ঢাকা: তালিকায় আছেন বর্তমান তিন সাংসদ, সাবেক এক সাংসদ, সম্রাটসহ যুবলীগের দুই ডজন নেতা, কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার, গণপূর্তের শীর্ষ পর্যায়ের ১৫ প্রকৌশলী, ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতা।
এবার ১০৫ জনের ব্যাংক হিসাব তলব করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তের আওতায় থাকা এসব ব্যক্তির ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য দ্রুততম সময়ের মধ্যে দুদককে সরবরাহ করতে বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটকে (বিএফআইইউ) অনুরোধ জানানো হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, আজ রোববার পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের সই করা এ–সংক্রান্ত একটি চিঠি বিএফআইউর প্রধান বরাবর পাঠানো হয়েছে। ওই চিঠিতে ১০৫ জনের নাম, ঠিকানা ও পদবি উল্লেখ করে তাঁদের সব তথ্য চাওয়া হয়েছে। তালিকায় আছেন বর্তমান তিন সাংসদ, সাবেক এক সাংসদ, সম্রাটসহ যুবলীগের দুই ডজন নেতা, কয়েকজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার, গণপূর্তের শীর্ষ পর্যায়ের ১৫ প্রকৌশলী, ব্যবসায়ীসহ আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের কয়েকজন নেতা।
এর আগে গত ২৮ অক্টোবর অন্তত ১০০ জনের হিসাব চেয়ে বিএফআইউতে চিঠি পাঠায় দুদক। ওই তালিকার বেশ কয়েকজনের নামও এই তালিকায় আছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ‘শুদ্ধি’ অভিযান শুরুর পর দুদক প্রথমে ৪৩ জনের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরুর কথা জানালেও এই তালিকা দিন দিন বড় হচ্ছে। সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, এ তালিকায় এখন ১৩৫ জনের নাম আছে। দুদক এ পর্যন্ত ৩৪ জনের বিদেশযাত্রায় নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। ১৪টি মামলায় আসামিদের সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।
দুদক সূত্র জানিয়েছে, যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট ও ঠিকাদার জি কে শামীমের সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে যাঁদের নাম এসেছে, তাঁদের অনেকেরই নাম আছে নতুন এই তালিকায়। এ ছাড়া শুদ্ধি অভিযানে বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে যাঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ এসেছে, তাঁদের নামও ওই তালিকায় রয়েছে। সূত্র জানায়, তালিকায় থাকা কয়েকজনের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলার এজাহারে অনেকের অবৈধ সম্পদের পূর্ণাঙ্গ বিবরণ দিতে পারেনি দুদক। তদন্তের সময় সে ঘাটতি পূরণের জন্য এসব তথ্য চাওয়া হয়। এ ছাড়া যাঁদের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে এবং মামলার প্রক্রিয়া চলছে, তাঁদের স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের তথ্য সংগ্রহের অংশ হিসেবে ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে।
মামলার তদন্তের অংশ হিসেবে যাঁদের ব্যাংক ও আর্থিক লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে, তাঁরা হলেন ইসমাইল হোসেন চৌধুরী সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, এনামুল হক আরমান, জি কে শামীম, শামীমের মা আয়েশা আক্তার, গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি এনামুল হক, যুগ্ম সম্পাদক রূপন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি ও কৃষক লীগ নেতা শফিকুল আলম, যুবলীগের বহিষ্কৃত দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান, ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, তারেকুজ্জামান রাজীব, মিজানুর রহমান, মোহামেডান ক্লাবের পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনো ব্যবসায়ী সেলিম প্রধান ও যুবলীগের নির্বাহী সদস্য জাকির হোসেন। এঁদের সবার বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করেছে দুদক। এখন মামলার তদন্ত চলছে।
এ ছাড়া অনুসন্ধানের স্বার্থে যাঁদের ব্যাংকিং লেনদেনের তথ্য চাওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি মোল্লা আবু কাওসার, সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাংসদ পংকজ নাথ, সাংসদ নুরুন্নবী চৌধুরী শাওন ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা চৌধুরী, জাতীয় সংসদের হুইপ শামসুল হক চৌধুরী, ওয়ারী থানা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রাশেদুল হক ভূঁইয়া, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক বাতেনুল হক ভূঁইয়া, মো. জহুর আলম, হারুনুর রশিদ, ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা মোমিনুল হক, ঢাকা দক্ষিণের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ওরফে ম্যাজিক রতন, ৩৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ময়নুল হক ওরফে মঞ্জু।
ক্ষমতাসীন দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের যেসব নেতার হিসাব চাওয়া হয়েছে তাঁরা হলেন যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি সারোয়ার হোসেন ওরফে মনা, যুগ্ম সম্পাদক সোহরাব হোসেন, নির্বাহী সদস্য মিজানুর রহমান, ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উত্তরের সাবেক সভাপতি এস এম রবিউল ইসলাম, যুবলীগ নাখালপাড়া-তেজগাঁও শাখার কাজল, ৪১ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সহসভাপতি তাবিবুল হক, শাহেদুল হক, তাঁর স্ত্রী সারিনা তামান্না হক, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদ্য সাবেক নেতা কে এম মাসুদুর রহমান, তাঁর স্ত্রী লুৎফুন্নাহার লুনা, বাবা আবুল খায়ের খান, মা রাজিয়া খান, যুবলীগ দক্ষিণের সহসভাপতি মুরসালিক আহমেদ, তাঁর স্ত্রী কাওসারী আজাদ, বাবা আবদুল লতিফ, মা আছিয়া বেগম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা কামরান প্রিন্স মোহাব্বত, যুবলীগের আকিয়ার রহমান, কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এমরান হোসেন খান, কেন্দ্রীয় সদস্য হেলাল আকবর চৌধুরী, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সম্পাদক শফিকুল ইসলাম, শ্রমবিষয়ক সম্পাদক তসলিম উদ্দিন, মুক্তিযোদ্ধাবিষয়ক সম্পাদক কায়সার আহমেদ, যুবলীগ উত্তরের সাংগঠনিক সম্পাদক তাজুল ইসলাম চৌধুরী এবং যুবলীগের গাজী সারোয়ার।
দেশের বাইরে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান ও নাদিম, মেসার্স জামাল অ্যান্ড কোম্পানির ঠিকাদার জামাল হোসেন, জি কে শামীমের স্ত্রী শামীমা সুলতানা, সহযোগী জিয়া, নাঈম, শেখ মাহাম্মুদ জুনায়েদ, এস এম আজমুল হোসেন ও ব্রজ গোপাল হালদারের হিসাব চাওয়া হয়েছে।
বান্দরবানের সিলভান ওয়াই রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা সেন্টারের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন, এমডি ফজলুল করিম চৌধুরী, পরিচালক এম মহসিন, উম্মে হাবিবা নাসিমা আক্তার, জিয়া উদ্দিন আবীর, জাওয়াদ উদ্দিন, বনানী গোল্ড ক্লাবের আবদুল আওয়াল, আবুল কাশেম, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের প্রায় তিন হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ–সংশ্লিষ্ট এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফিন্যান্সের সাবেক এমডি প্রশান্ত কুমার হালদার, শরফুল আওয়াল, পদ্মা অ্যাসোসিয়েটস ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদার মিনারুল চাকলাদার, সাবেক সাংসদ ইঞ্জিনিয়ার মুজিবুর রহমান, ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ইঞ্জিনিয়ার্সের ঠিকাদার রেজোয়ান মোস্তাফিজ, মগবাজার টিঅ্যান্ডটি কলোনির জাকির, নয়াটোলার সেন্টু, শোভন, বাড্ডার নাসির, ওয়ান্ডারার্স ক্লাবের আবুল কালাম, শিক্ষা অধিদপ্তরের ঠিকাদার শফিকুল ইসলাম, ঢাবি এফ রহমান হলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমানের হিসাব চাওয়া হয়েছে।
তালিকায় রয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী শাহাদাত হোসেন, রফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী উৎপল কুমার দে, আবদুল হাই, হাফিজুর রহমান মুন্সী, নির্বাহী প্রকৌশলী ফজলুল হক মধু, শওকত উল্লাহ, ফজলুল হক, রোকন উদ্দিন, আফসার উদ্দিন, স্বপন চাকমা, ইলিয়াস আহমেদ ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবদুল মোমিন চৌধুরী, গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা শাখার সিনিয়র সহকারী প্রধান মুমিতুর রহমান, সাজ্জাদ, উপসহকারী প্রকৌশলী আলী আকবর সরকার, খাদ্য পরিদর্শক খোরশেদ আলম।
কমলাপুর আইসিডির কমিশনার মো. আনোয়ার হোসেন, অতিরিক্ত কমিশনার মো. মাহমুদুল হাসান, সহকারী কমিশনার কানিজ ফারহানা, আবুল কাশেম, সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তুহিনুল হকের ব্যাংক হিসাবের তথ্যও চাওয়া হয়েছে।
সেপ্টেম্বরে শুদ্ধি অভিযান শুরুর প্রথম দিনই রাজধানীর ইয়ংমেনস ফকিরাপুল ক্লাব থেকে গ্রেপ্তার হন ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক (পরে বহিষ্কৃত) খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া। এরপর বিভিন্ন অভিযানে একে একে গ্রেপ্তার হন কথিত যুবলীগ নেতা ও ঠিকাদার গোলাম কিবরিয়া শামীম ওরফে জি কে শামীম, মোহামেডান ক্লাবের ডিরেক্টর ইনচার্জ লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সভাপতি (বহিষ্কৃত) ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, তাঁর সহযোগী এনামুল হক ওরফে আরমান, কলাবাগান ক্রীড়া চক্রের সভাপতি শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান এবং ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান, তারেকুজ্জামান রাজীব ও ময়নুল হক মঞ্জু।
অবৈধভাবে বিপুল অর্থের মালিক হওয়া, অর্থ পাচারসহ নানা অভিযোগ ওঠে এসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে। জিজ্ঞাসাবাদে তাঁদের অপকর্মে সহযোগী ও পৃষ্ঠপোষক হিসেবে সাংসদ, রাজনীতিক, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিভিন্নজনের নাম বেরিয়ে আসে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্তের পাশাপাশি অবৈধ সম্পদের খোঁজে মাঠে নামে দুদকও। গত ৩০ সেপ্টেম্বর বিতর্কিতদের সম্পদ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক। এ জন্য পরিচালক সৈয়দ ইকবাল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের অনুসন্ধান দল গঠন করে দুদক। পরে আরও দুজনকে দলে যুক্ত করা হয়।
অনুসন্ধান দল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে এ নিয়ে ১৪টি আলাদা মামলা করেছে ঠিকাদার জি কে শামীম, বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া, আওয়ামী লীগ নেতা এনামুল হক ও তাঁর ভাই রুপন ভূঁইয়া, অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান, বিসিবি পরিচালক লোকমান হোসেন ভূঁইয়া, কলাবাগান ক্লাবের সভাপতি শফিকুল আলম ফিরোজ এবং যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক আনিসুর রহমান ও তাঁর স্ত্রী সুমি রহমান এবং কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান, তারেকুজ্জামান রাজীব, ইসমাইল চৌধুরী সম্রাট, এনামুল হক আরমান ও জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে।