ঢাকা: দুদক কার্যালয়ে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: প্রথম আলোদুদক কার্যালয়ে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। ছবি: প্রথম আলোবেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির মামলা প্রসঙ্গে সাংসদ ফজলে নূর তাপসের ক্ষোভ নিয়ে প্রশ্ন করলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন দুদকের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ। তদন্তে বাচ্চুর নাম আসা না–আসা প্রসঙ্গে তাপস কথা বলতে পারেন না বলে মনে করিয়ে দেন দুদক চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, কে কী বলল, এটা তাঁদের বিবেচ্য বিষয় নয়।
বেসিক ব্যাংকে জালিয়াতির মামলা প্রসঙ্গে সাংসদ ফজলে নূর তাপস গত ১৪ অক্টোবর ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন।
এ–সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে দুদকপ্রধান বলেন, ‘আপনি (ফজলে নূর তাপস) বাচ্চুর নাম কেমনে বলছেন, আপনি কে? আপনি কি ইনভেস্টিগেশন করছেন? কে কী বলছে, দ্যাট ইজ নট আওয়ার কনসার্ন। এটা একটা পাবলিক ইনস্টিটিউশন। আপনি আমার পদত্যাগ চাইতে পারেন, অনেক কিছুই চাইতে পারেন, সেটা সমস্যা না।’
চেয়ারম্যান আরও বলেন, ‘কিন্তু আপনি কে যে প্রশ্ন করছেন বাচ্চুর নাম আসছে কি বাচ্চুর নাম আসেনি? এটা তো আন্ডার ইনভেস্টিগেশন। বাচ্চুর নাম আসবে না, আপনি জানেন ক্যামনে? হু আর ইউ? ইনভেস্টিগেশন করার ম্যান্ডেট তো আমাদের, ম্যান্ডেট তো আপনার না। আপনি রিক্রিয়েট করলে তো হবে না—বাচ্চুর নাম দেন বা দিয়েন না।’
ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘ইনভেস্টিগেশন শেষ হলে যখন চার্জশিট যাবে, তখন আপনি বলতে পারেন…এটাকে নারাজি দেওয়া যায়, আরও প্রসেস আছে। আমরা যদি ভুল করি, সরকার, ব্যাংক তখন নারাজি দিতে পারবে। কিন্তু আমার মনে হয় না এই ক্ষেত্রে আমরা কোনো ভুল করব। এটা জনগণ বিশেষভাবে জানে, তাই আমরা বিশেষভাবে কেয়ারফুল। যখন আমরা রিপোর্ট দেব, এত সহজে এটা নিয়ে আপনাদেরকে প্রশ্ন করার সুযোগ দেব না।’
আজ রোববার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কার্যালয়ে মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে ইকবাল মাহমুদ এসব কথা বলেন। দুদক বিটে কর্মরত সাংবাদিকদের সংগঠন রিপোর্টার্স অ্যাগেইনস্ট করাপশন (র্যাক) এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে।
বেসিক ব্যাংকের জালিয়াতির ঘটনায় করা ৫৬ মামলার তদন্ত কবে শেষ হবে—এমন প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমাদের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন এসেছিল। কিন্তু সেখানে টাকা কোথায় পাচার হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য না থাকায় আমরা এগোতে পারিনি। তবে তদন্ত চলছে। পারস্পরিক আইনগত সহায়তা প্রস্তাব বা এমএলএআরের মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে তথ্য চাওয়া হয়েছে। টাকা কোথায় গেছে, তা খুঁজে দেখা হচ্ছে। বেসিক ব্যাংকের দুর্নীতির কিছু টাকা মালয়েশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ সেসব দেশে গেছে, দুদক সেখানে এমএলএআর পাঠিয়েছে। সেখান থেকে তথ্য পাওয়া গেলে মামলাগুলোর চার্জশিট দেওয়া হবে।’
দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেছেন, দুদক যাদের নিয়ে কাজ শুরু করেছে, আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া তাদের বের হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। সুতরাং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আনন্দে থাকার কোনো সুযোগ নেই। যিনিই দুর্নীতি করুন না কেন, তাঁকে দুদকের বারান্দায় আসতেই হবে।
দুর্নীতিবিরোধী অভিযানের বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে ইকবাল মাহমুদ আরও বলেন, অনেকেই বলছেন এ অভিযান বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু দুদক কাজ করছে। এরই মধ্যে ১৮৭ জনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে।
দুদকের মামলায় শতভাগ শাস্তি হওয়া উচিত মন্তব্য করে চেয়ারম্যান বলেন, ‘পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৩০-৪০ ভাগ মামলায় শাস্তি হচ্ছে না, অর্থাৎ আমাদের দুর্বলতা আছে। হয় ইনভেস্টিগেশনে, না হয় প্রসিকিউশনে অথবা কোথাও কোনো মিসিং লিংক আছে। সেটি আমরা পাচ্ছি না। কিন্তু থিওরিটিক্যালি দুর্নীতির প্রতিটি মামলায় শাস্তি হওয়া উচিত।’
ফাঁদ–মামলার কারণে কমেছে ঘুষ
দুদকের নিয়মিত কার্যক্রমের কথা বলতে গিয়ে ফাঁদ–মামলার তথ্য তুলে ধরেন দুদক চেয়ারম্যান। তাঁর মতে, ফাঁদ–মামলার কারণে ঘুষ বন্ধ হয়নি, তবে ঘুষের মাত্রা কমেছে।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, যাঁরা সরকারি কর্মকর্তা, জনগণের টাকায় বেতন পান কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সেবা দিচ্ছেন না, দুর্নীতির প্রস্তাব গ্রহণ করছেন এবং ঘুষ নিচ্ছেন, তাঁরা ফাঁদ–মামলায় পড়ছেন।
গত সাড়ে তিন বছরে ফাঁদ পেতে ঘুষের টাকাসহ ৭২ জন সরকারি কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তার করেছে দুদক।
বেড়েছে জন–আস্থা
দুদকে অভিযোগের সংখ্যা বাড়ছে উল্লেখ করে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অভিযোগ বাড়ার কারণ জন–আস্থা বেড়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বছর দুদকের কার্যক্রম ঊর্ধ্বমুখী। তদন্ত, অনুসন্ধান সবই বাড়ছে। দুদকে অভিযোগ করলে কিছু একটা ব্যবস্থা হলেও হতে পারে—এই ধারণা আমরা তৈরি করতে পেরেছি। তাই আমাদের ওপর জন–আস্থা বেড়েছে।’ এ বছরের প্রথম ১১ মাসে দুদকে ২২ হাজারেরও বেশি অভিযোগ এসেছে জানিয়ে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, এর মধ্যে তিন হাজারেরও বেশি অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য গ্রহণ করা হয়েছে। তবে দুদকের হটলাইনে আসা অভিযোগ এর বাইরে।
আরেক প্রশ্নের জবাবে দুদকের কমিশনার (তদন্ত) এ এফ এম আমিনুল ইসলাম বলেন, দুদকের মামলায় সাজার হার বেড়েছে। এর পরিমাণ ৭০ শতাংশের মতো। উচ্চ আদালতে এই সাজার হার কতটা বহাল থাকে, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সেখানে সাজার হার প্রায় ৫৪ শতাংশ।
মানি লন্ডারিং মামলায় শতভাগ সাজা
মামলার সাজার হারের প্রসঙ্গে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, অর্থ পাচারের ঘটনায় দুদকের করা মামলায় সাজার হার শতভাগ। তিনি বলেন, আগে মানি লন্ডারিংয়ের মামলা শুধু দুদক করত। এখন আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান, যেমন—এনবিআর, বাংলাদেশ ব্যাংক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সিআইডি করছে। ইতিমধ্যে সিআইডি মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে ৬০ থেকে ৭০টি মামলা করেছে, এনবিআর করেছে কয়েকটি। দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘এনবিআরের সবচেয়ে বেশি মামলা করা উচিত। আমাদের ধারণা, ট্রেড বেইজড মানি লন্ডারিং সবচেয়ে বেশি হচ্ছে। দেশে ক্যাপিটাল মেশিনারিজ, ক্যাপিটাল গুডস আনার মাধ্যমে মানিলন্ডারিং হচ্ছে। কোনো প্রতিষ্ঠান যদি দায়িত্ব পাওয়ার পরেও মানি লন্ডারিংয়ে মামলা না করে আমরা তাদের নজরদারির মধ্যে রাখব। তিনি বলেন, অবৈধ অর্থই কেবল মানি লন্ডারিং হচ্ছে, এটা প্রাইভেট সেক্টরে হোক আর সরকারিভাবে হোক তা মানি লন্ডারিং।
দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘ট্রেড বেইজড মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি টাকা পাচার হচ্ছে। কারণ, এই পথে লিগ্যালি টাকা বিদেশে যাচ্ছে। অবৈধ সম্পদ কোথায় যাচ্ছে, এ বিষয়ে আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারি রয়েছে।’
বেনামি অভিযোগে কোনো হয়রানি হয় না
এক প্রশ্নের জবাবে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘আমরা নামে চিঠি না বেনামে চিঠি তা দেখি না। দেখি অভিযোগের সারবত্তা। অভিযোগ পেতে আগে সংবাদপত্রেই আমাদের নির্ভরতা ছিল। কিন্তু এখন ফেসবুক, ই–মেইল, চিঠি, পত্রিকা ও টিভির মাধ্যমেও অভিযোগ পাচ্ছি। হটলাইনে পাচ্ছি। সবকিছু মিলে সংখ্যা বেড়েছে। আমাদের সক্ষমতাও বেড়েছে। দুর্বল শক্তিশালী সব মিলে মামলার সংখ্যাও বেড়েছে। যদিও মামলায় শাস্তির পরিমাণ না বাড়লেও কমেনি।’
দুদকে অভিযোগ গ্রহণ পদ্ধতি সম্পর্কে ইকবাল মাহমুদ বলেন, ‘আমরা স্বেচ্ছাধীন ক্ষমতা রাখিনি। অভিযোগ গ্রহণের বিষয়টি চলমান। ইচ্ছে করলেই কেউ অভিযোগ গ্রহণ করতে পারেন না, আবার ইচ্ছে করলেই ফেলে দিতে পারেন না। আগে এটা ছিল না। এমনও হয়েছে, আগে অনেক অভিযোগেও হদিসও মিলত না। এখন সব হদিস পাবেন। তথ্যগত সহায়তাও আমরা দিচ্ছি যথাযথ প্রক্রিয়ায়।’
অভিযোগ অনুসন্ধানের পর্যায়ে কেউ যেন হয়রানির শিকার না হয়, সে ব্যাপারে দুদক সজাগ বলেও জানান চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, অভিযোগ প্রমাণসাপেক্ষ। তার আগে কারও সামাজিক সম্মান ক্ষুণ্ন করা যায় না।
গণশুনানিতে জনগণের আগ্রহ
গণশুনানি সম্পর্কে দুদক চেয়ারম্যান বলেন, ‘অনেকগুলো গণশুনানি হয়েছে। গণশুনানিতে আমরা নিজস্ব রিসোর্স ব্যবহার করেছি। গণশুনানির কারণে জনগণের মধ্যে অভিযোগ করার যে অধিকার, ঘুষ ছাড়া সেবা পাওয়ার যে অধিকার, সেটা বেড়েছে। আমরা মনে করি, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যাঁরা গণশুনানিতে অংশ নিয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও সচেতনতা তৈরি হয়েছে। জনগণের মধ্যে সেবা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টিও তাঁরা অনুধাবন করতে পারছেন। অনেক সমস্যার সমাধানও গণশুনানিতে আমরা নিষ্পত্তি করেছি।’
মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য দেন র্যাকের সাধারণ সম্পাদক আদিত্য আরাফাত। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন দুদকের সচিব মোহাম্মদ দিলোয়ার বখত, মহাপরিচালক মফিজুর রহমান ভূঁইয়া ও এ কে এম সোহেল।