আমার ছেলে একটা সিগারেট পর্যন্ত ধরাতো না। আজ তারা ওকে মাদকাসক্ত বলছে। সেই দিন গণতন্ত্রের জন্য জীবন দিয়ে আমার নূর কি ভুল করেছিলো? অশ্রুসিক্ত চোখ মুছতে মুছতে কথাগুলো বলছিলেন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শহীদ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি। ছেলে হত্যার ৩৩ বছর পর হতভাগা এই মা গতকাল স্বজনদের নিয়ে অবস্থান নিয়েছিলেন রাজপথে। এতদিন ছেলে হত্যার বিচার দাবি করে আসা এই মায়ের ব্যতিক্রমী এ প্রতিবাদ ছিল ছেলেকে নিয়ে কটুক্তির। যেই স্বৈর শাসকের বিরুদ্ধে রাজপথে প্রতিবাদ করতে গিয়ে জীবন দিয়েছিলেন নুর হোসেন তার হাতে গড়া দল জাতীয় পার্টির মহাসচিব মশিউর রহমান রাঙা রোববার এক অনুষ্ঠানে নুর হোসেনকে নিয়ে কটুক্তি করেন। যার তীব্র সমালোচনা হচ্ছে চারপাশে। ছেলেকে নিয়ে অপবাদ সইতে না পেরে পরিবারের সবাইকে নিয়ে রাস্তা নেমে আসেন মরিয়ম বিবি।
দাবি একটাই জাপার মহাস?চিব নিঃশর্ত ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত অবস্থান থেকে সরবেন না তিনি।
নূর হোসেনের মা বলেন, রাঙ্গা কোন বিবেকে এই কথা বললো? তিনি কি এসে দেখেছেন, আমার ছেলে দেশের জন্য শহীদ হয়ে?ছে। নূর জনগণের জন্য রাজপথে নেমেছিলো, বড়লোক হওয়ার জন্য না। তি?নি ব?লেন, (নূর) যদি নেশাখোর হত, তাহলে দেশের জন্য জীবন দিত না। কারণ, কোন নেশাখোর দেশের জন্য জীবন দেয় না। যে লোক আমার ছেলেকে এই কথা বলেছে, তার বিচার জনগণের কাছে ছেড়ে দিলাম। তিনি বলেন, প্রয়োজনে আমি রাঙ্গার বিরুদ্ধে মামলা করতে রাজি আছি। এখন আমি জনগণের কাছে বিচার চাই। তাঁকে (রাঙ্গা) ক্ষমা চাইতে হবে। তা না হওয়া পর্যন্ত আমি বুড়ো মানুষ, কষ্ট হলেও এইখানে বসে থাকবো। নূর হোসেন হত্যারও বিচার হয় নাই। সেই বিচারও আমি চাই। রাঙ্গা তো মন্ত্রী ছিলো, সে কোন জ্ঞানে এমন কথা বলে? গতকাল বিকেল চারটায় নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা তাঁদের প্রতিবাদী অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন। প্রেসক্লাবের মূল গেটের পশ্চিম পাশের ফুটপাথে তাঁরা অবস্থান নেন। শহীদ নূর হোসেনের মা মরিয়ম বিবি, নূর হোসেনের তিন ভাই, একবোন, ভাইয়ের স্ত্রী সন্তানসহ পরিবারের ১২ সদস্য এই অবস্থানে অংশ নেন। গত রোববার (১০ নভেম্বর) জাতীয় পার্টির মহানগর উত্তর শাখার উদ্যোগে গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শহীদ নূর হোসেন মাদকাসক্ত ছিলেন বলে মন্তব্য করেন জাতীয় পার্টির (জাপা) মহাসচিব মসিউর রহমান (রাঙ্গা)। জাপা বনানীর কার্যালয়ে এই আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। মসিউর রহমান ওই অনুষ্ঠানে বলেন, ‘হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ কাকে হত্যা করলেন। নূর হোসেনকে? নূর হোসেন কে? একটা অ্যাডিকটেড ছেলে। একটা ইয়াবাখোর, ফেনসিডিলখোর।’ এমন বক্তব্যের প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্ধ শহীদ নূর হোসেনের পরিবারের সদস্যরা। নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন বলেন, ৩৩ বছর ধরে নূর হোসেনকে সম্মান দিচ্ছে এই জাতি। তাকে গণতন্ত্রের প্রতীক বলে জনগণ। শহীদ নূর হোসেনকে নিয়ে গণতন্ত্র দিবসও পালন করা হয়। সে গণতন্ত্রের জন্য মারা গেল। এখন তারই সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ কথা বলা কেমন কথা হলো? আমাদের রাস্তায় নামতে হলো কেন? গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যারা মারা গেছে তাদের অবমাননা হলো। শহীদ পরিবারের অবমাননা হলো। নূর হোসেন হত্যাকাণ্ডের জন্য স্বৈরাচার এরশাদ সংসদে বসে মাফ চেয়েছিলো, আমার বাবার কাছে মাফ চেয়েছিল। ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু হলো শহীদ নূর হোসেন গণতন্ত্র দিবস। প্রতিবছর ১০ই নভেম্বর তা পালন করা হয়। এই সময়েই কেন এ বক্তব্য রাঙ্গা দিলেন। জনগণের কাছে আমাদের দাবি, এই লোকের বিচার হোক। এই লোকের নাম মুখে নিতেও কষ্ট হচ্ছে। বলেন, তো তখন কি ফেনসিডিলের ব্যবহার ছিল, ইয়াবার ব্যবহার ছিল?, নূর হোসেনের বড় ভাই আলী হোসেন আরো বলেন, দেশের জন্য প্রতিবাদ করে উনি যদি গাঁজাখোর, ইয়াবাখোর ও ফেনসিডিলখোর বলা হয় তাহলে দেশের মানুষ কিভাবে প্রতিবাদ করবে। এ ধরনের কথা বললে তো কখনো ভালো মানুষ প্রতিবাদ করতে আসবে না। তখন একটা দেশে পরিস্থিতি ছিল, স্বৈরাচার দেশে ভর করেছিল। ওই সময় আন্দোলন করে তাকে হঠানো হয়েছে। ওই সময় অনেক লোক মারা গেছে। এই শহীদদের এখন অপমান করা হল। গণতন্ত্রের আন্দোলনে যারা মারা গেছে, তাদেরকে এত ছোট করছেন কেন? তিনি বলেন, এদেশের জনগণ রাঙ্গার বিচার করে দিতে পারে। আইন কোনো কিছু না, আইন ধরাবাঁধা। জনগণের আদালতে অনেক বিচারই হয়েছে এদেশে। এমন কথা বললে ওর এদেশে থাকার অধিকার নাই। জনগণের প্রতি আহবান জানাবো, রাঙ্গাকে বয়কট করা হোক। ওর এমপি পদ কেড়ে নেয়া হোক। রাঙ্গাকে উল্টো নেশাখোর মন্তব্য করে তিনি বলেন কালকে উনি যখন কথা বললেন তাকেই তো নেশাখোরের মতো লাগছিলো, কেমন চোখগুলো বেরিয়ে যাচ্ছিলো। তিনি বলেন, একটা আইনি ব্যবস্থা নিতে হলে সময় দরকার। সে তো আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়েও যেতে পারে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। এছাড়াও, প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুষ্ঠু বিচারের দাবিও জানান। রাঙ্গা জাতির কাছে ক্ষমা না চাওয়া পর্যন্ত অবস্থান কর্মসূচি চলবে বলেও জানান তিনি।
রাঙ্গার শাস্তি চান সাবেক ছাত্রনেতারা: নূর হোসেন নেশাগ্রস্থ ছিলেন, ইয়াবা এবং ফেন্সিডিল আসক্ত ছিলেন’ জাতীয় পার্টির মহাসচিব মসিউর রহমান রাঙ্গার এমন বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানিয়ে তার শাস্তি দাবি করে বিবৃতি প্রদান করেছেন ৯০-এর ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। সোমবার সংবাদপত্রে দেয়া বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী নেতৃবৃন্দ বলেছেন, পতিত স্বৈরাচার এবং তার সহযোগিদের ইতিহাসের আস্তাকুড়ে থাকার কথা ছিল। ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনীতির সুবিধাভোগী রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা এখন গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে যেমন অপমানিত করছে তেমনি সংগ্রামী চরিত্রগুলোকেও কলংকিত করতে উদ্যত। বিবৃতিতে এ ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য প্রত্যাহার ও ক্ষমা প্রার্থনার আহ্বান জানান হয়। বিবৃতিতে স্বৈরাচার ও তার সহযোগিদের রাজনৈতিকভাবে বয়কটেরও আহ্বান জানানো হয়। বিবৃতিতে স্বাক্ষরকারী নেতৃবৃন্দ হলেন-সাবেক ছাত্রনেতা ডা. মোশতাক হোসেন, আনোয়ারুল হক, নাজমুল হক প্রধান, শফি আহমেদ, মোশরেফা মিশু, রুহিন হোসেন প্রিন্স, বেলাল চৌধুরী, বজলুর রশীদ ফিরোজ, রাগীব আহসান মুন্না, রাজেকুজ্জামান রতন, আ. ক. ম. জরিহরুল ইসলাম, সাজ্জাদ জহির চন্দন, আসলাম খান প্রমুখ।