দূষণে বাড়ছে মৃত্যু সর্বাধিক ঝুঁকিতে শিশুরা

Slider কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি জাতীয় সারাদেশ


ঢাকা: বায়ু দূষণে রীতিমতো বিপর্যস্ত ঢাকা। এ নিয়ে বাড়ছে উদ্বেগ। সম্প্রতি দেখা গেছে, বায়ু দূষণে দিল্লিকেও টেক্কা দিয়েছে ঢাকা। দূষণে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে পড়ছে শিশুরা। দেখা দিচ্ছে নানা রোগ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে ঢাকা শহরের ১০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাতাসের মানের ওপর পরীক্ষা চালানো হয়। সেখানে দেখা যায়, ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর বাতাসে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্ধারিত মানের চেয়েও চার থেকে পাঁচ গুণ বেশি ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। গবেষকরা ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর ৯ থেকে ১০ বছর বয়সী ২৫০ জন শিক্ষার্থীর ওপর জরিপ চালিয়ে দেখতে পান, ১৬.৮% শিক্ষার্থী কাশি এবং ৫.৬% ছাত্র-ছাত্রী মাইগ্রেন বা মাথাব্যাথায় ভুগছে।

এছাড়া অ্যাজমা বা শ্বাসকষ্ট রোগে আক্রান্ত শিশুর হার ৬ শতাংশ। পাশাপাশি ৫৫ শতাংশ শিক্ষার্থী, যাদের আগে কোন ধরণের শ্বাস-প্রশ্বাসগত সমস্যা ছিলো না, তারাও এখন স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারছেন না বলে গবেষণায় ধরা পড়েছে।

বাংলাদেশে দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুস ক্যান্সার এবং ফুসফুসের রোগে বছরে প্রায় লক্ষাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। বায়ু দূষণের ফলে ২০১৭ সালে বাংলাদেশে অন্তত ১.২৩ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বিশ্বজুড়ে একযোগে প্রকাশিত ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ‘বৈশ্বিক বায়ু পরিস্থিতি-২০১৯’ প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ১৯৯০ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বিশ্বে বায়ুর গুণগতমান বিষয়ক তথ্য নিয়ে এ গবেষণা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা সংস্থা হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট (এইচইআই) এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স এন্ড ইভালুয়েশনের (আইএইচএমই) যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ এশিয়ার ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণযুক্ত পরিবেশে কোনো শিশু বেড়ে উঠলে তার গড় আয়ু ৩০ মাস (২.৫ বছর) পর্যন্ত কমে যেতে পারে। বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত এলাকা রয়েছে দক্ষিণ এশিয়ায়। মৃত্যুঝুঁকির অন্যতম কারণগুলোর মধ্যে বিশ্বব্যাপী বায়ুদূষণ মৃত্যুর জন্য অধিকতর দায়ী। বায়ুতে যেসব ক্ষতিকর উপাদান আছে, তার মধ্যে মানবদেহের জন্য সবচেয়ে মারাত্মক উপাদান হচ্ছে পিএম ২.৫ (২.৫ মাইক্রোমিটার বা তার চেয়ে ছোট ব্যাসের বস্তুকণা)। এশিয়ায় বায়ুর গুণমান অনেক খারাপ। বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণ ১৯৯০ সাল থেকে পিএম ২.৫ মাত্রার মধ্যে বসবাস করছে।

বায়ু দূষণের কারণে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ ৭৫ হাজার মানুষের মৃত্যু হচ্ছে বলে সমপ্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত পরিবেশ বিষয়ক এক সেমিনারে তথ্য পাওয়া যায়। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনসহ পরিবেশ নিয়ে কাজ করা কয়েকটি বেসরকারি সংগঠন আয়োজিত ওই সেমিনারে বায়ু দূষণজনিত কারণে বাংলাদেশের মানুষের মৃত্যুর এ তথ্য জানানো হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বায়ু দূষণের ফলে শুধু এশিয়াতেই প্রতিবছর মৃত্যুবরণ করেন ২৬ লাখ মানুষ। এবং এই কারণে বিশ্বজুড়ে প্রতি ৮ জনের মধ্যে ১ জনের মৃত্যু হয়ে থাকে। দক্ষিণ এশিয়ায় পাকিস্তানের পর সবচেয়ে বায়ু দূষণে দূষিত দেশ বাংলাদেশ। এ গবেষণায় দেখা গেছে, বায়ুতে পিএম ২.৫ উপাদানের কারণে বিশ্বে তিন মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। যাদের অর্ধেকের বেশি মানুষ ভারত ও চীনে বসবাস করতো। এসব মৃত্যুর জন্য বিশ্বে শীর্ষে থাকা বায়ু দূষণকারী দুই দেশ- ভারত ও চীন দায়ী। দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তান পৃথিবীর দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে। এসব দেশের বায়ু দূষণের কারণে ১.৫ মিলিয়নের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদী বায়ু দূষণের ফলে স্ট্রোক, ডায়াবেটিস, হার্ট অ্যাটাক, ফুসফুস ক্যান্সার ও ফুসফুসের রোগে প্রায় ৫ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে ৩ মিলিয়ন মানুষের মৃত্যুর জন্য সরাসরি পিএম ২.৫ উপাদান দায়ী।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বায়ু দূষণের কারণে মানুষের তৎক্ষণাৎ বা দ্রুত মৃত্যু হয় না। বরং এটা এক ধরণের নীরব ঘাতক। মানুষের মৃত্যুর দশটি কারণের মধ্যে পঞ্চম অবস্থানে রয়েছে এই বায়ু দূষণ। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে ঢাকার বায়ু নতুন করে দূষিত হওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। গত ৩০ বছরে পানি এবং পয়:নিষ্কাশনজনিত মৃত্যুহার কমলেও বায়ু দূষণ জনিত মৃত্যুহার বৃদ্ধি পেয়েছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।

বাংলাদেশ আরবান ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বায়ু দূষণের পরিমান নির্ধারণ করতে একটি গবেষণা করা হয়। গবেষণাটি ফার্মগেট এর কয়েকটি স্কুলসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে চালানো হয়। এসময় স্কুলের বাচ্চাদেরকে একটি বিশেষ মেশিন দেয়া হয়। যেটা বাইপাস সার্জারির পরে রোগীদেরকে দেয়া হয় ফু দেয়ার জন্য। এটা দিয়ে ফুসফুসের শক্তি পরীক্ষা করে দেখা হয়। রোগীর ফুসফুস কতটা সুস্থ্য এবং সামর্থবান। পরীক্ষার ফলাফলে দেখা গেছে, প্রায় ২৬ শতাংশ শিশুদের মধ্যে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ শিশু তাদের ফুসফুসের সক্ষমতা ইতোমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। এর মূল কারণ তারা না জেনে স্কুলের আঙ্গিনায় খেলছে। বাসা থেকে মাস্ক ছাড়া আসা যাওয়া করছে। মুখে মাস্ক না পরার কারণেই মূলত এই ঘটনাটি ঘটেছে। স্কয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসক জানান, গত ৮ বছরে তাদের হাসপাতালের যে চার্ট রয়েছে সেখানে দেখা যায় শ্বাস প্রদাহজনিত অসুস্থতা চক্রবৃদ্ধি হারে বেড়েছে। আগে যেখানে ২ ভাগ আক্রান্ত হতো সেখানে ৮ ভাগ আক্রান্ত হচ্ছে। এটা পরবর্তীতে ১৬ ভাগ এ দাঁড়াবে।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক চিকিৎসা বিষয়ক গবেষণা সাময়িকী দ্য ল্যানসেট এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বে ২০১৫ সালে দূষণ জনিত রোগে ভুগে প্রায় ৯০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে মারা যাওয়া অধিকাংশই নিম্ম বা মধ্যম-আয়ের দেশের বাসিন্দা। এইসব দেশে প্রতি চারজনে একজন পরিবেশ দূষণ জনিত রোগ আক্রান্ত হয়ে মারা যান। দূষণ জনিত মৃত্যুতে সবচেয়ে বড় ভূমিকা বায়ু দূষণের। যা মোট মৃত্যুর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। প্রতি বছর বায়ু দূষণের কারণে ৬৫ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। বায়ু দূষণের পরই পানি দূষণের অবস্থান। লানসেটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশ দূষণ জনিত কারণে মারা যাওয়া ব্যক্তিদের ৯২ শতাংশই দরিদ্র দেশগুলোর বাসিন্দা। তবে ভারত ও চীনের মত দ্রুত উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও এ ধরণের মৃত্যুর হার বাড়ছে। দূষণ জনিত কারণে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হওয়া দেশগুলোর তালিকায় ভারতের অবস্থান পঞ্চম, চীন আছে ষোড়শ স্থানে। যুক্তরাজ্যে প্রতিবছর দূষণ জনিত কারণে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। তালিকায় ৫৫তম স্থানে দেশটি। ১৮৮ দেশের উপর দুই বছর ধরে গবেষণার পর এই প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বিশ্বে প্রতি ছয়টি মৃত্যুর মধ্যে একটির জন্য দায়ী দূষণ। এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের ক্ষেত্রে আরও ভয়াবহ। দেশে দূষণের কারণে প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের মৃত্যু হচ্ছে। বায়ু, পানি ও মাটির দূষণে এসব মৃত্যু ঘটছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গবেষকদের সমন্বিত একটি গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, বায়ু দূষণের কারণে দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া পড়ছে বিশেষ করে চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশকে পরিবেশ দূষণের মারাত্মক প্রভাব থেকে রক্ষার জন্য শুধু মানুষকে সচেতন হতে বললে হবে না। সরকারকেও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে। এবং কঠোর হাতে আইনের প্রয়োগ করতে হবে যাতে বায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা সম্ভব হয়।

এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন বিভাগের ইউ জি সি অধ্যাপক ডা. এবিএম আবদুল্লাহ বলেন, বায়ু দূষণের ফলে শিশু থেকে বৃদ্ধ সবাই মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছেন। এবং দিন দিন এই স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো আরও বেড়েই চলছে। নির্মল ও পরিচ্ছন্ন বায়ু আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের জন্য অনিবার্য। বায়ু দূষণের ফলে ধুলাবালি নাক-মুখ দিয়ে শ্বাসতন্ত্রে আক্রান্ত করে বেশি। প্রথমেই চোখ-নাক আক্রান্ত হয়। চোখ লাল হয়, পানি ঝরে, অ্যালার্জি হয়। এর ফলে নাক বন্ধ হওয়া, নাকে পানি, অনবরত হাঁচি, নাকে অ্যালার্জি বা রাইনাইটিস, সাইনোসাইটিস এমনকি নাকে রক্তক্ষরণও হতে পারে। মুখে প্রবেশ করলে টনসিল, ফ্যারিংস, ল্যারিংসে প্রদাহ হয়ে কাশিসহ গলার স্বর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে ক্ষতি হয় শ্বাসনালি ও ফুসফুস। ফুসফুস আক্রান্তের ফলে সাধারণ কাশি, অ্যাজমা বা হাঁপানি, ব্রঙ্কাইটিস, এমফাইসিমা, সিওপিডি, নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য ভাইরাল ইনফেকশনের প্রকোপ বাড়তে পারে। এছাড়া দীর্ঘদিন দূষিত বায়ু গ্রহণের প্রভাবে ফুসফুসের ক্যান্সারসহ হৃদরোগ, উচ্চ-রক্তচাপ, মস্তিষ্ক, লিভার ও কিডনিসহ অন্যান্য অঙ্গের রোগ হতে পারে। বায়ু দূষণে সবচেয়ে ক্ষতি হয় শিশুদের। তাদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত হয়। এবং স্নায়ুর ক্ষতি হতে পারে। গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি। গর্ভের সন্তানের জন্মগত ত্রুটি। মস্তিষ্কের বিকাশ ব্যাহত হয়ে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী হওয়ার মতো ঝুঁকি বাড়তে পারে। পরিবেশ দূষণ এড়াতে ব্যক্তি সচেতনতা বাড়াতে হবে। রাস্তায় পানি দিয়ে ধুলা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি পরিকল্পিতভাবে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে রাস্তা খোড়াখুড়ি, নির্মাণকাজ, ইটভাটার কার্যক্রম চালানো এবং কল-কারখানাগুলোর বর্জ্য নিষ্কাশনসহ ধোঁয়া কমিয়ে আনার যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *