মূল বক্তব্যে যাবার আগে ভীষণ আলোচিত চারটি ঘটনা একটু দেখে নেয়া যাক। গত ১০ বছরে এমন ঘটনার উদাহরণ অনেক দেয়া যাবে, তবে এই ঘটনাগুলো বেছে নেয়ার কারণ ঘটনাগুলো ঘটেছে সাম্প্রতিককালে। চারটি ঘটনার মধ্যেই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং রাষ্ট্রের জন্য খুবই ভীতিকর মিল আছে; সেই মিলের জায়গাটি নিয়েই এই লেখা।
১. মানবতাবিরোধী অপরাধের ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজকে পেশাগত অসদাচরণ, শৃঙ্খলা-আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে তার পদ থেকে অপসারণ করা হয়েছে। জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) ও পাসপোর্ট অধিদফতরের সাবেক মহাপরিচালক (ডিজি) মুহাম্মদ ওয়াহিদুল হকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ মামলা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। গত বছর এপ্রিলে অভিযোগ ওঠে, মামলা পরিচালনার দায়িত্ব পাওয়ার পর ২০১৭ সালের নভেম্বরে ওয়াহিদুল হককে ফোন করে কথা বলেন তুরিন। পরে পরিচয় গোপন করে ঢাকার একটি হোটেলে তার সঙ্গে দেখাও করেন। তুরিনকে অপসারণের কারণ হিসেবে আইনমন্ত্রী স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন তুরিনের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। ট্রাইব্যুনালেরই আরেকজন প্রসিকিউটর জনাব জিয়াদ আল মালুম বলেছেন তুরিনের অপরাধ একটি ফৌজদারি অপরাধ।
কিন্তু আমরা এখনো তার বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারী ব্যবস্থার প্রাথমিক পদক্ষেপ দেখতে পাইনি, তার বিরুদ্ধে শাস্তি অপসারণেই শেষ হয়েছে।
২. তথাকথিত শুদ্ধি অভিযানের মধ্যে বিশেষ নিরীক্ষায় ধরা খেয়ে ইসলামিক ফাউণ্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল কয়েক দফায় আত্মসাৎকৃত ৭৪ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছেন। ইসলামিক ফাউণ্ডেশনে (ইফা) গত ১০ বছরে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা নয়-ছয় করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের সরাসরি ক্ষতি হয়েছে ৩৭২ কোটি ৬৯ লাখ ৬৪ হাজার ৫৩৭ টাকা এবং বিধিবহির্ভূতভাবে খরচ করা হয়েছে ৫১৮ কোটি ৬০ লাখ ৬৯ হাজার ৭৯৮ টাকা। প্রতিষ্ঠানটির ১৩৪ খাতে এসব অনিয়ম করা হয়েছে। সিভিল অডিট অধিদফতরের বিশেষ নিরীক্ষা দলের ২০০৯-২০১৮ অর্থবছরের প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য।
ইনি তুরিন আফরোজ এর চাইতে অনেক বেশি ভাগ্যবান, দুর্নীতির প্রমাণ থাকলেও এখনো তিনি স্বপদে বহাল আছেন, কোনো ফৌজদারি ব্যবস্থা নেয়া দূরেই থাকুক।
৩. কুখ্যাত পুলিশ কর্মকর্তা এস পি হারুন কী করেছে তার চমৎকার দলিল হয়ে থাকবে মানবজমিনের দু’টি রিপোর্ট। তার গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জ অধ্যায়ের উপরে করা সেই অনুসন্ধানী রিপোর্ট দু’টো আমাদেরকে হতবাক করে দেয়। একটা রাষ্ট্রীয় বাহিনীর দায়িত্বে থেকে রাষ্ট্রীয় ইউনিফর্মের বীভৎস অপব্যবহার করে একজন মানুষ কি করে সাধারণ জনগণকে, ব্যবসায়ীদেরকে নির্যাতন এবং ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে তাদের কাছ থেকে কোটি কোটি নগদ টাকা এবং জমি হাতিয়ে নিয়েছেন।
সম্প্রতি চাঁদা দিতে রাজি না হওয়ায় এক বিখ্যাত ব্যবসায়ীর স্ত্রী-সন্তানকে ঢাকা থেকে তুলে নিয়ে যান নারায়ণগঞ্জে। তার এই অপরাধের জন্য সরকার তাকে শাস্তিমূলক ভাবে ঢাকায় পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সে বদলি করে। এই ঘটনার কারণে হারুনকে বদলি করা হয়েছে তার প্রমাণ আছে হারুনের বিদায় দিনের বক্তব্য। ফেইসবুক এর ভাইরাল হওয়া বক্তব্যে দেখা যায় কাঁদতে কাঁদতে হারুন ওই ঘটনাকে ইঙ্গিত করে বলছেন, তাকে চক্রান্ত করে নারায়গঞ্জ থেকে সরানো হয়েছে। বলা বাহুল্য, হারুনের শাস্তিও বদলিতেই শেষ হয়েছে। তিনি নিয়মিত রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে বেতন ভাতাও পাচ্ছেন।
৪. এর কিছুদিন আগে ছাত্রলীগের সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অপসারিত হয়েছিল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন কর্মকান্ডে বরাদ্দকৃত দেড় হাজার কোটি টাকা থেকে ৮৬ কোটি টাকা চাঁদা দাবি করে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই বিষয়টাকে মাথায় রেখেই নজিরবিহীনভাবে তাদেরকে পদ থেকে সরিয়ে দেন। শোভন-রাব্বানী যে চাঁদা চেয়েছিলেন এটারও প্রমাণ আছে। একটি জাতীয় পত্রিকার কাছে তারা বলেছিলেন এই উন্নয়ন কর্মকা-ের ‘ন্যায্য’ হিস্যা তারা চেয়েছিলেন। আত্মস্বীকৃত এই অপরাধীদের শুধু অপসারণেই সবকিছু শেষ হয়েছে, কোন ফৌজদারি ব্যবস্থা আমরা তাদের বিরুদ্ধে দেখিনি।
হ্যাঁ, এই ঘটনাগুলোর মধ্যকার মিলটি হলো ভয়ঙ্কর ফৌজদারি অপরাধে অভিযুক্ত হয়েও সরকারের আস্থাভাজন ব্যক্তিরা কেউ দায়িত্ব থেকে অব্যহতি পান, কেউ শাস্তিমূলক বদলি হন এমনকি কেউ নিজ পদে থেকে যান বহাল তবিয়তে, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি কার্যধারা মোতাবেক কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফৌজদারি কার্যবিধিতে স্পষ্ট বলা আছে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে থানায় ফার্স্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট (এফআইআর) দায়ের করতে হবে। এফআইআর দায়েরের সাথে যেহেতু গ্রেফতারের বিষয়টি জড়িত তাই অভিযুক্তকে জামিন নিতে হয়। এফআইআর পর পুলিশ তদন্ত করে হয় তাদের নামে চার্জশিট দাখিল করে অথবা তারা চার্জশিট থেকে অব্যহতি পায়। অথচ ওপরে আলচিত এই সকল ক্ষেত্রে দেখা গেছে তাদের বিরুদ্ধে সব ভয়ঙ্কর অভিযোগ ওঠা, ভিডিও ফুটেজ বা অডিও ক্লিপ থাকা সত্ত্বেও আইনের স্বাভাবিক পথে না গিয়ে বারবার বলা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের তদন্ত চলছে। এই ধরণের আচরণ অপরাধীকে শুধু স্বস্তিতেই রাখে না, বরং নতুন নতুন অপরাধী তৈরিতে সাহায্য করে। দেশে আইনও আছে, শাসনও আছে, নেই কেবল আইনের শাসন। আইনের শাসনের জন্য বিচার দৃশ্যমান হওয়া অত্যন্ত জরুরি। যে দেশে আইনের প্রয়োগ, গতি, ফলাফল ব্যক্তির পরিচয়ভেদে ভিন্ন ভিন্ন সে দেশে আর যাই হোক ন্যায়বিচার, সুশাসন বা আইনের শাসন কিছু ক্লিশেই শব্দের বাইরে ভিন্ন কোনো অর্থ বহন করে না।