কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজশে ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানি

Slider জাতীয় সারাদেশ


ঢাকা: শুল্ক গোয়েন্দাদের সঙ্গে যোগসাজশ করেই ক্যাসিনো সামগ্রী আমদানি করা হতো। কমলাপুর আইসিডি ও পানগাঁও কাস্টমস কর্মকর্তাদের কেউ কেউ এর সঙ্গে জড়িত। ক্যাসিনোর জন্য আনা পণ্যের অন্তত সত্তর শতাংশই কমলাপুর আইসিডি ও বাকি ত্রিশ শতাংশ পানগাঁও থেকে খালাস করানো হতো। কোনো রকম পরীক্ষা নীরিক্ষা ছাড়াই মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে রাতারাতি এসব পণ্য ডেলিভারি দিতেন কাস্টমস কর্মকর্তারা। সম্প্রতি ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরুর পর থেকেই ক্যাসিনো সামগ্রী কিভাবে দেশে আসে এই প্রশ্ন সামনে আসে। এরপরই বিভিন্ন সংস্থার গোয়েন্দা কর্মকর্তারা অনুসন্ধানে নামেন। অনুসন্ধানে দেখা যায়, চীন, জাপান ও হংকং থেকে এসব পণ্য অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আনা হয়েছে।

এরমধ্যে অন্তত চারটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ক্যাসিনো সামগ্রী আনতেন যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়া।
একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদ শীর্ষ কাস্টমস কর্মকর্তাদের অর্থের বিনিময়ে ম্যানেজ করে সিএন্ডএফ এজেন্টের সহযোগিতায় ক্যাসিনো সামগ্রী আনতেন। কমলাপুর আইসিডির বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা খালেদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। খালেদ নিয়মিত তাদের অফিসে যাতায়াত করতেন। বৈঠক করতেন।

এ সংক্রান্ত ভিডিও ফুটেজও সংগ্রহ করেছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তারা। গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াকে ক্যাসিনো সরঞ্জামাদি আনা ও খালাসের ক্ষেত্রে তিনজন সিএন্ডএফ কাজ করতেন। তার মধ্যে লাভলু তার ভাইয়ের এস.টি বাংলাদেশ লি. ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে, সিএন্ডএফ ফরহাদ তার মালিকের সুগন্ধা ইন্টারন্যাশনাল ও এম এম ইন্টারন্যাশনাল এবং সিএন্ডএফ আশরাফ বেত্রাবতী ট্রেড সিন্ডিকেটের মাধ্যমে পণ্য খালাস করতেন। লাভলু, ফরহাদ ও আশরাফ তিনজনই খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়ার ঘনিষ্ট। আর তাদেরকে পণ্য খালাসে সহযোগিতা করতেন কমলাপুর আইসিডি কাস্টমস কমিশনার মো. আনোয়ার হোসাইন, অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান, প্রিভেন্টিভ টিমের সহকারী কমিশনার (এসি) কানিজ ফারহানা শিমু ও সহকারী রাজস্ব কর্মকর্তা তুহিনুল হক।

কমলাপুর আইসিডিতে পণ্য খালাসের জন্য খালেদ নিজেই এই কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। দীর্ঘদিন ধরে পণ্য আমদানি করায় তাদের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্টও ছিলেন। তাদের অফিসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটিয়েছেন খালেদ। ঘনিষ্ট হওয়াতে কোনো রকম যাচাই-বাচাই ছাড়াই পণ্য খালাস হয়ে যেত। বিনিময়ে খালেদ এই কর্মকর্তাদের দিয়েছেন আর্থিক সুবিধা। গত কয়েক বছরে ক্যাসিনো সরঞ্জাম ছাড়াও মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আনা অনেক পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে তারা কোটি কোটি টাকা ঘুষ নিয়েছেন। সরকারের রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে পণ্য খালাস করে তারা অবৈধভাবে একেকজন শ শ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এই চার কর্মকর্তা ছাড়াও কাস্টমসের শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন কর্মকর্তা শুধুমাত্র ক্যাসিনো সরঞ্জাম খালাস করে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন। একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রিভেন্টিভ ইন্সপেক্টর তুহিনুল হক অবৈধভাবে আয় করে নামে-বেনামে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। এছাড়া সহকারী পরিচালক মাহমুদুল হাসানও অন্তত হাজার কোটি টাকার মালিক। বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে তাকে কয়েকমাস আগে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিলো। কোটি টাকা খরচ করে বদলি স্থগিত করেন।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, খালেদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়ে সিএন্ডএফ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা পাহাড় সমান অনিয়ম করেছেন। গত দেড় বছর ধরে সিএন্ডএফ এক দিনেই এন্ট্রি করে রাতারাতি পণ্য খালাস করেছেন। যে পণ্যগুলো খালাস করা হয়েছে এগুলো কখনই যাচাই করা হয়নি। কখনও কখনও কন্টেইনারের সিল ভেঙ্গে পণ্য বের করে অন্যত্র তালাবদ্ধ করে রাখা হত এবং গভীর রাতে পণ্য ডেলিভারি দেয়া হত।

শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর সূত্রে জানাগেছে, বিভিন্ন সময় ক্যাসিনো পণ্য আমদানি করেছে এমন অন্তত ২০টি প্রতিষ্ঠানের খোঁজ মিলেছে। এর মধ্যে অন্যতম হল সিক্স সি করপোরেশন, নিনাদ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, বেষ্ট টাইকুন এন্টারপ্রাইজ, নিউ হোপ অ্যাগ্রোটেক লিমিটেড, পুষ্পিতা এন্টারপ্রাইজ ও এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, চায়না কমিউনিকেশন, ডংজিং লংজারভিটি ইন্ডাষ্ট্রি, ফাস্ট রেস কোম্পানি, বিবি ইন্টারন্যাশনাল, মিন মাও হার্ডওয়্যার, মুন ট্রেডিং, ওসজি জয়েন্টভেঞ্জার, যাহিন ইন্টেরিয়র, এস.টি বাংলাদেশ লি, সুগন্ধা ইন্টারন্যাশনাল ও এম এম ইন্টারন্যাশনাল এবং বেত্রাবতী ট্রেড। এসব প্রতিষ্ঠান খেলার সামগ্রী, জুতা, কম্পিউটার সামগ্রী, স্প্রে মেশিন, ব্যায়ামের যন্ত্রপাতি, গাড়ির সংকেত বাতি, নিরাপত্তা সেন্সর, মেডিকেল যন্ত্রপাতির আড়ালেই ক্যাসিনো সরঞ্জামাদি আনত। কেউ কেউ এনেছেন নানা কৌশল অবলম্বন করে আবার কেউ কেউ নিয়মনীতি মেনেই এনেছেন। যদিও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রিত আমদানি পণ্যের মধ্যে ক্যাসিনোতে ব্যবহার হয় এমন কোনো পণ্যের নাম নাই।

তাই এসব পণ্য আমদানি নিষিদ্ধ নয়। তবে শুল্ক গোয়েন্দারা বলেছেন, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে যারা এসব পণ্য এনেছে বা কোনো প্রতিষ্ঠান যদি শুল্ক ফাঁকি দেয়ার জন্য বেশি দামের পণ্য কম দাম দেখায় তবে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে পণ্য আনা মানে মানিলন্ডারিংয়ের শামিল। ক্যাসিনো সামগ্রী আনার ক্ষেত্রে যে কোডটি ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো ৯৫০৪৯০০। এই কোডে সাধারণত ভিডিও গেমস, বিলিয়ার্ড টেবিল, বোলিং যন্ত্রপাতি আমদানি করা হয়। এরমধ্যে এইচএস কোডে অন্যান্য নামে যে সুযোগ থাকে সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ক্যাসিনো সামগ্রী আনা হয়েছে।

এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বিল অব এন্ট্রি যাচাই করে ক্যাসিনো সামগ্রী আনার তথ্য পেয়েছেন। এখন এইসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের খোঁজে বের করে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মালিকদের জিজ্ঞাসাবাদ করে বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে শুল্ক গোয়েন্দারা। শুল্ক গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, তারা ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত অন্তত ২০টি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের হয়ে আসা চালানের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এছাড়া তাদের টেক্স ফাইল, শিপিং লাইনের সঙ্গে বিল অব এন্ট্রি, ঘোষণাকৃত পন্যের সঙ্গে ডেলিভারি পণ্যের মিল, ভ্যালু, ওজন, কোয়ান্টিটিসহ নানা বিষয়ে তদন্ত করা হচ্ছে। যেসকল প্রতিষ্ঠান মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে ক্যাসিনো সরঞ্জামাদি এনেছে তার মধ্যে এ এম ইসলাম অ্যান্ড সন্স ২০১৬ সালের ৭ই ডিসেম্বর জুতার সরঞ্জামাদি ও মোবাইল যন্ত্রপাতির ঘোষণা দিয়ে কমলাপুর কাস্টমস হাউজ দিয়ে আনা চালানের মধ্যে ক্যাসিনো সামগ্রী এনেছে বলে সত্যতা মিলেছে।

২০১৭ সালের আগস্টে এ থ্রি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল জন্মদিনের সরঞ্জাম, ২০১৭ সালের জুলাই মাসে বি পেপার মিলস লিমিটেড ফার্নিচার ঘোষণা দিয়ে, ২০১৮ সালের মে মাসে ন্যানাথ ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল কম্পিউটার মাদারবোর্ড ঘোষণা দিয়ে ক্যাসিনো সামগ্রী নিয়ে আসে। একই বছরে সিক্স সি করপোরেশন ২২টি ক্যাসিনো বোর্ড আমদানি করেছে। ক্যাসিনো সরঞ্জামাদির মধ্যে রয়েছে, স্লট মেশিন, পোকার সেট, মহজং টেবিল, চিপস, ক্যাসিনো ওয়্যার গেইম টেবিল। এসব পণ্যের দাম লাখ টাকা থেকে শুরু করে কয়েক কোটি টাকা পর্যন্ত।

অভিযোগ আছে, ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বেনাপোল কাস্টমস হাউজ দিয়ে সেখানকার কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই আমদানিকারকরা এসব পণ্যে আনতেন। আর এসব পণ্যে ঢাকাসহ সারা দেশের ক্যাসিনো হোতারাই আনাতেন। এসব পণ্যে চলে যেত ক্যাসিনো ক্লাবগুলোতে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সদ্যসরাও ইতিমধ্যে ক্যাসিনো সরঞ্জামাদি আনার ক্ষেত্রে সহযোগিতা করেছেন এমন অনেক কাস্টমস কর্মকর্তার তথ্য সংগ্রহ করেছে। নানা অনিয়মের তথ্য পাওয়ায় তাদেরকে নজরদারিতে রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *