ঢাকা: দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দুর্নীতি, অনিয়ম, অনুসন্ধান-তদন্তের নামে জনহয়রানি এবং স্বেচ্ছাচারিতার বিষয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ করছিলো দৈনিক ইনকিলাব। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে প্রত্রিকাটির সম্পাদক জনাব এ এম এম বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধেই মামলা ঠুকে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। গতকাল সোমবার দুদকের সহকারি পরিচালক মুহাম্মদ জয়নাল আবেদীন বাদী হয়ে সমন্বিত জেলা কার্যালয়, ঢাকা-১ এ মামলা করেন। এজাহার করা হয় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪ এর ২৬(২) এবং ২৭(১) ধারায় । অভিযোগ আনা হয় জনাব এএমএম বাহাউদ্দীনের বিরুদ্ধে অবৈধ সম্পদ অর্জনের। এর মধ্যে ৮১ লাখ ১০ হাজার ৪৩৩ টাকার সম্পত্তিকে আখ্যা দেয়া হয়েছে ‘জ্ঞাত আয়ের সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ’ বলে। প্রায় একই পরিমাণ সম্পদকে (৮৯ লাখ ১৯ হাজার টাকা) ‘গোপন করা হয়েছে’ মর্মে উল্লেখ করা হয়। একই টাকাকে দুটি ভাগ করা হয়। দুটিকে আবার নিজেদের মতো যোগ-বিয়োগ করে মোট সম্পত্তি দেখানো হয় ১ কোটি ৭০ লাখ টাকার।
দুদকের চোখে যা ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ বলে গণ্য। মামলায় যে অভিযোগই আনা হোক, মূল কারণ দুদকের বিষয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন। দৈনিক ইনকিলাবে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের জের ধরেই তড়িঘড়ি করে মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে জানিয়েছে দুদকের একটি নির্ভরযোগ্য সূত্র। মামলা করার মতো প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার হাতে ছিলো না। গত এক সপ্তায় দুদক নিয়ে কয়েকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এসব প্রতিবেদন পাঠ করে দুদক চেয়ারম্যান ইনকিলাবের ওপর যারপর নাই ক্ষিপ্ত হোন । সঙ্গে সঙ্গে অধীনস্থ কর্মকর্তার ওপর চাপ সৃষ্টি করে এ মামলা দায়েরে বাধ্য করেন। অভিযোগ আদালতে প্রমাণ করা যাবে কি না সেটি কোনো বিবেচনায় আনেননি। কারণ যে সম্পত্তিটি জনাব এএমএম বাহাউদ্দীনের বলে উল্লেখ করা হয়েছে তিনি আদৌ সেটির মালিক কি না-সেই তথ্যটি চেপে যাওয়া হয় এজাহারে। মামলা দায়েরের কোনো উপকরণ না পেয়ে মোটা দাগের দুটি ধারা প্রয়োগ করা হয় মামলাটিতে।
সূত্রমতে, সাবেক আমলা দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের প্রতিশোধপরায়ণতার বহু নজির দুদকেই রয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায়ই তিনি প্রতিশোধ স্পৃহা চরিতার্থ করতে বেছে নিয়েছেন দুদকের মতো রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে। এ কারণে তিনি ইনকিলাবে প্রকাশিত প্রতিবেদনের প্রতিবাদ করার মতো প্রচলিত কোনো পন্থা অবলম্বন করেননি। অবলম্বন করেছেন হাতের মুঠোয় থাকা সর্বজনবিদিত দুটি ধারা। যা ইতিমধ্যেই ‘দুদকের ৫৪ ধারা’ হিসেবে বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। আর এ দুটি ধারা ব্যবহার করেই তিনি ব্যক্তিগত বিদ্বেষের পুরোটা ঢেলে দেন ইনকিলাব সম্পাদকের বিরুদ্ধে। দ্রুততার সঙ্গে মামলা দায়ের করাই তার বিদ্বেষ এবং আক্রোশের বিষয়টি প্রমাণিত। দুদকের শীর্ষ আসনে বসে গত সাড়ে ৩ বছরে বহু বিতর্কের জন্ম দেন সাবেক এই সাবেক আমলা। শেখ আবদুল হাই বাচ্চু দ্বারা ব্যাংক লুন্ঠনের ঘটনায় ৫৬টি মামলা থাকলেও বাচ্চুর টিকিটিও স্পর্শ করতে পারেননি ইকবাল মাহমুদ। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের গবেষণা মতে, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ৫০ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যায়। অর্থ পাচার রোধে ইকবাল মাহমুদ ছিলেন নির্বিকার। কোনো দুর্নীতি না করলেও ৩৩টি মামলায় চার্জশিট দিয়ে নিরীহ পাটকল শ্রমিক জাহালামকে ৩ বছর কারাভোগ করান। দুর্নীতি দমনের এক নম্বর এজেন্ডা বাদ দিয়ে তিনি অপেক্ষাকৃত ঝুঁকিমুক্ত দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমের ৬ নম্বর এজেন্ডা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তরুণ ও দক্ষ কর্মকর্তাদের তিনি বসিয়ে দেন স্বীয় আবিষ্কৃত ‘১০৬’ এর ‘হটলাইন’ টেলিফোন রিসিপশনের কাজে। সভা-সমাবেশ, বক্তৃতা আর বিদেশ সফরে তিনি থাকেন মত্ত। অন্যদিকে দুর্নীতি বিরোধী একমাত্র রাষ্ট্রীয় সংস্থাটির গ্রহণযোগ্যতা তলানিতে নিয়ে যান। টাস্কফোর্স, ফাঁদ মামলা, দুর্নীতির উৎস অনুসন্ধান, দুর্নীতি দমনের পরিবর্তে প্রণয়ন করতে থাকেন সুপারিশ। দুদক আইনের ২৬(২), ২৭(১) ধারাকে হাতিয়ার বানিয়ে দায়ের করতে থাকেন খুচরা মামলা। প্রকল্পের নামে শত শত কোটি টাকা লোপাট হলেও দুদক তা না দেখার ভান করে। সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ থাকলেও সেসবের বিরুদ্ধে মামলা করেন না। চুনোপুটিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন আত্মপ্রচারণার লক্ষ্যে। কমিশনের অর্থে ঘন ঘন বিদেশ সফর করেন চেয়ারম্যান। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি আমন্ত্রণ টেনে আনেন। অথচ এসব সেমিনারে দুদকের কোনো পরিচালক অংশ নিলেই যথেষ্ট। তাদের না পাঠিয়ে চেয়ারম্যান নিজেই যোগ দেন প্রবল আগ্রহ নিয়ে। কর্মকর্তাদের আজ্ঞাবহ করে রাখতে তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তটস্থ করে রাখেন কর্মকর্তা-কর্মচারিদের। তাদের প্রেষণে অন্যত্র পাঠিয়ে দেন। শাস্তিমূলক বদলি করেন। আটকে রাখেন পদোন্নতি। কমিশনের অন্য সদস্যদের নানাভাবে কোণঠাঁসা করে রাখেন। একই সঙ্গে দুর্নীতিগ্রস্ত ও খয়ের খা কর্মকর্তাদের তিনি সুবিধাজনক চেয়ারে বসিয়ে রাখেন। তাদের দিয়ে পছন্দসই কাজ-কর্ম সম্পাদন করান। কমিশনের সদস্যগণ সমান দায়িত্ব এবং মর্যাদা সম্পন্ন । যার যার পদে তিনি স্বাধীন। আইনে এমনটি থাকলেও দুদককে তিনি পরিণত করেছেন ‘ওয়ান-ম্যান শো’ প্রতিষ্ঠানে। কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিজ প্রতিষ্ঠানকে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন না। কিন্তু ইকবাল মাহমুদ স্বয়ং একাধিকবার স্বীকার করেন যে দুদকেও দুর্নীতি রয়েছে। কর্মকর্তারা দুর্নীতিবাজ।
যা দেশে নজিরবিহীন। আইনজ্ঞদের মতে তার বক্তব্য ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও বটে। এটিকে ভিত্তি ধরে তার বিরুদ্ধেও আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে যাওয়া যেতে পারে। ইকবাল মাহমুদের ক্রমাগত স্বেচ্ছাচারিতায় দুদকের ওপর আস্থা হারায় সরকারও। দুদক আইনে অনেক ক্ষমতা দেয়া হলেও এ ক্ষমতা তিনি প্রয়োগ করেননি। প্রকৃত দুর্নীতিবাজদের তিনি স্পর্শ করতে পারেন না। প্রয়োগ করেন দুর্বল, নিরীহ এবং সুবিধাজনক ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। এ কারণে সরকার এবং সাধারণ মানুষের আস্থা কমতে থাকে দুদকের প্রতি। এই আস্থাহীনতার বড় প্রমাণ সাম্প্রতিক দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। দুদককে বাদ দিয়ে এবং এর চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদকে অন্ধকারে রেখে শুরু হয় দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। দেশজুড়ে এ নিয়ে তুমুল বিতর্ক শুরু হলে মুখরক্ষায় তিনিও শুরু করেন দুর্নীতি বিরোধী অভিযান। বিভিন্ন সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদন এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য ধরে তিনি মামলা দায়ের করতে থাকেন। তার এহেন কর্মকান্ড মানুষের কাছে হাস্যকর মনে হতে থাকে। আইনমন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এমপি, দেশের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলমতো বলেই বসেন, দুদক চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের এই পদ ছেড়ে দেয়া উচিত। এ মন্তব্যের পরও তিনি দুদক চেয়ারম্যানের পদটি আগলে রাখেন। পরে আইন মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটি তাকে তলব করে। দুর্নীতি দমনে ব্যর্থতা, অনিয়ম, স্বেচ্ছাচারিতা এবং ভুল সিদ্ধান্তের বিষয়গুলো তুলে ধরেই সম্প্রতি প্রতিবেদন প্রকাশ করে দৈনিক ইনকিলাব। আর এতেই ক্ষিপ্ত হয়ে সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করেন সাবেক এ আমলা। ইতিপূর্বেও দুদকের বিষয়ে সমালোচনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করায় সমকাল প্রকাশক, দৈনিক প্রথম আলো’র পরিচালক, প্রকাশক এবং একটি প্রভাবশালী অনলাইন পোর্টালের সম্পাদকের বিরুদ্ধে মামলা করেন। দুর্নীতির ফাইল তৈরি এবং সেটি দিয়ে মামলা রুজুর ভয় দেখিয়ে কয়েকটি শীর্ষস্থানীয় দৈনিককে বশীভূত রাখেন। গণমাধ্যমকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে অনুসন্ধান শুরু, নোটিস, তলব, মামলা রুজু, চার্জশিট দাখিলের মতো হাতিয়ারগুলো ব্যবহার করেন তিনি।
দুদকের দায়িত্বহীন নেতৃত্বই কি তাদের মৃত্যুর কারণ ?
তবে দুদকের দায়িত্বহীন নেতৃত্ব মানুষের ব্যক্তি জীবনে কতটা ভয়ংকর পরিণতি ডেকে আনতে পারে দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারির সাম্প্রতিক মৃত্যুই এর প্রমাণ। গত তিন মাসে দুদকের ৪ কর্মকর্তা-কর্মচারির মৃত্যু হয়। তারা হলেন, পরিচালক মো. আবু সাঈদ, সহকারী পরিচালক সরদার মঞ্জুর আহম্মেদ, কনস্টেবল মো. আবদুল জলিল মন্ডল এবং কনস্টেবল মো. মজিবুর রহমান। তাদের মধ্যে পরিচালক আবু সাঈদের মৃত্যু হয় আকস্মিক। কর্ম ব্যস্ততার কারণে অতিরিক্ত মানসিক চাপেই তার মৃত্যু হয় বলে জানা গেছে। সহকারি পরিচালক মঞ্জুর আহম্মেদ ক্যান্সারে আক্রান্ত হলেও তার সুচিকিৎসার কোনো উদ্যোগ নেননি ইকবাল মাহমুদ। তাকে একবারের জন্য দেখতে হাসপাতালেও যাননি তিনি। কর্মকর্তা-কর্মচারিরা নিজেরা চাঁদা তুলে মঞ্জুর আহম্মদের চিকিৎসার খরচ যোগাতে দেখা গেছে। কনস্টেবল মো. আবদুল জলিল মন্ডল এবং মো. মজিবুর রহমানও অতিরিক্ত কাজ এবং অব্যাহত মানসিক চাপে ব্রেন স্ট্রোক করেন। দুদক কর্মকর্তা-কর্মচারিদের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানা গেছে, মূল কাজ বাদ দিয়ে ইকবাল মাহমুদ কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ব্যস্ত রাখেন গৌণ কাজে। গণশুনানি, মানববন্ধন, সেমিনার ইত্যাদি কাজ দিয়ে তাদের নাস্তানাবুদ রাখেন। এ কারণেই তারা সারাবছর প্রচন্ড মানসিক চাপে থাকেন। অথচ কাজের কাজ কিছুই নেই। আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, আল্লাহ না করুক আগামি দু’চার বছরের মধ্যে দেখবেন দুদকের অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারিই অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এতটা মানসিক চাপের ভেতর কাজ করা সম্ভব নয়। বর্তমান দুদক ¯্রফে ফাপড়ের ওপর চলছে বলেও মন্তব্য করেন ওই কর্মকর্তা। কাজের কাজ নয়-কর্মকর্তা-কর্মচারিদের ভয়-ভীতি দেখিয়েই তিনি দুদককে ‘সক্রিয়’ দেখানোর চেষ্টা করছেন।
শুধু নিজস্ব কর্মকর্তাই নন-সরকারের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমনেও তিনি এগিয়ে। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও সাবেক মন্ত্রী বীর মুক্তিযোদ্ধা সাদেক হোসেন খোকা মৃত্যুবরণ করেন দুদক মামলার আসামি হিসেবে । ২০০৭ সালে করা পুরনো মামলায় বর্তমান কমিশন তার ১০ কোটি ৫ লাখ ২১ হাজার টাকার সম্পত্তি জব্দের আবেদন জানায় আদালতে। আদালতের নির্দেশ নিয়ে জব্দ করা হয় খোকার নিজ বাড়ি, গাজিপুর ও নারায়ণগঞ্জের সম্পত্তি। দুদকের মামলায় হাজিরা দিতে দিতে মারা যান সাবেক মন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব এম.কে.আনোয়ার। এর আগে দায়িত্বহীন নেতৃত্বের কবলে পড়ে দুদকের মামলার আসামি হিসেবে ইন্তেকাল করেন ড্যাব নেতা এম.এ. হাদী,সোনালি ব্যাংক এমপ্লয়ীজ এসোসিয়েশনের সভাপতি বিএম বাকির হোসেনসহ বেশ কয়েকজন।