ঢাকা: নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা। কোনো ধরনের পূর্ব ঘোষণা ছাড়া হঠাৎ করে বাস বন্ধ হয়ে যাওয়ায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের সাধারণ যাত্রীরা। তারা অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে নছিমন, করিমন ও ইজিবাইকে করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছানোর চেষ্টা করছেন।
প্রতিনিধিদের পাঠানো খবর:
নড়াইল: পূ্র্ব ঘোষণা ছাড়াই নড়াইলের অভ্যন্তরীণ ৫টি রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহন শ্রমিকরা। রোববার সন্ধ্যা থেকে এসব রুটে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা।
জানা গেছে, রোববার সকাল ১১টার দিকে নড়াইল প্রেসক্লাবের সামনে সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এর জেল জরিমানা সংশোধনসহ ১১ দফা দাবিতে নড়াইলে পরিবহন মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ মানববন্ধন এবং জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করেন। মানববন্ধনে বক্তারা প্রতিটি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩০৪/খ ধারায় মামলা দায়ের করা, মোটরযান ও চালকদের ওপর অধিক অর্থদণ্ড ও জেল জরিমানা সংশোধনের দাবি ছাড়াও ১১দফা দাবি জানান। এর ৭ ঘণ্টা পর কোনো ঘোষণা ছাড়াই শ্রমিকরা নড়াইল-যশোর, নড়াইল-লোহাগড়া, নড়াইল-মাগুরা, নড়াইল-নওয়াপাড়া ও নড়াইল-কালিয়া সড়কে বাস চলাচল বন্ধ করে দেয়।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও নড়াইল জেলা বাস মিনিবাস শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান সোমবার সকালে জানান, বাস বন্ধ রাখার ব্যাপারে সংগঠন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
তিনি বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে আলাপ না করে বাস চালক-শ্রমিকরা নতুন পরিবহন আইনের ভয়ে নিজেরাই অভ্যন্তরীণ ৫টি রুটে বাস চালানো বন্ধ রেখেছে। তবে বিক্ষিপ্তভাবে কোনো কোনো রুটে দু’একটি বাস চলছে।’
সাতক্ষীরা: সাতক্ষীরায় সোমবার সকাল থেকে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছেন শ্রমিকরা। সেখানেও যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
পরিবহন শ্রমিক নেতাদের দাবি, নতুন সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের পর এটি বাস্তবায়ন করা হোক। সংশোধন করা না হলে বাস চলাচল বন্ধই থাকবে।
সাতক্ষীরা জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যক্ষ আবু আহমেদ বলেন, ‘নতুন সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়নের প্রতিবাদে শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিয়েছে। শ্রমিকরা বাস চালানো বন্ধ করে দিলে মালিকপক্ষের কিছুই করার থাকে না।’
কুষ্টিয়া: সড়ক পরিবহন আইনের কয়েকটি ধারা সংশোধনের দাবিতে কুষ্টিয়ায় বাস ধর্মঘট করছেন শ্রমিকরা। ফলে কুষ্টিয়ার সঙ্গে আন্তঃজেলা বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। ঢাকাগামী দূরপাল্লার কিছু কিছু বাস চলাচল করলেও সকাল থেকে কুষ্টিয়ায় অধিকাংশ বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।
কুষ্টিয়া মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মাহাবুল ইসলাম জানান, অধিকাংশ পরিবহন শ্রমিকদের লাইসেন্স নেই। তাছাড়া ফিটনেস নেই অনেক পরিবহনেরই। এমতাবস্থায় মামলার ঝুঁকি নিয়ে পরিবহন চালানো সম্ভব নয়। বাধ্য হয়েই নিজেরাই বাস চলাচল বন্ধ রেখেছে শ্রমিকরা।
সোমবার থেকে সড়ক পরিবহন আইন কার্যকরের কথা থাকলেও এখন পর্যন্ত চালু হয়নি। দুপুরে আইন কার্যকর করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মাঠে নামবে বলে জানিয়েছে কুষ্টিয়া ট্রাফিক বিভাগের পরিদর্শক ফকরুল ইসলাম।
যশোর: দ্বিতীয় দিনের মতো বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছে যশোরের পরিবহন শ্রমিকরা। নতুন সড়ক আইন সংশোধনের দাবিতে রোববার দুপুর থেকে তারা স্বেচ্ছায় কর্মবিরতি শুরু করে। রাতে প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকের পর বাস চলাচল কিছুটা স্বাভাবিক হলেও সোমবার সকাল ১০টার দিকে ফের বাস চলাচল বন্ধ করে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। এতে চরম বিপাকে পড়েছেন সাধারণ যাত্রীরা।
শ্রমিকরা বলছেন, নতুন সড়ক আইন এতোটাই কঠোর করা হয়েছে যে সবসময় তাদের ‘ফাঁসির দড়ি’ গলায় নিয়ে চলতে হচ্ছে। যে জেল জরিমানা ধরা হয়েছে তা তাদের পক্ষে মানা অসম্ভব।
যশোর জেলা পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি মামুনুর রশিদ বাচ্চু বলেন, বিনা অপরাধে ফাঁসির দড়ি গলায় নিয়ে রাস্তায় নামতে নারাজ শ্রমিকরা। তাই স্বেচ্ছায় যান চলাচল বন্ধ রেখেছে সাধারণ শ্রমিকরা।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মোর্তজা হোসেন বলেন, শ্রমিকরা কাউকে ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে না। অথচ অনিচ্ছাকৃত দুর্ঘটনার জন্য নতুন প্রণীত সড়ক আইনে তাদের ঘাতক বলা হচ্ছে। তাদের জন্য এমন আইন করা হয়েছে, যা সন্ত্রাসীদের জন্য প্রযেজ্য। শুধু তাই নয়, এ আইনের অনেক ধারার ব্যাপারেই শ্রমিকদের আপত্তি রয়েছে, যা সংশোধন জরুরি। এ ব্যাপারে শুরু থেকেই শ্রমিকরা আপত্তি জানিয়ে আসছে। তবে সরকার সমাধানের কোনো উদ্যোগ না নেওয়ায় সাধারণ শ্রমিকরা স্বেচ্ছায় বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন।
কোতয়ালী মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মনিরুজ্জামান বলেন, স্বেচ্ছায় কোনো শ্রমিক গাড়ি চালালে যদি কেউ বাধা দেয় তাহলে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
মেহেরপুর: নতুন সড়ক ও পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে মেহেরপুরে আন্তঃজেলার সকল রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা।
সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নেন চালকরা। ফলে মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর-কুষ্টিয়া, মেহেরপুর-মুজিবনগর সড়কে বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
মেহেরপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মতিয়ার রহমান জানান, শ্রমিকরা সড়ক পরিবহন আইনের বেশ কিছু ধারা সংশোধন চান। বাস না চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন চালকরা। এটা ইউনিয়নের কোনো সিদ্ধান্ত নয়। ২১ নভেম্বর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের শ্রমিক নেতারা বৈঠকে বসবেন। ওই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পরবর্তী কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।
চুয়াডাঙ্গা: নতুন পরিবহন আইনের প্রতিবাদে চুয়াডাঙ্গায় বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন শ্রমিকরা।
সোমবার চুয়াডাঙ্গা থেকে যাত্রীবাহী অভ্যন্তরীণ ও দুরপাল্লার বাস ছেড়ে যায়নি।
নতুন পরিবহন আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে চুয়াডাঙ্গায় বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ চরম ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তারা ফিটনেসবিহীন নসিমন, করিমনসহ অন্যান্য যানবাহনে যাতায়াত করছে।
ভোগান্তির শিকার যাত্রীরা জানান, এক দিকে হয়রানি, অন্য দিকে সময় ও বাড়তি ভাড়া লাগছে। তাই দ্রুত পরিবহন শ্রমিকরা রাস্তায় গাড়ি চালানো শুরু করুক। আইনের প্রতি সবাই সম্মান দেখাক।
চুয়াডাঙ্গা জেলা বাস ট্রাক মালিক শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রিপন মণ্ডল বলেন, ‘আমরা কোন পরিবহন ধর্মঘট ডাকিনি। নতুন যে সড়ক আইন হয়েছে তার বাস্তবায়ন চাই।
মাগুরা: সড়ক পরিবহন আইনের প্রতিবাদে সোমবার মাগুরা-যশোর সড়কে দ্বিতীয় দিনের মতো বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। হঠাৎ এ ধর্মঘটে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। বিকল্প হিসেবে ইজিবাইক, টেম্পু ও সিএনজিতে করে দ্বিগুণ অর্থ ও অধিক সময় ব্যয় করতে হচ্ছে যাত্রীদের।
জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ইমদাদুর রহমান জানান, সম্প্রতি সরকার সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে চালকের ৫ বছরের জেল ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানার বিধান করায় সাধারণ শ্রমিকরা এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘এ আইন বাতিলের প্রতিশ্রুতি না পেলে শ্রমিকরা ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।’
কলেজ ছাত্র ইমন মিয়া ও চাকরিজীবী আকরাম হোসেন জানান, তাদের প্রতিদিন যশোর-মাগুরা যাতায়াত করতে হয়। কিন্তু মাগুরা থেকে যশোরের বাস ভাড়া ৬০ টাকা হলেও এখন এক থেকে দেড়শ টাকা দিয়ে ইজিবাইক, টেম্পু ও সিএনজিতে করে যাতায়াত করতে হচ্ছে। এতে অর্থ ও সময় উভয় বেশি লাগছে।
মাগুরা ভায়না মোড় বাস কাউন্টারের ষ্ট্যাটার নবাব আলী বলেন, ‘ধর্মঘটের ফলে যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। এ ধর্মঘটের সাথে তাদের মালিকপক্ষের সংশ্লিষ্টতা নেই। দুর্ঘটনায় মৃত্যুজনিত কারণে চালকের বিরুদ্ধের সরকার জেল, জরিমানার নতুন আইন করায় তারা এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন।
তবে মাগুরা-যশোর সড়কে বাস চলাচল বন্ধ থাকলেও হাইওয়ে সড়কে ঢাকাগামী পরিবহন ও জেলার অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে।
নাটোর:
নাটোরে সকাল থেকে যাত্রিবাহী বাস চলাচল কম দেখা গেছে।
পরিবহন শ্রমিকরা বলছেন, নতুন সড়ক পরিবহন আইনে চালকরা বাস চালাতে ভয় পাচ্ছেন। এছাড়া বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে বাস ধর্মঘট। এর ফলে সড়কে কমে গেছে যাত্রীবাহী বাসের সংখ্যা।
এদিকে যাত্রীবাহী বাস কমে যাওয়ায় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের। বিশেষ করে দূরপাল্লার যাত্রীদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
যাত্রীদের ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসস্ট্যান্ড ও টার্মিনালে দাঁড়িয়ে থেকে অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাসের জন্য। দু-একটি বাস পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই যাত্রীরা হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন বাসে ওঠার জন্য।