ডেস্ক: প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আনোয়ার ইব্রাহিমের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ড. মাহাথির মোহাম্মদ। আনোয়ার ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে সম্প্রতি তৃতীয়বারের মতো সমকামিতা ও যৌন নির্যাতনের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। অনেক পর্যবেক্ষক সন্দেহ করছেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বই এখানে মূল কারণ। মাহাথির মোহাম্মদ নির্বাচনপূর্ব চুক্তি অনুযায়ী ক্ষমতা ত্যাগ করে আনোয়ারের হাতে আদৌ হস্তান্তর করবেন কিনা, তা নিয়ে ধোয়াসা সৃষ্টি হয়েছে। তবে বিশ্বের ক্ষমতাসীনদের মধ্যে সবচেয়ে প্রবীন সরকার প্রধান ড. মাহাথির রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, আনোয়ারের বিরুদ্ধে যে অভিযোগই আসুক না কেন, তিনিই হবেন তার উত্তরসূরি। ৯৪ বছর বয়সী মাহাথির অবশ্য বলেছেন, আগামী বছরের নভেম্বরে অনুষ্ঠেয় এশিয়া প্যাসিফিক ইকোনমিক কোঅপারেশন (আপেক) সম্মেলনের আগে তিনি ক্ষমতা ছাড়বেন না।
তিনি বলেন, ‘আমি ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি সেটাই করবো। তবে আমি মনে করি, আপেক সম্মেলনের পূর্বে ক্ষমতায় পরিবর্তন বিঘ্ন সৃষ্টি করবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমার ক্ষেত্রে আমি বলতে পারি যে, আমি পদত্যাগ করছি।
আমি ব্যাটন তার হাতে ছেড়ে দেবো। মানুষ যদি তাকে না চায়, সেটা মানুষের ব্যাপার। কিন্তু আমি আমার দেওয়া কথা রাখবো, যে অভিযোগই উঠুক না কেন। আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছি। আমি প্রতিশ্রুতি রাখবো।’
তাহলে কি ২০২০ সালের ডিসেম্বর নাগাদ ক্ষমতায় পরিবর্তন আসছে? এই প্রশ্নের সরাসরি জবাব না দিয়ে মাহাথির বলেছেন, সময় আসলে দেখা যাবে।
প্রসঙ্গত, মাহাথির মোহাম্মদ ও আনোয়ারের মধ্যে সম্পর্কের উঠানামা দীর্ঘদিনের। একসময় মাহাথিরের শিষ্য ও পরবর্তী উত্তরাধিকার ছিলেন আনোয়ার। ১৯৮১ থেকে ২০০৩ পর্যন্ত ২২ বছর ক্ষমতায় ছিলেন মাহাথির। ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৮ পর্যন্ত তার উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন আনোয়ার। তবে পরে দু’ জনের মধ্যে মনোমালিন্য হলে আনোয়ারকে সরে যেতে হয়। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগ ওঠে। এরপর মাহাথির স্বেচ্ছায় ক্ষমতা ছাড়ার পর ক্ষমতায় আসা নাজিব রাজাকও আনোয়ারকে সমকামিতার দ্বিতীয় অভিযোগে জেলে পাঠান। তবে নাজিব রাজাকের বিরুদ্ধেই অবশেষে দীর্ঘদিনের বিরতি ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে মাঠের রাজনীতিতে আসেন মাহাথির। মনোমালিন্য ভুলে জোট গড়েন পুরোনো শিষ্য আনোয়ারের সঙ্গে। এভাবেই ক্ষমতায় আসেন তারা। নির্বাচনের আগে দু’ পক্ষের মধ্যে সমঝোতা হয় যে, মাহাথির অর্ধেক ক্ষমতায় থাকবেন। বাকি অর্ধেক সময় আনোয়ার।
মাহাথির ক্ষমতায় আসার পর আনোয়ার দেশের রাজার ক্ষমায় জেল থেকে মুক্তি পান। আনোয়ারের স্ত্রী হন উপ প্রধানমন্ত্রী। তবে মাহাথিরের ঘনিষ্ঠ কারও কারও সঙ্গে আনোয়ারের বিরোধ তুঙ্গে। এছাড়া মাহাথির নিজেও ইঙ্গিত দিয়ে বলেছেন যে, মালয়েশিয়া এখন ব্যাপকভাবে ঋণগ্রস্ত। এই দেশকে ঠিক করতে একটু সময় লাগবে। ফলে অনেকেই আনোয়ারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন। এরই মাঝে আনোয়ারের বিরুদ্ধে গত সপ্তাহে তৃতীয়বারের মতো সমকামিতা ও যৌন নিগ্রহের অভিযোগ আনেন তারই সাবেক সহকারী। আনোয়ার অবশ্য এই অভিযোগকে জোর গলায় উড়িয়ে দিয়েছেন।
পুত্রজয়ায় দেওয়া ওই সাক্ষাৎকারে মাহাথির অবশ্য এও বলেছেন যে, এত বয়স হওয়া সত্ত্বেও তিনি একদমই ক্লান্ত বোধ করছেন না। তার ভাষ্য, ‘আমি কিছু হালকাপাতলা অনুশীলন করার চেষ্টা করি। তবে আমি মূলত আমার ওজন ঠিক রাখার চেষ্টা করি সবসময়। আমার ওজন গত ৩০-৪০ বছর ধরে ৬২ কেজি। এটি পরিবর্তন হয় না। আমি খুব বেশি খাই না। বেশি খাই না।’
আগামী বছর মালয়েশিয়ায় আপেক সম্মেলন হওয়ার কথা রয়েছে। মাহাথির সেক্ষেত্রে হতে যাচ্ছেন বিশ্বের প্রথম নেতা যিনি দ্বিতীয়বারের মতো আপেক সম্মেলন আয়োজন করবেন। মাহাথির মূলত মুসলিম বিশ্বের অন্যতম নেতা হিসেবে তার দীর্ঘদিনের যে মর্যাদা, সেটির একটি স্থায়ী রূপ দিতেই বেশি আগ্রহী। আগামী সপ্তাহে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে ইরান, পাকিস্তান, তুরস্ক ও অন্যান্য মুসলিম দেশের নেতারা যোগ দেবেন। মাহাথির বলেন, এই সম্মেলনে সেসব পরিস্থিতির ওপর জোর দেওয়া হবে যেখানে মুসলিমরা বেশি নির্যাতিত হচ্ছেন। এর মধ্যে রয়েছে চীনের শিনজিয়াং অঞ্চলে উইঘুর মুসলিমদের নির্যাতন। তিনি বলেন, ‘একটি অবস্থান নেওয়া এক জিনিস। কিন্তু পরিস্থিতি উন্নতিতে কিছু করা আরেক জিনিস। আমরা হয়তো একটা অবস্থান নিলাম, যার ফলে আরও বেশি চাপ প্রয়োগ হলো। কিন্তু এতে আমাদের খুব একটা উন্নতি হবে না।’
তার ভাষ্য, ‘আজ মুসলিম বিশ্ব কাউকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে না। আমরা খুব দুর্বল। যে কেউই আমাদের ব্যবহার করতে পারে। একে অপরের বিরুদ্ধে লড়াই করাতে পারে। আমরা এমনই।’
ওই সাক্ষাৎকারে উইঘুর ইস্যু ছাড়াও, রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে মিয়ানমারের কড়া সমালোচনা করেছেন তিনি। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে যে গণহত্যার অভিযোগে বিচারকার্য চলছে, সে ব্যাপারে মাহাথির বলেন, ‘আমরা আশা করি মিয়ানমার ব্যাখ্যা দিতে পারবে ও মেনে নেবে যে একটি গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। আমরা আশা করি যে, আন্তর্জাতিক জনমতের প্রেক্ষিতে তাদেরকে জবাব দিতে হবে।’