লজ্জায় মাথা নিচু করো, কলকাতা৷ তোমার এতদিনের সব দেওয়ালে দেওয়ালে পূর্ণেন্দু পত্রী, শানু লাহিড়ীর পাশাপাশি অসংখ্য নাম-না-জানা শিল্পীর ছবি, রেখা রঙ-এর বদলে, বহু যুদ্ধ, আগ্রাসন, অন্যায়ের বিরোধী উজ্জ্বল সব স্লোগানের বদলে লেখা হচ্ছে ‘আমরা সবাই হিন্দু’ আর তোমার সুশীল সুসভ্য ছেলেমেয়েরা তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে৷ পাশ কাটিয়ে যাচ্ছে৷ কেউ স্পষ্ট গলায় বলছে না যে ‘এই অসভ্য উগ্রতার লিখন এ শহরে লেখা যাবে না৷’ কেউ কেউ আড়ালে অসন্তোষ জানাচ্ছেন৷ কিন্তু ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’র এই শহর নিজের সম্মান কোনো স্পষ্ট স্বরে কোথাও প্রকাশ করছে না৷ হয়ত কিছুটা এই ভয়েও, যেকোনো আপত্তি, বিরোধিতা এখন সর্বদাই কোনো না কোনো রাজনৈতিক দলের ছাপে চিহ্নিত হয়ে যাবে৷ কিন্তু সেই অস্বস্তিকে অত্যন্ত বেশি গুরুত্ব দিলে যা হয়, এই শহরেরই কবির সতর্কবাণীতে ‘শত্রুপক্ষ আচমকা যদি ছোঁড়ে কামান’ তখন উদাসীনভাবে কোকিলের দিকে না হোক অন্য পাঁচটা ধুলোখেলার দিকে চোখ দিয়ে রাখার ফল ইদানীং রাস্তাঘাটে টের পাওয়া যাচ্ছে৷ বেশি বেশি সংখ্যক লোক গেরুয়া ঝান্ডা লাগানো বাস বোঝাই করে কোনো রাজনৈতিক পার্টির সভা ভর্তি করতে যাচ্ছেন৷ ফুটপাথের ছোট ছোট দোকানে দিয়ে যাওয়া গেরুয়া কাপড়ের টুকরো একজন দোকানমালিক পাশে মাটিতে পুঁতে রাখলে একজন ক্ষমতাশালী চেহারার স্হানীয় লোক এসে নানারকম আস্ফালনবাক্য বলতে বলতে সেটা তার দোকানের মাথায় গুঁজে দিয়ে গেল, ঠিক যেমনভাবে ২০০৭-৮ সালে নিজেদের পার্টির কুপন ধরিয়ে ছোট ছোট দোকানদারদের থেকে তোলা তুলত অন্য পার্টির ক্যাডাররা৷ এই আস্ফালন ক্রমশ এই শহরে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যাচ্ছে৷
বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলেই সেই পার্টির এমনকি নিতান্ত নিচুতলার কর্মীরাও ক্ষমতার স্বাদ পাচ্ছে এবং কুৎসিতভাবে সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করছে, এই ছবি এ রাজ্যে গত দুই দশক ধরে প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠেছে৷ কত গভীরে পৌঁছেছিল সে ‘পাপের দুর্দহন’, তার স্মৃতি হয়ত গ্রাম বা মফস্সলে থাকা মানুষরা এখনও পুরোটা ভুলে যাননি৷ সেই গভীর সামাজিক অন্যায়, মূল্যবোধের সেই ভয়ঙ্কর পতনের পেছনে আমাদেরও ভূমিকা ছিল৷ নিশ্চয়ই ছিল৷ আমাদেরই ঘরের ছেলেমেয়েরা যখন বিপথে যেতে শুরু করল, ভয়ে কিংবা লোভে, আমরা তাদের বাধা দিইনি৷ হয়ত ভেবেছিলাম এভাবেই হবে৷ সাফল্যের শর্টকাট পেলেই আর কোনো সমস্যা থাকবে না৷ এখনও মনে আছে মেদিনীপুরে আদিবাসী সমাজ বিপুল বিক্ষোভ জানিয়েছিল কে কোন পার্টি করে সেই নিয়ম অনুযায়ী আদিবাসীরা ছেলেমেয়ের বিয়ে ঠিক করে না বলে৷ আমরা মনোযোগ দিইনি৷ পাড়ায় বাড়ি ভাড়া দিতে বা নিতে হলে স্হানীয় একদল ছেলেকে তোলা দিতে হত৷ ২৪ পরগনায় মেয়ের বিয়ের দিন বাবার বয়সী গৃহকর্তার কাছ থেকে মদ খাওয়ার টাকা চেয়ে পাঠানো হয়৷ বলা হয়েছিল ‘না হলে জামাই ঢুকতে পারবে না৷’ এরকম অসংখ্য ঘটনায় পাড়া চুপ করে থাকত, যে কোনো কারণেই হোক৷ সেই নীরবতার ফল আজ দেখা দিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্কীর্ণ স্বার্থপরতা, অসামাজিক কাজের সঙ্গে প্রকাশ্যে জড়িয়ে থাকা, সমস্তরকম অপরাধ করেও রাজনীতির নামে আশ্রয় পাওয়া– এই অবস্হাটার মধ্যে৷ বিলাপ দীর্ঘায়িত করে লাভ নেই৷ আজকে সামনের সমস্যা যে আমরা এই অ-প্রতিবাদে কতদূর পর্যন্ত যাব? এ রাজ্যের নাগরিকদের অধিকাংশই গত ৩ বছর ধরে বিপুল স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় ভুগছেন৷ তাদের আশা ছিল বিগত সরকারের আমলে যে নানা সমস্যায় তারা জেরবার হচ্ছিলেন, সরকার পাল্টানোর পর সেগুলি অর্থাৎ শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনশৃঙ্খলার অব্যবস্হা, সরকারি দুর্নীতি ইত্যাদি থেকে তারা পরিত্রাণ পাবেন৷ বাস্তবে তা ঘটল না৷ বরং যত দিন যাচ্ছে, সঙ্কট আরও বাড়তেই দেখা যাচ্ছে৷
গত দশকে সামাজিক, রাজনৈতিক অবস্হা যতই দমচাপা হয়ে উঠুক, আমাদের মতো মানুষরা অন্যায়ের কোনো প্রতিবাদ করার কথা ভাবিনি৷ অন্য কেউ কখনও প্রতিবাদ করে লাঞ্ছিত হলে প্রকাশ্যে তার পাশে গিয়ে দাঁড়াইনি৷ বরং নিজের নিজের ‘নিরাপত্তা’ রক্ষা করার চেষ্টায় দূরে সরে থেকেছি৷ ‘চোখ বুজে কোনো কোকিলের দিকে’ কান ফিরিয়ে রেখেছি৷ এমনকি ৩০ বছর পর যখন সিঙ্গুর প্রথম প্রতিবাদের স্বর তুলল তখনও, কিছু মানুষকে বাদ দিলে, অধিকাংশ জন যতটা আবেগ নিয়ে সেই প্রতিবাদে গলা মিলিয়েছিলাম, ততখানি সচেতন ভাবনা হয়ত করিনি৷ আবেগ অবশ্যই মানুষের স্বাভাবিক বেঁচে থাকার জন্য একেবারে প্রাথমিক প্রয়োজন কিন্তু তার সঙ্গে যদি সচেতন কোনো চিম্তা যুক্ত না থাকে তবে সেই আবেগ আমাদের বেশিদূর নিয়ে যেতে পারে না৷ সচেতন চিম্তা ছাড়া আবেগেরও দৃঢ়তা থাকে না৷ অন্যায়ের প্রতিবাদ করার সময়েও অন্যায়ের মূল কারণটি বোঝার চেষ্টার বদলে, অন্যায়ের কাঠামোটিকে চিহ্নিত করবার বদলে আমরা কেবল ভেবেছিলাম পরিচালনমণ্ডলীকে পাল্টে দিলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে৷ কার্যত তা হল না৷ হওয়ার কথাও নয়৷
গত প্রায় ৪০ বছর ধরে উন্নতি ও সাফল্যের যে সমাজ-বিচ্ছিন্ন ধারণা আমাদের সংস্কৃতিতে শেকড় গেড়েছে, তার বিপরীত চিম্তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি৷ ফলে আমরা অনেকেই ভেবেছিলাম এই সমাজ, দেশ, বিশ্বের কোনো কিছু নিয়ে মাথা না ঘামিয়েও কোনোরকমে নিজেদের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করে ফেলা যাবে৷ বাস্তবে দেখা গেল এই ভাবনার যা ফল হওয়ার ঠিক তাই হয়েছে৷ উত্তরপ্রজন্মও নিজের নিজের সাফল্যকে দেখেছে ঠিক যেভাবে দেখা স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ অনেক সুযোগসুবিধে পেয়ে, উজ্জ্বল সফল কিছু ছেলেমেয়ে বাড়ি থেকে বহুদূরে বসে প্রচুর অর্থ উপার্জন করছে৷ তারা ধীরে ধীরে এ দেশের এই সমাজেরই মধ্যে হয়ে গেছে এক ভিন্ন পৃথিবীর বাসিন্দা৷ একটি বড় অংশ নানান রাজনৈতিক দলে কর্মী হিসেবে চাকরি করে৷ সে সব দলের আদর্শ বিষয়ে তারা কিছু জানে না, জানানোর কোনো চেষ্টাও হয় না৷ তারা কেবল নিজের নিজের দলের ক্ষমতা বজায় রাখা এবং ভোটের আগে-পরে এলাকা দখলের কাজে ব্যবহূত হবে৷ বদলে কিছু অর্থ ক্ষমতাশালী লোকেরা তাদের দেবেন, বাকি তাদের আদায় করে নেওয়ায় কেউ বাধা দেবে না৷ কারও মনে হতে পারে অবস্হাটা যেন ‘মধ্যযুগের’ মতো যখন রাজা-জমিদাররা সিপাইদের নিজেদের যুদ্ধবিগ্রহের কাজে লাগাতেন, বাকি সময় তাদের ‘চরে খাওয়ার’ অধিকার থাকত৷ তাতে তারা প্রজার ঘরে আগুন লাগাক কি তার গোয়ালের গরুবাছুর খুলে আনুক! তার বাইরে যে ‘উত্তরপ্রজন্ম’ তারা এই দুই ধাপের মাঝখানে হতাশা ও আত্মোন্নতির চেষ্টার দোলাচলে থেকেছে৷ তার ফলে রাজ্যে যখন বিপুল জনমতের জোরে ক্ষমতা হস্তান্তরিত হল, আমরা অধিকাংশ জন ভাবলাম অবস্হা আমূল পাল্টে যাবে৷ যদিও এই ভাবনার বাস্তব কারণ তেমন কিছু ছিল না৷ কেবল ভোটবাক্সের কাগজে একটা ছাপ দিলেই যদি সত্যিকারের কোনো পরিবর্তন হত, তাহলে তো দেশের যে সব জায়গায় শাসক দলের পরিবর্তন হয়েছে তাদের আর কোনো সমস্যা থাকার কথা ছিল না৷
রাজ্যের বা ভারতের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে বেকারি, কর্মহীনতা৷ যে কোনো দেশের জনগোষ্ঠীর জীবিকা ও উপার্জন প্রধানত নির্ভর করে তার প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর৷ ভুললে চলবে না যে জমির অনুপাতে বসবাসকারীর সংখ্যা পৃথিবীতে প্রতি বর্গ কিমিতে ৪৬ হলেও ভারতে তা ৩৮৪ এবং এ রাজ্যের ক্ষেত্রে ১০২৮৷ কোনো দানখয়রাতি, দারিদ্ররেখা কিছু দিয়েই এই জনসংখ্যার মর্যাদাপূর্ণ জীবিকার ব্যবস্হা করা কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়৷ অথচ, ১৯৯১ সালের পর থেকে বিশ্বায়নের নামে এ দেশের প্রাকৃতিক সম্পদগুলিকে বহুজাতিকদের স্বার্থে যথেচ্ছ অপচয় করা হচ্ছে৷ দেশের সর্বোচ্চ দায়িত্বে থাকা সরকার এক্ষেত্রে স্বদেশের স্বার্থ না দেখে মুষ্টিমেয়র আর্থিক স্বার্থ দেখতে চুক্তিবদ্ধ৷ কেন্দ্রের নতুন সরকার এক্ষেত্রে অনেক বেশি কুশলী ও দৃঢ়প্রতিজ্ঞ৷ ধর্মভিত্তিক আতঙ্কবাদ প্রচারকে বিপদের প্রধান মুখ বলে যাঁরা মনে করছেন, তারা আরেকটু গভীরে নজর করলে হয়ত দেখবেন, ওই মৌলবাদও আসল বিপদ নয়, প্রকৃত সঙ্কট আরও অনেক বড় ও গভীর৷ একবার ইতিমধ্যেই আমরা শুনেছি ‘যারা উন্নয়নের বিরোধী তারা দেশদ্রোহী’৷ এবং ‘উন্নয়ন’ তাকেই বলা হচ্ছে যাকে উন্নয়নের এজেন্টরা ঠিক বলবেন৷ সংসদে বিমাবিল পাস হওয়ার ব্যাপারে এমনও শোনা গেল যে বিরোধীরা ভালোয়-ভালোয় সরকারি নীতিতে সহমত না হলে সরকার অর্ডিনান্সের মাধ্যমে পাস করিয়ে নেবে৷ গণতন্ত্রের মহিমা একধাক্কায় পরিষ্কার৷ যে দেশের প্রধান সম্পদ এখনও মাটি জল জৈববৈচিত্র্য, সেখানে ‘নতুন কারখানা হলেই সব সমস্যার সমাধান’– এই অলীক আশ্বাসের বিষয়ে সাধু সাবধান৷ এখনও আমাদের রাজ্যে সে সব হয়নি, এখনও আমরা পরমাণু শক্তিকেন্দ্রের মরণঘেরের বাইরে আছি৷ যারা হাসিঠাট্টা করেন, ফেসবুক-টুইটারে স্মার্টনেসের প্রমাণ রাখছেন, যারা সঙ্কটের সহজ সমাধানের উপায় হিসাব কষছেন, তারা একটু ভেবে দেখবেন৷ রামরাজ্য কেবল রামের জন্যই ভালো ছিল, তার ছেলেপুলে অবধিও টেকেনি কিন্তু