দনা চৌরাস্তায় জড়ো হতে থাকে।
এ ছাড়া দেশের উত্তরাঞ্চল অর্থাত্ ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল থেকে আসা পাক হানাদাররা মিত্র ও মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে টিকতে না পেরে ঢাকার দিকে পিছু হটতে থাকে। তারাও টাঙ্গাইল সড়কযোগে এসে চান্দনা চৌরাস্তায় একত্রিত হতে থাকে। সেখানে আসার সময় তারা কড্ডা ব্রিজ ধ্বংস করে দেয়। ফলে পিছু ধাওয়াকারী মিত্র ও কাদেরিয়া বাহিনী কোনাবাড়ী হয়ে কাশিমপুরে অবস্থান নেয়। চান্দনা চৌরাস্তায় জড়ো হওয়া পাক হানাদার বাহিনীর বিরাট একটি কনভয় ঢাকার দিকে রওনা দেয়। পথে ছয়দানা এলাকায় পৌঁছলে কাশিমপুর থেকে মিত্র ও কাদেরিয়া বাহিনী তাদের উপর কামান ও মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। একই সাথে সড়কের দুই পাশ থেকে প্রবল গুলিবর্ষণে পাক হানাদার বাহিনী একেবারে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। হতাহত হয় অনেক পাক সেনা। পাক বাহিনীর ওপর গোলাবর্ষণ ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। পাক হানাদার বাহিনীর পর্যুদস্ত হওয়ার পর মূলত ওই দিনই গাজীপুর মুক্ত হয়। প্রতি বছরই নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এ দিবসটি পালন ও শহীদদের স্মরণ করা হয়ে থাকে।
আজ কালীগঞ্জ ও পূবাইলও হানাদার মুক্ত হয়:
১৯৭১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পাক-হানাদার মুক্ত হয় গাজীপুরের কালীগঞ্জ ও পূবাইল এলাকা। টানা তিন দিন যুদ্ধ শেষে পাক-হানাদাররা মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে যুদ্ধে নিহত হয় শতাধিক পাকসেনা। বিজয়ের একদিন আগে ওই এলাকা হানাদার মুক্ত হলেও তারা ধ্বংস করে ও আগুন জ্বালিয়ে নিশ্চিহ্ন করে দেয় বহু গ্রাম, নির্বিচারে হত্যা করে শত শত মানুষকে আর ইজ্জত কেড়ে নেয় অনেক মা- বোনের।
টঙ্গী থেকে কালীগঞ্জ পর্যন্ত তখন একমাত্র রেলপথ ছাড়া যোগাযোগের আর কোনো মাধ্যম ছিল না। তাই পাক বাহিনী সর্বশেষ তাদের ঘাঁটি স্থাপন করে পূবাইল রেলস্টেশন ও তার আশপাশসহ পূর্ব দিকে কালীগঞ্জের সীমানায় বালু নদীর ব্রিজ পর্যন্ত এলাকাজুড়ে। ওই এলাকার বহু গ্রামের ঘরবাড়ি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় পাক সেনারা। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় কালীগঞ্জের বাড়িয়া ইউনিয়নের বাড়িয়া গ্রামটি। পাক হানাদার বাহিনী এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় ওই গ্রামে ঢুকে শতাধিক নারী-পুরুষকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। গ্রামটিতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বসবাস ছিল। এ ছাড়াও ভাদুন, ছোট কয়ের, সোড়ল, নয়ানীপাড়া, সাপমাড়া, পূবাইল বাজারসহ কালীগঞ্জের কয়েকটি গ্রাম পুড়িয়ে দেয় পাক সেনারা। ১১ ডিসেম্বর থেকে ভারতীয় মিত্র বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তায় নরসিংদী থেকে রেলযোগে কালীগঞ্জে ঢুকতে শুরু করে। ১৩ ডিসেম্বর কালীগঞ্জের বান্দাখোলা এলাকা থেকে গ্রুপ কমান্ডার বদরুজ্জামান খসরু ও বাতেন মোল্লার গ্রুপ এবং রূপগঞ্জের একটি দল ভারতীয় বাহিনীর সাথে একত্রিত হয়ে পূবাইলে অবস্থিত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নেয়। পরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী পাক হানাদার বাহিনীকে ভালোভাবে মোকাবেলার জন্য অবস্থান নেয় কালীগঞ্জের নলছাটায়। গ্রুপ কমান্ডার বাতেনের দল অবস্থান নেয় নলছাটা থেকে বাড়িয়া হয়ে তিতারকুল পর্যন্ত এলাকাজুড়ে। তারা জয়দেবপুর অর্ডিন্যান্সে অবস্থানরত পাক সেনাদের প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ স্থানসমূহে ওঁত্ পেতে থাকেন। ওই অবস্থায় একটানা ৩ দিন মুক্তি ও মিত্র বাহিনী মর্টার শেল ও কামানের গোলার আক্রমণে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় পাক সেনাদের পূবাইল ঘাঁটি। এতে নিহত হয় শতাধিক পাক সেনা। পরে ১৫ ডিসেম্বর বেলা ১২টার দিকে পাক সেনারা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। মিত্র বাহিনীর পক্ষে গ্রুপ কমান্ডার বদরুজ্জামান খসরু আহত হন এবং নিহত হন ৩ জন ভারতীয় সৈন্য।