হেগে কী ঘটছে আজ

Slider জাতীয় সারাবিশ্ব


দুনিয়ার দৃষ্টি এখন নেদারল্যান্ডসের পিস প্যালেসে অবস্থিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিজে)। রোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের চালানো গণহত্যার বিচার শুরু হচ্ছে আজ। মামলার বাদী আফ্রিকার দেশ গাম্বিয়া। মুসলিম বিশ্বের জোট ওআইসি’র সিদ্ধান্তে গাম্বিয়া ওই মামলা করেছে। এ ইস্যুতে দেশটির পাশে আছে পশ্চিমা দুনিয়া। বিশেষ করে গাম্বিয়ার মামলা পরিচালনায় লজিস্টিক সাপোর্ট দিচ্ছে কানাডা ও নেদারল্যান্ডস। রোহিঙ্গা সংকটের ভিকটিম হিসেবে নৈতিক সমর্থনসহ সর্বোতভাবে গাম্বিয়ার পাশে আছে বাংলাদেশ। কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে, কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুুডো এরই মধ্যে গাম্বিয়াকে আইসিজেতে সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।

ফলে রাখাইনে গণহত্যার বিচার নিশ্চিত করতে গাম্বিয়াকে সব ধরনের সহযোগিতা দিতে তৈরি কানাডা। ইতিমধ্যে মিয়ানমারবিষয়ক কানাডার বিশেষ দূত বব রায়ের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল গতকাল নেদারল্যান্ডসে পৌঁছেছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে। এদিকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে গাম্বিয়াকে সহযোগিতার মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বাংলাদেশ-মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয় চুক্তির বিষয়টি থাকতে পারে বলে ঢাকার কর্মকর্তারা মনে করেন। প্রত্যাবাসনের জন্য রাখাইনে পরিবেশ তৈরি হয়েছে কি না, রোহিঙ্গারা কেন নিজের ইচ্ছায় ফিরে যাচ্ছে না, এ বিষয়গুলো গাম্বিয়াকে জানাতে পারে বাংলাদেশ। নেদারল্যান্ডসে গতকাল বাংলাদেশসহ বিশ্বের নানা দেশে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং আইসিজের প্রতিনিধিদের মধ্যে আলাদা মতবিনিময়ের দায়িত্ব নিয়েছে নেদারল্যান্ডসে কর্মরত একটি আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় গাম্বিয়ার অ্যাটর্নি জেনারেল ও বিচারমন্ত্রী আবুবাকার তামাদুর সম্মানে ওআইসির চার সদস্যদেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও বাংলাদেশ এক সংবর্ধনার আয়োজন করেছিল। আইসিজেতে গাম্বিয়ার মামলার প্রক্রিয়ায় যে আন্তর্জাতিক সমপ্রদায়ের সমর্থন আছে, সেটার বহিঃপ্রকাশ হিসেবে ওই আয়োজন করা হয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন গতকাল বলেন, গাম্বিয়ার সেই প্রস্তুতি নিয়েই আমাদের কর্মকর্তারা দ্য হেগে গেছেন। এখানে আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে মিয়ানমারের জবাবদিহিতা চাই। একাউন্টিবিলিটি হলে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন বন্ধ হবে। রাখাইনে তাদের নিরাপদ বসবাস নিশ্চিত হবে। আমরা আশা করছি, গাম্বিয়া যেটা চেয়েছে আন্তর্জাতিক আদালত রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও সুরক্ষার বিষয়টি বিবেচনায় এ নিয়ে একটি আন্তবর্তী আদেশ দেবেন। আদেশটি পাওয়া গেলে এটি মানতে মিয়ানমারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তখন আমরা বাংলাদেশে অস্থায়ী আশ্রয়ে থাকা রোহিঙ্গাদের বলতো পারবো, তোমাদের নিরাপত্তায় মিয়ানমার বাধ্য, সুতরাং যাও। তখন তারাও হয়ত স্বেচ্ছায় যাবে। মন্ত্রী বলেন, মিয়ানমার আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র। তাদের বাস্তুচ্যুত লোকজনকে ফেরাতে আমাদের সঙ্গে দু’টি এগ্রিমেন্ট হয়েছে। কিন্তু লোকগুলোকে ফেরত পাঠানো যাচ্ছে না, দেশটির অঙ্গীকার বাস্তবায়ন না করায় অর্থাৎ রাখাইন পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায়। আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা এবং এ সংক্রান্ত অন্তবর্তী আদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে আশা করে মন্ত্রী বলেন, বিচার হবে এভিডেন্স বেইজড। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা এখানে এসে দফায় দফায় নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে গেছেন। নির্যাতিতদের বক্তব্য ধারণ করেছেন। অং সান সুচি কোর্টে স্বীকার করেন বা না-ই করেন তার সরকারই নির্যাতনকারী সেনা কর্মকর্তাদের ১০ বছরের জেল দিয়েছিল। যদিও তারা সাত মাসে মুক্ত হয়ে গেছে। এগুলো এভিডেন্স। এটা আমরা সংগ্রহ করিনি। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সংগ্রহে রয়েছে। মন্ত্রী বলেন, আমরা আশাবাদী আদালতে গাম্বিয়া জয় পাবে। সুখের বিষয় হচ্ছে ক’দিন আগে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করেছেন। নিশ্চয়ই চীনের পক্ষ থেকে মিয়ানমারকে বলা হয়েছে-দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমস্যাটি মিটমাট করতে। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধানে চীন এবং বাংলাদেশের অবস্থান অভিন্ন দাবি করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, কিন্তু মিয়ানমার সে পথে যাচ্ছে না। আমাদের মধ্যে ত্রিদেশীয় একটি বৈঠক শুরু হয়েছিল, গ্রাউন্ডে যখন আলোচনার জন্য প্রস্তাব করেছি, তখন তারা অসুস্থতা এবং রাষ্ট্রদূত পদে পরিবর্তনসহ নানা অসুবিধা সামনে এনেছে। ফলে বৈঠকটির ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায়নি। তারপরও মন্ত্রী এ নিয়ে আশাবাদী। বলেন, আমরা তাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ আলোচনায় রোহিঙ্গা সঙ্কটের সমাধান চাই। আমাদের প্রধানমন্ত্রীর চাওয়াও তা-ই। অতীতে আলোচনায়ই সমাধান এসেছে, সুতরাং এবারও আমরা আশাবাদী যে পথেই হোক সমাধান আসতেই হবে। উল্লেখ্য, সঙ্কট সমাধানে ঢাকা দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় সব পথই খোলা রেখেছে। ঢাকার ওই অবস্থানের কারণেই আইসিজেতে মামলার শুনানি পর্যবেক্ষণে ঢাকা থেকে একাধিক টিম গেছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ে গঠিত ১২ সদস্যের সরকারী প্রতিনিধি দল ছাড়াও নাগরিক সমাজের দু’জন প্রতিনিধি গেছেন। স্বতন্ত্রভাবে মামলায় সাক্ষ্য দিতে মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ রোহিঙ্গার প্রতিনিধি হিসাবে কক্সবাজারে আশ্রয় নেয়া ২জন রোহিঙ্গা নারী এবং একজন পুরুষও নেদারল্যান্ডস গেছেন। আজ থেকে আইসিজেতে শুরু হওয়া শুনানির প্রথম পর্বে বাদি গাম্বিয়া তার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য তোলে ধরবে। কাল আত্মপক্ষ সমর্থন করে বক্তব্য দিবে বিবাদি মিয়ানমার। ১২ই ডিসেম্বর হবে যুক্তিতর্ক। প্রথমে গাম্বিয়া যুক্তি উপস্থাপন করবে, পরে মিয়ানমার তা খন্ডনের সূযোগ পাবে। গাম্বিয়ার পক্ষে মামলা লড়বেন বৃটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত আইনমন্ত্রী আবুবাকর তামবাদোউ। তিনি ১৯৯৪ সালে রোয়ান্ডায় গণহত্যার মামলায় এক দশকের বেশি সময় লড়াই করেছেন। বাংলাদেশের কক্সবাজারে গাদাগাদি করে অবস্থান করা শরণার্থীর শিবির পরিদর্শন করে, সেখানকার মানুষদের ধর্ষণ, হত্যা ও শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার বর্ণনা শুনে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে মামলা করতে ব্যক্তিগতভাবে আনুষ্ঠানিকভাবে ওআইসির সমর্থন চেয়েছিলেন তামবাদোউ। গাম্বিয়ার রাজধানী বানজুলে বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে তিনি বলেছেন, এসব কাহিনীর মধ্যে আমি গণহত্যা দেখতে পেয়েছি। গাম্বিয়ার এই মন্ত্রীর পরিকল্পনায় রয়েছে যে, তিনি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অবিলম্বে সহিংসতা বন্ধে বিচারকরা যেন মিয়ানমারের প্রতি নির্দেশ দেন এবং আদালতকে অনুরোধ করবেন প্রমাণ সংরক্ষণ করতে, যা গণহত্যার মামলায় পরে সহায়ক হবে। মিয়ানমারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে মুখোমুখি হওয়ার সময় গাম্বিয়ার সাবেক স্বৈরাচারের অধীনে বসবাসের অভিজ্ঞতা তুলে ধরার কথা তার। ওদিকে মিয়ানমারের পক্ষে আদালতের বক্তব্য এবং যুক্তি খন্ডন করবেন দেশটির স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি। মিয়ানমার টাইমস জানিয়েছে, সু’চি একা নন, তার সঙ্গে থাকবেন দেশটির আইনজীবীরাও। দ্য হেগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, ৩ দিনের ওই শুনানির পুরো সময়ই আদালতের বাইরে রাখাইনে গণহত্যাসহ বর্মী নৃশংসতার প্রতিবাদে নানা কর্মসূচি পালনে সোচ্চার থাকার প্রস্তুতি নিচ্ছে রোহিঙ্গারা। ইউরোপসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত রোহিঙ্গারা এ জন্য হেগে জড়ো হয়েছে। গত ১১ই নভেম্বর ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার (ওআইসি) সমর্থনে আইসিজেতে গাম্বিয়া মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলাটি করে। গাম্বিয়া গণহত্যা সনদে স্বাক্ষরকারী দেশ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *