মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠির ওপর গণহত্যা বন্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতের (আইসিজে) আদেশ চেয়েছে গাম্বিয়া। মিয়ানমারে বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের গণহত্যার সনদ লঙ্ঘনের অভিযোগে ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে মামলা করা দেশটি একইসাথে রোহিঙ্গাদের ওপর বিচারবহির্ভূত হত্যা, ধর্ষন, অগ্নিসংযোগ, নিপীড়ন, জীবিকা ধ্বংস ও নিপীড়ন বন্ধে আন্তর্জাতিক এ আদালতের কাছে অন্তবর্তীকালীন পদক্ষেপ চেয়েছে। গাম্বিয়া বলেছে, এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়ার পূর্ণ এখতিয়ার আইসিজের রয়েছে।
মঙ্গলবার নেদারল্যান্ডসের দ্য হেগে আইসিজেতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার শুনানীর প্রথম দিনে গাম্বিয়া আদালতের এ আদশে চায়। ‘বিশ্ব আদালত’ নামে পরিচিত জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ এই আদালত ১৫ জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত, যারা নিরাপত্তা পরিষদ বা সাধারণ পরিষদ দ্বারা নির্বাচিত। আইসিজেতে গাম্বিয়া বা মিয়ানমারের কোনো বিচারক নেই। তাই শুনানীর প্রথম দিন গাম্বিয়ার পক্ষে দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিক নাভা নেডাম পিলাই এবং মিয়ানমারের পক্ষে জার্মান নাগরিক ক্লাউস ক্রেসকে এডহক বিচারক হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করানো হয়। নেডাম পিলাই জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের বিচারক হিসাবে কাজ করেছেন। তিনি জাতিসঙ্ঘ মানবাধিকার সংস্থার হাইকমিশনারের দায়িত্বে ছিলেন। অন্যদিকে ক্লাউস ক্রেস আন্তর্জাতিক ও অপরাধ আইনের অধ্যাপক। তিনি জার্মান বিচার মন্ত্রণালয়ের পরামর্শক ছিলেন।
শুনানীর প্রথম দিন গাম্বিয়া বক্তব্য উত্থাপন করে। বুধবার বক্তব্য রাখবে মিয়ানমার। আর বৃহষ্পতিবার গাম্বিয়া ও মিয়ানমার উভয়েই পাল্টাপাল্টি যুক্তিতর্ক উত্থাপনের সুযোগ পাবে। এরপর আইসিজে ছয় থেকে আট সপ্তাহের মধ্যে অন্তবর্তীকালীন পদক্ষেপের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে।
শুনানীতে মিয়ানমার প্রতিনিধি দলের প্রধান হিসাবে দেশটির ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতা ও রাষ্ট্রীয় পরামর্শক অং সান সু চি উপস্থিত ছিলেন। এই শুনানীতে গাম্বিয়াকে সহযোগিতা দিচ্ছে বাংলাদেশ, কানাডা ও নেদারল্যান্ডস।
গত ১১ নভেম্বর গাম্বিয়া গণহত্যার সনদ ভঙ্গের অভিযোগে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আইসিজেতে মামলা দায়ের করে। গাম্বিয়ার অভিযোগ, মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা চালানো হয়েছে, যার প্রক্রিয়া আজো অব্যাহত রয়েছে।
আইসিজে জাতিসঙ্ঘ নিরাপত্তা পরিষদ ও সাধারন পরিষদের অবিচ্ছেদ্দ অঙ্গ। আইসিজের রায় বাস্তবায়ন সনদ স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর জন্য বাধ্যতামূলক। চূড়ান্ত রায়ের পর আপিলের কোনো সুযোগ নেই। তবে আন্তর্জাতিক আইনের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা পরিষদ ছাড়া রায় কার্যকরের অন্য কোনো পদ্ধতি নেই।
শুনানীতে গাম্বিয়ার প্রতিনিধি দলের প্রধান (এজেন্ট) দেশটির বিচারমন্ত্রী ও আটর্নি জেনারেল আবুবাকার তামবাদু প্রারম্ভিক বক্তব্য উত্থাপন করেন। এরপর তার প্রতিনিধি দলের সদস্য প্রফেসর পায়াম আকাবান, আন্দ্র লুইন্স, মিজ তাফাসুয়া, আরসালান সুলেমান ও প্রফেসার ফিলিপ সান গাম্বিয়ার দাবির পক্ষে যুক্তি-তর্ক উত্থাপন করেন।
তামবাদু বলেন, আজ আমি আপনাদের সামনে দাড়িয়েছি বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করতে। বিশ্বের ইতিহাসে সব গণহত্যাই একটি নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে সংগঠিত হয়েছে। আকশ্মিকভাবে তা হয়নি। এটা সন্দেহ, অবিশ্বাস ও মিথ্যা প্রচারের মধ্য দিয়ে শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর আর একটি গণহত্যা সংঘঠিত হয়েছে। তিনি বলেন, ওআইসির পক্ষে আমি কক্সবাজার সফর করেছি। রোহিঙ্গাদের সাথে কথা বলে আমি গণহত্যার গন্ধ পেয়েছি। ১৯৯৪ সালে রুয়ান্ডার গণহত্যার জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে প্রসিকিউটর হিসাবে এ ধরনের কাহিনী শোনার অভিজ্ঞতা আমার রয়েছে।
গাম্বিয়ার বিচারমন্ত্রী বলেন, যে কোনো গণহত্যায় দুটি দিক থাকে। প্রথমত, অমানবিক কর্মকান্ড। দ্বিতীয়ত, বিশ্বের নিরবতা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিটি দিনের নিরবতা রোহিঙ্গা পরিস্থিতিকে আরো নাজুক করে তুলেছে। শেষ পর্যন্ত গণহত্যার শিকার হয়ে তাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে।
বিশ্ব কোন রোহিঙ্গা গণহত্যার নিরব সাক্ষী হয়ে রইবে প্রশ্ন রেখে তামবাদু বলেন, আমরা জাতিসঙ্ঘের সর্বোচ্চ আদালতে এসেছি। এই আদালত দশকের পর দশক ধরে মানবতার মূল্যবোধকে সমুন্নত রেখেছে। নিপীড়িত ও দুর্বলদের পক্ষে আইসিজে দাড়াবে – এটা আমার প্রত্যাশা। তিনি বলেন, মিয়ানমারকে গণহত্যা বন্ধ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ দিতে হবে। রোহিঙ্গা শিশুদের শিক্ষা ও ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
জাতিসঙ্ঘের সনদ অনুযায়ী গণহত্যা বন্ধে সদস্য রাষ্ট্রগুলো সম্ভব সবকিছু করবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে প্রফেসার আকাবান বলেন, মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে জাতিসঙ্ঘের তথ্যানুসন্ধান মিশনের প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যার বড় ধরনের ঝুঁকি রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যা আইসিজের বিবেচনার জন্য দেয়া হয়েছে। এর ভিত্তিতে আমি অন্তবর্তীকালীন পদক্ষেপ চাইছি। তিনি বলেন, জাতিসঙ্ঘে তথ্যানুসন্ধান মিশন দুই বছর তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহের পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর এই প্রতিবেদন দিয়েছে। এ সময় এক হাজারের বেশী মানুষের সাক্ষ্য নেয়া হয়েছে। প্রচুর ডকুমেন্ট পর্যালোচনা করা হয়েছে। তবে মিয়ানমার এই মিশনকে প্রবেশাধিকার দেয়নি। কিন্তু তাতে একটি নিরপেক্ষ তদন্ত প্রতিবেদন দিতে মিশনের সমস্যা হয়নি।
প্রফেসার আকাবান বলেন, অবৈধ বাঙ্গালী, সন্ত্রাসবাদী ও জঙ্গি হিসাবে আখ্যা দিয়ে মিয়ানমার পরিকল্পিতভাবে রোহিঙ্গাবিরোধী অপপ্রচার চালিয়েছে, যা ২০১৭ সালের আগস্টে ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রুপ নেয়। এই অভিযানে রোহিঙ্গা নারী, শিশু, বৃদ্ধ কেউ রেহাই পায়নি। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে খুঁজে হত্যা করা হয়েছে। গ্রামসহ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে নিশ্চিহ্ন করতে বিশেষ করে শিশুদের টার্গেট করে হত্যা হয়েছে। ব্যাপকভিত্তিতে গণধর্ষন চালানো হয়েছে। রোহিঙ্গাদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ নাফ নদী দিয়ে বাংলাদেশে ভেসে এসেছে।
প্রফেসার আকাবান বলেন, মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর পরিকল্পিত এ অভিযানে গণহত্যার অভিপ্রায়ের পরিষ্কার উপাদান রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ তথ্যানুসন্ধান মিশনের পাশাপাশি মানবাধিকার বিষয়ক জাতিসঙ্ঘের স্পেশাল রেপোর্টিয়ার ইয়াংহি লি গণহত্যার জন্য মিয়ানমার সেনা প্রধানসহ অধিনায়কদের দায়ী করেছেন। ‘তাকমাদো’ হিসাবে পরিচিত মিয়ানমারের সেনাবাহিনী চরম বর্বরতা চালিয়েছে। রাষ্ট্র তাদের নিবৃত্ত করতে পদক্ষেপ নেয়নি। রোহিঙ্গাদের জাতিগতভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করা হয়েছে। এরপর অপরাধের আলামত ধ্বংসের জন্য বুলডোজার দিয়ে ৩৯২টি রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রাম সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে ধ্বংস করা হয়েছে। এখনো রাখাইনে রয়ে যাওয়া ছয় লাখ রোহিঙ্গার জরুরি সহায়তা প্রয়োজন। তারা গণহত্যার বড় ধরনের ঝুঁকিতে রয়েছে।
আন্দ্র লুইন্স বলেন, মিয়ানমারের জাতিগত বিশুদ্ধতার জন্য রোহিঙ্গাদের হুমকী হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তাদের ধারণা গাড় চামড়ার মুসলিম রোহিঙ্গারা জনসংখ্যার দিক থেকে মিয়ানমারের জাতিগত ভারসাম্যকে নষ্ট করে দেবে। রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পরিকল্পিতভাবে বিদ্বেষমূলক প্রচারণা চালানো হয়েছে। এ জন্য ফেসবুকও ব্যবহার করা হয়েছে। এতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে হিটলারের মত ইহুদী নিধন অভিযানকে অনুসরন করতে উৎসাহিত করা হয়েছে।
শুনানীতে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে উত্তর রাখাইনে মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর পরিচালিত গণহত্যার, ধর্ষণ ও নৃশংসতার সুনির্দিষ্ট কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়।
মিজ তাফাসুয়া বলেন, জাতিসঙ্ঘ তথ্যানুসন্ধান দলের প্রতিবেদনে মিয়ানমারের গণহত্যার অভিপ্রায়ের আলামত রয়েছে। এই আলামত গণহত্যা বিষয়ক জাতিসঙ্ঘ সনদের পরিষ্কার লঙ্ঘন।
তিনি রাখাইনের অভ্যন্তরীণভাবে বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের (আইডিপি) জন্য তৈরী করা ক্যাম্পগুলোর মানবেতর জীবনের চিত্র তুলে ধরেন, যেগুলোতে এক লাখ ২০ হাজার রোহিঙ্গা রয়েছে। তাফাসুয়া বলেন, রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে প্রবেশাধিকার ব্যাপকভাবে সীমিত। রোহিঙ্গাদের চলাফেরা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। উত্তর রাখাইনের বিভিন্ন স্থানে ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের বাধ্যতামূলক শ্রম দিতে হয়। রোহিঙ্গাদের চাষাবাদের জমি ও গবাদি পশুগুলো জব্দ করা হয়েছে। পরিকল্পিত খাদ্য সঙ্কটে ফেলে দিয়ে তাদের নি:শেষ করে দেয়া হচ্ছে। ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিতে রোহিঙ্গাদের বাধ্য করা হয়েছে। এই কার্ডে তাদের ‘রোহিঙ্গা’ পরিচয়ের স্বীকৃতি দেয়া হচ্ছে না। কার্ডের মাধ্যমে খাদ্যসহ নানা ধরনের সেবা নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক কোনো তদন্ত সংস্থাকে মিয়ানমার প্রবেশাধিকার দিচ্ছে না। নিজেদের তদন্ত কমিশনগুলো রাখাইনে অপরাধের কোনো আলামত পাচ্ছে না। এ সব কমিশনের গ্রহণযোগ্য বিদেশী সদস্যরা তদন্ত প্রক্রিয়াকে ‘হোয়াটওয়াস’ আখ্যায়িত দিয়ে পদত্যাগ করেছেন।
আরসালান সুলেমান সংশ্লিষ্ট আর্টিকেল অনুযায়ী অন্তবর্তীকালীন পদক্ষেপ নেয়ার আইসিজের এখতিয়ার তুলে ধরেন। তিনি বলেন, মিয়ানমার গণহত্যার উষ্কানি, ষড়যন্ত্র ও বাস্তবায়নের জন্য সব কিছু করেছে, যা আইসিজের আওতায় বিচারযোগ্য।