ডেস্ক | মাদকবিরোধী অভিযানের নামে বাংলাদেশে বিগত ১৮ মাসে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে গড়ে প্রতিদিন খুন হয়েছেন একজন। বিচারবহির্ভূতভাবে হত্যা করা হয়েছে কয়েকশ’ মানুষকে। সোমবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এমনটা বলেছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল। “কিল্ড ইন ‘ক্রসফায়ার’: এলেগেশন্স অব এক্সট্রাজুডিশিয়াল ইক্সিকিউশন্স ইন বাংলাদেশে ইন দ্য গুইজ অব এ ওয়ার অন ড্রাগস” শীর্ষক ২৫ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে নিরাপত্তা বাহিনীর বিরুদ্ধে জোরপূর্বক গুম করা, ভুয়া প্রমাণ তৈরির অভিযোগ আনা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৮ সালের ৩রা মে মাদক-বিরোধী অভিযান শুরুর ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর থেকে দেশে বিচারবহির্ভূত হত্যার সংখ্যা কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। ঘোষণার প্রথম ১০ দিনের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে খুন হন অন্তত ৫২ জন। সব মিলিয়ে ২০১৮ সালে দেশজুড়ে সন্দেহভাজন বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন অন্তত ৪৬৬ জন। ২০১৭ সালের তুলনায় এ সংখ্যা তিনগুণেরও বেশি।
অ্যামনেস্টি জানায়, সন্দেহভাজন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড গুলো খতিয়ে দেখতে যথাযথ তদন্ত চালুর বদলে নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ সেগুলোকে সত্য প্রমাণের জন্য ভুয়া প্রমাণ তৈরি করেছে। সাধারণত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’ এর নামে এধরনের হত্যাকাণ্ড করা হয়ে থাকে।
অ্যামনেস্টির সঙ্গে সাক্ষাৎকারে এসব হত্যাকাণ্ডের কথিত প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, তারা নিজ চোখে কোনো হত্যাকাণ্ড দেখেননি।
তবে তাদেরকে পুলিশের দাবির পক্ষে প্রমাণ তৈরি করতে বলা হয়েছে। কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সকল ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কারের কয়েকদিন আগে তাদের জোরপূর্বকভাবে গুম করতো পুলিশ বা র্যাব। কারো কারো ক্ষেত্রে হত্যার ছয় সপ্তাহ আগেও গুম হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। গুম হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনরা তাদের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে কর্তৃপক্ষ না জানার দাবি করতো বা প্রকাশ করতে অস্বিকৃতি জানাতো।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের উপ-পরিচালক দিনুশিকা দিসানায়াকে বলেন, মাদক বিরোধী যুদ্ধে গড়ে প্রতিদিন অন্তত একজন ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে। র্যাব সংশ্লিষ্ট ঘটনাগুলোয় আইন মানা হয়নি, সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করা হয়নি, বিচারকার্যের সম্মুখীনও করা হয়নি।
দেশের দরিদ্র শহরতলীগুলোয় এই অভিযান আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। ওই অঞ্চলগুলোর বাসিন্দারা ভয়ে থাকেন যে, মাদকের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগসাজশ মিললেই তাদের প্রিয়জনদের বিচারবহির্ভূতভাবে মেরে ফেলা হবে।
দিসানায়াকা বলেন, এই হত্যাকাণ্ড গুলো মাদক নিষিদ্ধের নামে করা হয়েছে। এর মাধ্যমে সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে প্রত্যন্ত অঞ্চলে বাস করা মানুষদের শাস্তি দিয়েছেন ও তাদের ওপর সহিংস হামলা চালিয়েছেন। বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে অবশ্যই এসব হত্যাকাণ্ড বন্ধ করতে হবে।
‘গুলি বিনিময়’ ও ভুয়া প্রমাণ
বাংলাদেশি কর্মকর্তারা নিয়মিতভাবে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকারদের দুই পক্ষের গুলি বিনিময়ে মারা যাওয়ার দাবি করে আসছে। তাদের দাবি অনুসারে, সন্দেহভাজন অপরাধী প্রথমে তাদের দিকে গুলি ছুড়ে। পাল্টা জবাবে তারা গুলি ছুড়লে ওই ব্যক্তির মৃত্যু হয়। এসব ঘটনার কথিত প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলেছে অ্যামনেস্টি। এমন এক প্রত্যক্ষদর্শী জানান, আমরা কিছুই দেখিনি। পুলিশ আমায় ভোর ৫:৩০ এর দিকে ঘটনাস্থলে নিয়ে যায়। তারা সেখান থেকে কী নিচ্ছে তা দেখতে বলে। আমি কেবল একটি মোটরসাইকেল দেখেছিলাম।
অ্যামনেস্টিকে সাক্ষাৎকার দেয়া এমন অন্তত পাঁচজন প্রত্যক্ষদর্শী বলেছে, তাদেরকে জোর করে ঘটনাস্থলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারা জানায়, প্রত্যক্ষদর্শী হতে পুলিশের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করতে ভীত ছিলেন তারা। প্রত্যাখ্যানের পরিণতি ভয়াবহ হওয়ার আশঙ্কা ছিল তাদের। নিরাপত্তা বাহিনীরা এমন প্রত্যক্ষদর্শীদের নাম, স্বাক্ষর, ফোন নাম্বার ও ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে রাখতো।
চাঁদাবাজি ও ‘বন্দুকযুদ্ধ’
মাদক বিরোধী অভিযানে নিহতদের পরিবার-পরিজনরা বহুবার অ্যামনেস্টিকে বলেছে যে, তারা র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছে। এমন একজন হচ্ছেন রহিম (নকল নাম)। তাকে তার শ্বশুরবাড়ি থেকে জোরপূর্বকভাবে তুলে নেয়া হয়। আটদিন পর তার লাশ পাওয়া যায়। র্যাব দাবি করে, এক বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন রহিম।
অপর এক বন্দুকযুদ্ধের শিকার হয়েছেন বাবলু মিয়া (নকল নাম)। বাবলুর ভাই জানান, তাকে রাস্তা থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকে থাকা র্যাবের দুই সদস্য। এ ঘটনায় বাবলুকেকে নিখোঁজ উল্লেখ করে থানায় মামলা করেছিলেন তার ভাই। প্রায় দেড় মাস পরে র্যাব জানায়, বাবলু মিয়া এক ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেছেন।
কথিত বন্দুকযুদ্ধের আরো এক শিকার ৩৫ বছর বয়সী সুলেমান (নকল নাম)। তিনি তার মেয়ের সঙ্গে তালপাতার কুঁড়েঘরে থাকতেন। পুলিশ জানায়, তিনি এক বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন। কিন্তু তার আত্মীয়-স্বজনদের দাবি পুলিশ তাদের কাছে সুলেমানকে মুক্ত করে দিতে টাকা চেয়েছিল। মৃত্যুর আগ দিয়ে সুলেমান তার এক আত্মীয়কে ফোন করে জানান যে, পুলিশ তার মুক্তির জন্য ২০ হাজার টাকা দাবি করেছে। সুলেমানের পরিবারের এক সদস্য নিশ্চিত করেছেন, পুলিশকে ওই অর্থ পরিশোধ করা হয়েছিল। কিন্তু পুলিশ এরপর আরো ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। অন্যথায় তাকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়। সুলেমানকে খুঁজে বের করতে মরিয়া হয়ে নিকটবর্তী পুলিশ স্টেশনে যায় তার আত্মীয়-স্বজনরা। তখন তাদের বলা হয়, সুলেমানকে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তিন-চার দিন পর তাদের জানানো হয়, এক বন্দুকযুদ্ধে মারা গেছেন সুলেমান।
অ্যামনেস্টি তাদের প্রতিবেদনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি, মাদবকিরোধী অভিযানে পুলিশ ও র্যাবের বিরুদ্ধে ওঠা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগ নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে একটি নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও কার্যকরী তদন্ত চালুর আহ্বান জানিয়েছে। সংগঠনটি জানিয়েছে, সাক্ষাৎকার নিয়ে ও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে তারা বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাতটি ঘটনা নথিভুক্ত করেছে।