এই মুহূর্তে ঢাকার কোথাও মানুষের দীর্ঘ লাইন দেখা গেলে যে কেউ নিশ্চিত হতে পারেন এটা টিসিবির পিয়াজ বিক্রির ট্রাকের সামনে মানুষের লাইন। এই লাইনটি ছোট তো হচ্ছেই না, বরং বাড়ছে প্রতিদিন। অনেকেই লাইনে গিয়ে দাঁড়ালেও পিয়াজের দাম নিয়ে আমরা আর উচ্চবাচ্য করছি না তেমন, যদিও এই লেখা যখন লিখছি তখনও ঢাকার বাজারে দেশি পিয়াজের কেজি ২৫০ টাকা, মিয়ানমারের পিয়াজ ২২০-২৩০ টাকা আর মিসর থেকে আমদানি করা অতিকায় একেবারেই ঝাঁঝহীন পিয়াজ ১৭০-১৮০ টাকা। আমরা কি তাহলে মেনেই নিয়েছি এই দামেই আমরা পিয়াজ খাব? আমরা শুধু অপেক্ষা করব কোন এক সময় দেশের পিয়াজ বাজারে উঠবে এবং এর দাম কমে আসবে।
পিয়াজের এই সঙ্কট কোনোভাবেই কোনো দুর্বিপাকে ঘটেনি। সরকারের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে ও সঙ্কটের জন্য ভারতকে দায়ী করা হলেও এটা আসলে ¯্রফে একটা অজুহাত; এই সঙ্কট আসলে হয়েছে সরকারের কারণেই। বন্যা এবং অতিবৃষ্টির কারণে ভারতে এবার পিয়াজের ঘাটতি হবে এবং রপ্তানি বন্ধ হয়ে যাবে কয়েক মাস ধরে এরকম একের পর এক পূর্বাভাসের পরও বাংলাদেশ সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি বলেই আজ এই সঙ্কট তৈরি হয়েছে।
একটা সরকার যদি মানুষের কথা ভাবে, তাহলে কী হতে পারে শ্রীলংকা সেটার ভালো উদাহরণ হতে পারে। দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী ভারত রফতানি বন্ধের পর শ্রীলঙ্কায় আমদানি করা পিয়াজ প্রতি কেজি ৭৮ থেকে বেড়ে ১৪১ টাকা পর্যন্ত ওঠে।
সঙ্কট মোকাবিলায় শ্রীলঙ্কা দ্রুত পাকিস্তান, মিসর ও চীন থেকে আমদানি বাড়িয়েছিল, যে কারণে দ্রুত মূল্য কমে কেজিপ্রতি ৫৮ টাকায় নেমেছে ভারত আমদানি বন্ধ করার কিছুদিন পরই।
এটা নিঃসন্দেহে বলা যায়, শুধুমাত্র সরকারের ব্যর্থতা কিংবা সরকারের একটি অংশের এই লুটপাটে অংশীদার হবার কারণে সাধারণ মানুষ হাজার হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। এই ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে কী প্রতিক্রিয়া দেখালাম আমরা?
ফেইসবুকে ভাইরাল একটা ভিডিওতে দেখা যায় একটা মেয়ে মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করে তার মেয়ের প্রতি কপট রাগ দেখিয়ে বলছে তার মেয়ে যতই বলুক না কেন, সে সাধারণ একটি মানুষ, সাধারণ পরিবারের মেয়ে আসলে সেটা ঠিক না, তারা অতি উচ্চ বংশ। এটা প্রমাণ করার জন্য সে আলমারির ড্রয়ার খুলে দেখায় তার ভেতরে পিয়াজ সাজানো আছে। আরও দেখায় মেয়ের বিয়ের জন্য পিয়াজ দিয়ে বানানো গয়নার সেট। শুধু এটাই না, ফেইসবুক এবং ইউটিউব দেখলেই দেখা যাবে, পরিচিত অনেক গানের প্যারোডি করা হয়েছে পিয়াজকে নিয়ে। পিয়াজ নিয়ে মজার মজার ভিডিও মন্তব্য করেছেন অনেকে, ছবির কোলাজ করেছেন, আর স্ট্যাটাস লিখে ফান, ট্রোল তো আছেই।
ভয়ঙ্কর অনিয়ম বীভৎসতার সঙ্গে বসবাস করতে আমরা এখন শিখে গেছি; সর্বংসহায় পরিণত হয়েছি আমরা। তীব্র ক্ষোভে ফেটে পড়ে যেসব ক্ষেত্রে রাস্তায় নেমে আসার কথা, সেসব ক্ষেত্রে রাস্তায় নামার কথা বাদই দেই, অন্তত ফেইসবুকেও আমরা ক্ষোভ, ক্রোধ উগরে দেই না। সবকিছু নিয়ে আমরা এখন মজা করি, ট্রোল করি। পিয়াজ নিয়ে এমনকি আমাদের মজাও থেমে গেছে বেশ আগেই, বাজারে দিব্যি ২৫০ টাকা কেজিতে পিয়াজ বিক্রি হচ্ছে এখনও।
ভারতে পেঁয়াজের দাম এখনো বেশি, তবে সেটা আমাদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম – ৮০ থেকে ১০০ রুপি। এই উচ্চমূল্যের কারণে ভারতেও ভর্তুকি দিয়ে ৩৫ রুপিতে পেঁয়াজ বিক্রি করছে সরকার। খবরে জানা যায়, বিভিন্ন জায়গায় এমন দামে পেঁয়াজ বিক্রি করায় স্থানীয় জনগণ হামলা করেছে, ইট-পাটকেল ছুঁড়েছে। বিক্রেতাদের প্রতি জনগণের ব্যক্তিগত কোনো রাগ নেই এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তাদেরকে সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে বিবেচনা করেই জনগণ তাদের ওপরই ক্ষোভ প্রকাশ করেছে।
জনগণের এই রোষ থেকে বাঁচতে বিহারের পাটনায় এমন একটি সরকারি পেঁয়াজ বিক্রি কেন্দ্রে বিক্রেতা হেলমেট পড়ে পেঁয়াজ বিক্রি করছে, এনডিটিভির এমন একটা সংবাদ বাংলাদেশের অনেক পত্রিকা পুনর্মুদ্রণ করেছে। হেলমেট পরিহিত বিক্রেতারা বলছেন তাঁরা চেয়েছিলেন পেঁয়াজ বিক্রির জায়গায় নিরাপত্তা দেয়া হোক, সেটা না হবার কারণে নিজ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তারা হেলমেট পড়েছেন। আমাদের তুলনায় অনেক কম মূল্য হবার পরও ভারতের জনগণ সরকারের অব্যবস্থাপনার কারণে তাদের আর্থিক ক্ষতি হওয়ায় সরকারের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠেছে এবং প্রতিবাদ করেছে।
পত্রিকার খবরে দেখা গেছে, বাংলাদেশ টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাকে পেঁয়াজ শেষ হবার কারণে জনগণের মধ্যে কিছু অসন্তোষ ছিল। কিন্তু সরকারি অব্যবস্থাপনার কোনো প্রতিবাদ টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রির ট্রাকে হয়নি। তাই টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রিতে তাদের পুলিশি নিরাপত্তা চাই, তেমন দেখা যায়নি। তেমনি কোন বিক্রেতা নিরাপত্তার জন্য হেলমেট পরেনি।
না আমি কোনোভাবেই এটা বলতে চাইছি না, টিসিবির পেঁয়াজ বিক্রি ট্রাকে হামলা করা উচিত। কিন্তু অনিয়ম আর অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে আমাদের দেশের জনগণের প্রতিবাদের মানসিকতা একেবারে শেষের পর্যায়ে চলে এসেছে। ভারতে পেঁয়াজ বিক্রেতার হেলমেট আসলে একটা প্রতীক, যেটা ভারতের মানুষের প্রতিবাদকে প্রমাণ করে। একইভাবে আমাদের দেশে এটা না থাকাটা প্রমাণ করে আমাদের প্রতিবাদহীনতাকে।
সরকারের অথর্বতা, অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা কিংবা লুটপাটের অংশীদার হওয়া যেহেতু আমাদের গা সওয়া হয়ে গেছে, সেহেতু আমাদের দেশে এই সমস্যাগুলো চলতেই থাকছে। কোনো সমস্যা সামনে এলে আমরা কিছুটা ফান করি, ট্রোল করি, তারপর আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়। এভাবে দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় বলেই এই রাষ্ট্রে সমস্যা আর শেষ হয় না, আসতেই থাকে একের পর এক।