ঢাকা: আজকের সকালটা একটা সিনেমার চেয়ে কোন অংশে কম ছিল না। সকালে ঘুম ভাঙলো ডামুড্যা থানার ওসি’র ফোন কলে। মজার বিষয় হলো রাতে ১:৩০ এর দিকে উনিই শেষ কল দিয়েছিলেন। রাতে শেষ কলের সময় উনার ভাষা ছিল ” সরি স্যার ডিস্টার্ব করলাম কিন্তু উপায় নেই এখনই সিদ্ধান্ত নিতে হবে….. ইত্যাদি ইত্যাদি।” এভাবে বলার কারণ হতে পারে যেহেতু থানার পাশেই আমার অফিস তাই উনি দেখতে পান আমার গাড়ি রাতে কখন বাসায় ফিরে; দেরীতে ফিরায় তার জানাই ছিল আমি দিনভর কাজে ক্লান্ত হয়ে থাকতে পারি। আইনেই যেখানে লেখা আছে “পুলিশ ২৪ ঘন্টা ডিউটিরত থাকিবে” সেখানে বিরক্ত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।
যাই হোক, সকালের প্রথম ফোন কলে আর উনি সরি–টরি বলার মুডে ছিলেন না। সোজা সাপের মন্তরের মত একদমে বলে গেলেন,” স্যার, একটা বাস ৩০-৪০ জন মানুষ নিয়ে খেজুরতলা এলাকায় রাস্তার পাশে পানিতে পড়েছে! ফায়ার সার্ভিস নাকি ঠিকমত নামতে পারছে না, কি একটা সমস্যা হয়েছে জনগনের সাথে! স্যার, আপনি আসেন আমি রওয়ানা দিলাম।” আমি আধো ঘুমের মাঝে ছিলাম, চোখ জ্বলা একটা অনুভুতি থাকে সেসময়; ওদিকে কল শেষে শুধু দু-তিনটা শব্দ যেন আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল—
একটি বাস—- ৩০-৪০ যাত্রী—- পানির মাঝে ডুবন্ত মানুষ!
রোবটের মত রেডি হতে শুরু করলাম; চোখে মুখে পানিও দেয়া হয় নি। পুলিশ একাডেমি, সারদা-তে আমাদের এক মিনিট সময় দিয়ে বলা হতো ইউনিফর্ম পড়ে রেডি হয়ে আসতে; আজ মনে হয় ২৫ সেকেন্ড ও লাগে নি। কারণ তখন আর ইউনিফর্ম পড়াটাই জরুরী মনে হয় নি; ইউনিফর্ম পড়লে পুলিশ আর না পড়লে আগে আমরা মানুষ; তখন মনে হচ্ছিল মানুষ আমাকেই আজ বেশি দরকার। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে এসপি স্যার ফোন দিয়ে বসলেন; স্যার নিচের কেচি গেট খোলার শব্দ পেলেন। স্যারের নির্দেশনা শুনতে শুনতে আমি গাড়ির দড়জা ধরে দাঁড়িয়ে আছি। নাম ধরে আমার বডিগার্ডকে ডাকছি, ড্রাইভারকে ডাকছি; ওরা তো অবাক যে এমন তো হয় না যে স্যার আগে এসে দাঁড়িয়ে আছে, তাও দড়জা ধরে।
যাহোক গাড়িতে ৫–৭ মিনিটের পথ; হুটার বাজিয়ে যাচ্ছি আর ভাবছি একটা মানুষও যদি বাচানো যায় তবে সারাজীবন মনকে শান্তনা দিয়ে বলব, পুলিশে জয়েন করে ভুল করি নি– মানুষ যা–ই বলুক। ভীর ঠেলে পৌঁছলাম যতক্ষনে ততক্ষণ উদ্ধারকাজ চলছে। ভালো লাগল দেখে, কিছু পুলিশ ক্রাউড কন্ট্রোল করছে, ভেস্ট পড়ে হাত বাড়িয়ে পানি থেকে টেনে তুলছে ভিক্টিমদের, ফায়ার সার্ভিসের একজন ডুবুরি কিছু এলাকার মানুষ সহ উদ্ধার কাজ চালাচ্ছে। এর মধ্যে আমার অফিসের দুজন ইউনিফর্ম পড়া পুলিশ সদস্য সহ কিছু সিভিল ড্রেসের সদস্যও নামিয়ে দিলাম। শেষের দিকে আরো মানুষ নিচে থাকতে পারে– এই ভেবে আমাকে একটু জিজ্ঞেস করেই থানার ওসি সাহেব নিজেই ইউনিফর্ম পড়া অবস্থায় নেমে পড়লেন! সে এক স্বর্গীয় দৃশ্যের অবতারনা হলো; পুলিশ নামা দেখে ৩০–৪০ জন সাধারণ মানুষ নেমে অভিযানে শরিক হয়ে পড়লো!
রাস্তার পাশে পানিতে কাত হয়ে পড়ে থাকা বাসের একপাশের জানালা দিয়ে নারী– শিশু– বৃদ্ধ মিলে প্রায় ২০-২৫ জন দ্রুতই উদ্ধার করা হয়েছিল।স্থুল শরীরের একজনকে বের করতে বেশ সময় লাগায় হসপিতালে পৌঁছার আগেই সে মারা যায়। এর মধ্যে ডামুড্যা হেলথ কমপ্লেক্সের টি এইস ও মহোদয় আমাকে ফোন দিয়ে বললেন, “ভাই, এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, তাই পুলিশ দিয়ে যত সম্ভব গাড়ি–অটো ঐদিকে পাঠান।” আমি নিজেই গাড়ি নিয়ে সেখানে আছি জেনে উনি স্বস্তি নিয়ে ফোন রাখলেন। অনেক অটো দৌঁড়ে আসছিল উদ্ধারকৃত লোকদের বহন করে দ্রুত হসপিতালে পৌছানোর জন্যে। সবার সম্মিলিত প্রয়াস ছিল চোখে পড়ার মত; এর মধ্যেই উদ্ধারকাজ এগিয়ে যাচ্ছিল। শুরুর দিকেই সব শিশু–মহিলাদের বের করে সুস্থ বা আপাত বিপদমুক্ত অবস্থায় পাঠিয়ে দিতে পারায় উদ্ধার ইউনিটের সবার একটা স্বস্তি ছিল। কিন্ত এর মধ্যেই উদ্ধার করতে নামা একজন ঘটনার আকষ্মিকতা ও ভয়াবহতা দেখে হৃদ যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে সেখানেই লুটিয়ে পড়েন। হসপিতালে মৃতের সংখ্যা তখনো দুই। পরবর্তিতে আশংকাজনক অবস্থায় আমেরিকা প্রবাসী এক আশিতিপর বৃদ্ধকে উদ্ধার করা হলেও উন্নত চিকিৎসার জন্যে ঢাকা নেয়ার পথে তিনি মারা যান।
পরবর্তীতে সময় কাটলো সাংবাদিক ভাইদের তথ্য দিতে আর এসপি স্যারকে বার কয়েক তথ্য দেয়ার মাধ্যমে। অন্যান্য আইনি প্রক্রিয়া ও বাস উত্তোলনের কাজ ও চলতে লাগল। ঘটনার আকষ্মিকতা শেষে মিটিং এর জন্যে রেডি হতে যখন বাসায় গিয়েছি তখন দুপুর। আমার একজন স্টাফ হঠাত জিজ্ঞেস করলো,”স্যার নাস্তা করেছেন?”
আমি তখন ভাবছি, মানুষই যেখানে কষ্টে–দম আটকে মারা যাচ্ছে সেখানে একজনের নাস্তা করা না করা নিয়ে কী আর আসে যায়??
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, গোসাইরহাট সার্কেল, শরীয়তপুরDinar Mohaiminul স্যারের ওয়াল থেকে।