মোঃ জাকারিয়া, গাজীপুর: চলতি বছরের আগষ্ট মাস থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সাড়ে ৪মাসে গাজীপুর মহানগরের প্রায় একই এলাকায় ৩ হাজার ৩৬ জন মানুষ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। চলতি এক সপ্তাহের মধ্যেই আক্রান্ত হয়েছেন ৪৩৪জন। এর মধ্যে মারা গেছেন ৪জন। এই অবস্থায় ঘটনা তদন্তে গঠিত হয়েছে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটিও।
জানা যায়, ডায়রিয়ার কারণ ও প্রতিরোধ মূলক ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রন ও গবেষনা ইনষ্টিটিউট (আইইডিসিআর) ৫ সদস্য বিশিষ্ঠ তদন্ত কমিটি গঠন করে মাট পর্যায়ে কাজ শেষে ৩ কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। ৫সদস্য বিশিষ্ঠ তদন্ত কমিটির প্রধান হলেন, আইইডিসিআর’র মেডিকেল অফিসার ডাঃ অনুপম সরকার। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন, ডাঃ দেবাশীষ কুমার সাহা, ডাঃ শাহাদাত হোসেন, ডাঃ জিন্নাত ই আলম ও মোঃ আবু সাঈদ। তদন্ত কমিটি ইতোমধ্যে পানি সংগ্রহ করে পরীক্ষাগারে পাঠিয়েছেন।
শনিবার সরেজমিন অনুসন্ধান করে এই তথ্য জানা যায়।
প্রপ্ত তথ্যমতে, ৮ ডিসেম্ব থেকে হঠাৎ করে গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের ২৭ ও ২৯ নং ওয়ার্ড এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়। ৮ থেকে ১৪ ডিসেম্বর পর্যন্ত শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ৪৩৪জন ডায়রিয়ার রোগী ভর্তি হয়। এদের মধ্যে গণমাধ্যমে ৫ জনের মৃত্যুর খবর আসলেও ৪ জনের মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এক জনের মৃত্যুর খবর জানেন বলে জানিয়েছেন। তবে ওই মৃত্যুর কারণ ডায়রিয়া না ক্যান্সার তা এখনো নিশ্চিত নয়।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে মৃতদের পরিচয় পাওয়া গেছে। ডায়রিয়ায় মৃত গাজীপুর মহানগরের ২৭ নং ওয়ার্ডের ৩৪/৩ পূর্বচান্দনার আলী আকবর শেখের স্ত্রী সুমা আক্তার(৩২)। গ্রামের বাড়ি গাজীপুর জেলার কালিগঞ্জ উপজেলার জাঙ্গালিয়া ইউনিয়নের মরাশ গ্রামে। সুমার ভাশুর মোঃ সিদ্দিকুর রহমান জানান, ৯ডিসেম্বর ভোররাতে সুমা ও সিদ্দিকুর রহমানের শাশুড়ি ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়। তাদের গাজীপুর শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। হাসপাতালের বারান্দায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় সুমার অবস্থার অবনতি হলে সন্ধ্যায় ঢাকার মহাখালী কলেরা হাসপাতালে স্থানান্তরের নির্দেশ দেয়া হয়। মহাখালী নেয়ার পর ওই দিনই রাত পৌনে ৮টায় ডাক্তাররা তাকে মৃতু ঘোষনা করেন। সিদ্দিকুর রহমান জানান, ঢাকায় নেয়ার পথেই তার ছোট ভাইয়ের স্ত্রী সুমা মারা যায়। অতঃপর গ্রামের বাড়িতে তার লাশ দাফন করা হয়েছে।
ডায়রিয়ার মারা যাওয়া আব্দুস সালাম(৬০) একজন মাটি কাটা শ্রমিক। তিনি ১৩১ পূর্বচান্দনা এলাকার সাবেদা বেগমের বাড়ির ভাড়াটিয়া ছিলেন। ভাড়ির মালিকের ছেলে ভাই ভাই জেনারেল ষ্টোরের মালিক মোঃ আলী জানান, তাদের বাড়ির ভাড়াটিয়া আব্দুস সালাম ৯ডিসেম্বর রাতে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেলে ভর্তি হয়। ১১ ডিসেম্বর ঢাকার মহাখালী কলেরা হাসপাতালে নেয়ার পথে তার মৃত্যু হয়। অতঃপর তার লাশ গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়া হয়েছে দাফনের জন্য।
গাজীপুর মহানগরের ছোট দেওড়া এলাকার ৩৯ কাজি বাড়ির আবুল হোসেনের বাড়ির ভাড়াটিয়া খেছু মিয়া(৬০) ৯ডিসেম্বর রাতে ডায়রিয়ায় অসুস্থ হয়ে শহীদ তাজউদ্দীন হাসপাতালে ভর্তি হয়। পরদিন সকালে তার মৃত্যু হয়। খেছু মিয়ার লাশ তার গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। খেছু মিয়ার দরজা খোলা রুমে বিছানার সাথে সেলাইন ঝুলে থাকতে দেখা যায়।
৩০/৭ ছোট দেওড়া এলাকার মোস্তফা কামালের বাড়ির ভাড়াটিয়া কামরুন্নাহার বেগম(১৮) ৮ডিসেম্বর বিকাল ৩টার দিকে ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হলে তার স্বামী মোজাম্মেল হক ও প্রতিবেশী শিউলি আক্তার রোগীকে শহীদ তাজউদ্দীনে নিয়ে যায়। ৯ডিসেম্বর ভোররাতে শহীদ তাজউদ্দীনের ৭তল তলার বারান্দায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় কামরুন্নাহার মারা যায় বলে জানিয়েছেন শিউলী আক্তার। কামরুন্নাহারের লাশ দাফন করার জন্য তার গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ইশ্বরগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন কামরুন্নাহারের প্রতিবেশী ভাড়াটিয়ারা। ৭/৮ মাস আগে কামরুন্নাহারের বিয়ে হয়েছে বলে জানান প্রতিবেশীরা। বিয়ের পর স্বামী গাজীপুরের একটি তেলে পাম্পে শ্রমিকের কাজ করার সুবাধে এই বাসায় ভাড়া থাকতেন।
গাজীপুরস্থ শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচালক ডাঃ আমীর হোসাইন রাহাত জানান, আগষ্ট মাস থেকে আজ পর্যন্ত মোট ৩০৩৬ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের যথাযথ চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। আজও ৫০ জন রোগী ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এই পর্যন্ত সাড়ে ৪ মাসে ৫৩০০ স্যালাইন দেয়া হয়েছে। উন্নত চিকিৎসার জন্য ৮জনকে মহাখালীতে পাঠানো হয়েছে। এখনো রোগী আসার কারণে প্রয়োজনীয় সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। আরো ২ হাজার স্যালাইনের জন্য চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে। তিনি এই প্রকোপ মোকাবেলায় সব ধরণের প্রস্তুতি নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
ডাঃ রাহাত আরো জানান, সম্প্রতি ডায়রিয়ার প্রকোপ বৃদ্ধি পাওয়ায় নিয়মিত রোগীদের চিকিৎসার খোঁজ খবর নিচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল ও গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের মেয়র আলহাজ জাহাঙ্গীর আলম।
গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের মেয়র জাহাঙ্গীর আলম বলেছেন, হঠাৎ ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়ায় আক্রান্ত এলাকায় বিশেষ ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাবার স্যালাইন ও সচেতনতামূলক লিফলেট বিতরণ, মাইকিং সহ সব ধরণের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। সিটিকরপোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মাঠে কাজ করছেন।
এলাকাবাসী অভিমত,গাজীপুর মহানগরের একটি নিদিষ্ট এলাকায় হঠাৎ করে ডায়রিয়ার প্রকোপ দেখা দেয়ায় জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে ডাক্তাররা বলছেন, রোগে আক্রান্ত রোগী হাসপতালে ভর্তি হলে চিকিৎসা দেয়া হয়। চিকিৎসায় গাফিলতি হলে দায় হাসপাতালের। তবে ডায়রিয়া ও কলেরার মত রোগ মহামারী আকারে যেন আসতে না পারে, সেজন্য স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেয়। এলাকাবাসী বলছেন, কবরস্থান এলাকায় পানির পাম্প থাকায় কোন সমস্যা হল কি না, সেটাও দেখা দরকার।