ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) ভিপি নুরুল হক নুরের পদত্যাগ দাবি করেছেন জিএস গোলাম রাব্বানী। গতকাল ডাকসুতে সংবাদ সম্মেলনে নুরের আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে তার পদত্যাগ দাবি করেন। ভিপির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠায় লজ্জিত বলেও জানান রাব্বানী। যদিও চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, দুর্নীতি, কমিটি বাণিজ্যসহ বেশ কিছু অপরাধে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক পদ হারিয়েছিলেন গোলাম রাব্বানী। সংবাদ সম্মেলনে ডাকসুর এজিএস সাদ্দাম হোসেন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরীসহ ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ২৩ সদস্যের সবাই উপস্থিত ছিলেন। আর লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান ডাকসুর সদস্য রাকিবুল হাসান। গোলাম রাব্বানী বলেন, ডাকসুর সর্বোচ্চ পদ যেটি, ভিপি পদ, নুরুল হক সেটিকে স্পষ্টভাবেই বিতর্কিত ও কলঙ্কিত করেছেন, আমরা তার প্রমাণও পেয়েছি। তার অডিও ফোনালাপ ভাইরাল হয়েছে।
আমরা ডাকসু পরিবার এই অপকর্মের দায়ভার নিতে রাজি নই। আমাদের আহ্বান, ডাকসুর ভিপি পদকে আর বিতর্কিত না করে নুরুল যেন অনতিবিলম্বে পদত্যাগ করেন। তিনি যদি পদত্যাগ না করেন, আমরা ডাকসুর সভাপতির প্রতি আহ্বান জানাই, নৈতিক স্খলনের কারণে তিনি যেন নুরুলকে ডাকসুর ভিপি পদ থেকে বহিষ্কার করেন। তিনি বলেন, যে কারো নামে অভিযোগ উঠতে পারে। অভিযোগ নিয়ে আমাদের কথা নেই। নুরুলের ক্ষেত্রে আমরা যেহেতু কিছু দালিলিক প্রমাণ পেয়েছি, তার নিরপেক্ষ তদন্ত করা হোক। লিখিত বক্তেব্য রাকিবুল হাসান বলেন, নিজেকে ‘জাতীয় বীর’ হিসেবে হাজির করতে গিয়ে ভিপি নুরুল আজ ‘জাতীয় বেঈমানে’ পরিণত হয়েছেন। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ২৩ জন ছাত্র-প্রতিনিধির একক ও যৌথ উদ্যোগে যখন নিরলসভাবে শিক্ষার্থীদের অধিকার আদায়ের কর্মযজ্ঞ পালন করে যাচ্ছে, তখন ডাকসুর ভিপি পদটি ব্যবহার করে নুরুল হকের টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্য ও অনৈতিক অর্থ লেনদেনের খবর আমাদের লজ্জিত করে। শিক্ষার্থীদের আবেগকে ব্যবহার করে নুরুল ডাকসুর ভিপি পদের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি পদে অবস্থান করছেন। যে প্রত্যাশা নিয়ে শিক্ষার্থীরা তাকে নির্বাচিত করেছিলেন, নুরুল একদিকে তার কিছুই পূরণ করতে পারেননি, জাতির সামনে শিক্ষার্থীদের লজ্জিত করেছেন। গত নয় মাসে ডাকসু ভিপির উদ্যোগে শিক্ষার্থীদের জন্য একটি কাজ না হলেও পদটিকে ব্যবহার করে তিনি নিজের রাজনৈতিক অভিলাষ পূরণের চেষ্টা করে চলেছেন পুরোদমে। একাধিক টেন্ডার বাণিজ্য, তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ ও বদলিতে তিনি নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। শিক্ষার্থীদের অধিকারের কথা না বলে নুরুল হক দুর্নীতির মামলায় সাজাপ্রাপ্ত খালেদা জিয়ার অধিকার নিয়ে সোচ্চার হয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন ছাত্রলীগ থেকে নির্বাচিত ডাকসুর প্রতিনিধিরা। রাকিবুল হাসান বলেন, সমপ্রতি দুইটি ফোনালাপ ফাঁস হওয়ার মধ্য দিয়ে নুরুলের স্বরূপ সবার সামনে উন্মোচিত হয়েছে।
বিভিন্ন সময়ে কান্ডজ্ঞান হারিয়ে অজ্ঞান হয়ে যাওয়ার অভিনয় করতে করতে নুরুল যে টেন্ডারবাজি, তদবির বাণিজ্য ও অনৈতিক অর্থ লেনদেন ইত্যাদিতে দক্ষতা অর্জন করেছেন, তা ছাত্রসমাজের সামনে পরিষ্কার হয়েছে। এই ফোনালাপ প্রকাশের পর নুরুলের বিভিন্ন বক্তব্য, বিজ্ঞপ্তি, মন্তব্য ইত্যাদি আমরা গভীরভাবে লক্ষ্য করেছি। সেখানে তিনি যেভাবে নিজের অভিমত ব্যক্ত করেছেন, তা ছাত্রসমাজকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শনের শামিল। এদিকে সংবাদ সম্মেলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নপ্রকল্প থেকে চাঁদাবাজির অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকরা প্রশ্ন করলে তিনি তার জবাব দেননি।
ডাকসুর এজিএস ও বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন এ বিষয়ে বলেন, জাহাঙ্গীরনগরে যা ঘটেছে, তা একটি ছাত্রসংগঠনের অভ্যন্তরীণ বিষয়। সেটির আলোকে কিন্তু ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গোলাম রাব্বানী ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। কিন্তু তার কোনো ফোনালাপ বের হয়নি, তার কোনো পারিবারিক ব্যবসার কথা বলা হয়নি, কোনো আন্টির কথা বলা হয়নি তবুও দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে তিনি সংগঠন থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন। সেদিক থেকে ভিপি নুরুলের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগটি আরো বেশি জোরালো। এসময় নিজের ফোনালাপ ফাঁসের বিষয়ে কথা বলেন গোলাম রাব্বানী। তিনি বলেন, জাহাঙ্গীরনগরের ঘটনায় যে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই, তা ওই ফোনালাপে পরিষ্কার হয়েছে। আমি যেহেতু তখন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে ছিলাম, আমার একটি ইউনিটের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, আমি সে বিষয়ে কথা বলেছিলাম। এটি আমার বিষয় নয়, তাদের। তবুও অভিযোগ ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে আমি ও আমার সভাপতি অব্যাহতি নিয়েছি। এরপর থেকে আমরা ওই ঘটনার বারবার তদন্ত চেয়েছি, কোনো তদন্ত কমিটি কিন্তু করা হয়নি।
এসময় ডাকসু নির্বাচন করতে নিয়মবহির্ভূতভাবে এমফিলে ভর্তির বিষয়ে সাংবাদিকদের আরেক প্রশ্নের জবাবে গোলাম রাব্বানী বলেন, এটা নিয়ে ইতিমধ্যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন হয়েছে, তদন্ত হয়েছে। আমি যে নিয়ম মেনেই ভর্তি হয়েছি, সেটা স্পষ্ট হয়েছে। এমফিলে ভর্তির কাগজপত্র যথাসময়েই আমি বিভাগে জমা দিয়েছিলাম, কিন্তু বিভাগের দীর্ঘসূত্রতার কারণে যথাসময়ে তা জমা হয়নি। সুতরাং, এখানে আমার কোনো ব্যর্থতা বা দায়বদ্ধতা নেই। কোনো অনিয়ম প্রমাণিত হয়নি। একটা অভিযোগ উঠেছিল, যা পরে ভুল প্রমাণিত হয়েছে। আর বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নিয়ম আছে, তা আমার জানার কথা নয়। সঠিক সময়ে আমি আমার সঠিক কাজটি করেছি। বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে তাদের প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে, সেটি সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ব্যাপার।
ছাত্রলীগের কথায় নয়, দুর্নীতির প্রমাণ দিলে পদত্যাগ- নুর
এদিকে ডাকসুর জিএস কর্তৃক পদত্যাগ দাবির প্রেক্ষিতে নিজের অবস্থান জানিয়েছেন ভিপি নুরুল হক নুর। গতকাল তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ছাত্রলীগের দাবিতে নয়, দুর্নীতির বিন্দু পরিমাণ সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ দিলে পদত্যাগ করবো। তিনি বলেন, ছাত্রলীগ বরাবরই ডাকসুকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহারের চেষ্টা করেছে। যখনই তা করতে দেয়া হয়নি তখনই তারা ভিপির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। রাব্বানীর সংবাদ সম্মেলনের বিষয়ে নুরুল হক নুর বলেন, ছাত্রলীগ থেকে বহিষ্কার হয়ে ডাকসু জিএস লজ্জায় এতদিন ডাকসুতে আসেননি। রাতের অন্ধকারে দু-একদিন এসেছেন। আজ এসেছেন। তারা ভেবেছে ভিপিকে ঠেকাতে ছাত্রলীগকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। ছাত্রলীগের মধ্যে তো বিভেদ রাখা যাবে না। তখন তারা ঘর থেকে জিএসকেও নিয়ে এসে সংবাদ সম্মেলন করেছে। ভিপি নুর বলেন, আমরা এখনও স্পষ্ট করে বলছি- কেউ যদি প্রমাণ করতে পারে ডাকসু ভিপি বিন্দুমাত্র অনৈতিক লেনদেন করেছে, অবৈধ লেনদেন করেছে, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছে- তাদের এই প্রশ্ন তোলার আগেই প্রমাণটা গণমাধ্যমে উপস্থাপন করলেই ডাকসু ভিপি পদত্যাগ করবে। ছাত্রলীগের কথায় ডাকসু ভিপি পদত্যাগ করবে না বা ছাত্রলীগের কথা কর্ণপাত করবে না। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ যেভাবে সারা দেশে একনায়কতন্ত্র কায়েমের জন্য ভিন্নমতের ওপর দমন-পীড়ন চালিয়ে দেশকে একটা নৈরাজ্যের দিকে ঠেলে দিয়েছে। ডাকসুতেও তারা দখলদারি পরিবেশ কায়েম করতে চায়। তারা চায় ডাকসুতে ছাত্রলীগের বাইরে যেন কেউ না থাকে। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার ডাকসুর ভিপি পদটি নিয়ে অস্বস্তিতে রয়েছে। কারণ সারা দেশে ছাত্রলীগের অপকর্মের বিরুদ্ধে কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন কথা বলে না।
একমাত্র ভিপির নেতৃত্বে তাদের বিরুদ্ধে কথা বলা হয়। এর একটা প্রভাব সারা দেশের ছাত্রসমাজের মধ্যে রয়েছে। এসময় নুর নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ৫ লাখ টাকার এক টাকাও হাতে পাননি বলে সংবাদ মাধ্যমকে জানান। তিনি বলেন, ডাকসুতে ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে, আমি এক টাকাও খরচ করিনি গোলাম রাব্বানীর এমন অভিযোগ সত্য না। সত্য হচ্ছে আমাকে নামমাত্র ৫ লাখ টাকা দেয়া হয়েছে। বরাদ্দকৃত টাকার এক টাকাও হাতে পাইনি। আমি ছোট ছোট তিনটি বাজেট করেছিলাম। কিন্তু টাকার অভাবে সেগুলোও করা হয়নি।