বিকাল ৩টা থেকে রাত পৌণে ৩টা। একটি পাইপের গল্প। দীর্ঘ ১২ ঘণ্টায় সারাদেশ যেন ১৭ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপে ৩০০ থেকে ৬০০ ফুট গভীরে পড়ে ছিল। গভীর রাতে স্বরাষ্ট্রপ্রতিমন্ত্রীর ঘোষণার মাধ্যমে জাতি উদ্ধার হয়েছে বটে, কিন্তু শিশু জিহাদ উদ্ধার হয়নি।
খেলতে গিয়ে পাইপের (গর্তে) মধ্যে পড়ে যায় এক শিশু। কাছে থাকা অন্য শিশু পাইপের মধ্যে কান্না শুনতে পায়। এরপর এক প্রাপ্ত বয়স্কও কান্না শুনতে পান। ছড়িয়ে পড়ে শিশুর পাইপে পড়ে যাওয়া ঘটনা। কিন্তু কে এ শিশু, নাম নিয়ে চলে অনেক কাণ্ড। কেউ জিয়া, জিহাদ, আবার অনেকে জিয়াদ বলতে থাকে। ক্ষণিকের মধ্যে বিষয়টি গণমাধ্যমের কানে যায়। সঙ্গে সঙ্গে সরাসরি সম্প্রচারের যন্ত্র নিয়ে হাজির হন টেলিভিশন সংবাদ কর্মীরা, ফটো সাংবাদিক ও অনলাইন গণমাধ্যমের সাংবাদিকরা। যার ফলে বিষয়টি রাজধানীর শাহজাহানপুর এলাকায় না থেকে দেশ ও দেশের সীমানা পেরিয়ে বিদেশে ছড়িয়ে পড়ে। শুরু হয় জল্পনা ও কল্পনা এবং মন্তব্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একের পর এক মন্তব্য আসতে থাকে- কিভাবে? কেন? সম্ভব? এত শীতে জীবিত থাকবে? উদ্ধার করা হচ্ছে না কেন? কিভাবে উদ্ধার হবে? কোন প্রযুক্তি ব্যবহার হবে? বর্তমান অবস্থা কি? শিশুটির বাবা-মা কোথায় ? ইত্যাদি, ইত্যাদি।
এরই মধ্যে চলে আসে ফায়ার সার্ভিসের উদ্ধার কর্মীরা। সঙ্গে যুক্ত হন ওয়াসা ও রেল বিভাগের কর্মীরা। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যায়, উদ্ধার পায় না শিশুটি। পাইপের বাইরে থাকা পুরো জাতির যেন দম বন্ধ হয়ে আসে।
যা ঘটলো তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, শুক্রবার বিকেল আনুমানিক ৩টার ঘটনা, বিকেল ৫টায় ফায়ার সার্ভিসের আগমন, সন্ধ্যা ৬টায় শিশুটি বেঁচে বলে আছে ফায়ার সার্ভিসের ঘোষণা, শিশুর জন্য জুস, খাবার, অক্সিজেন ও পানি প্রেরণ, ফায়ার সার্ভিসের দড়ি প্রযুক্তি, রেলের প্রকৌশলী বরখাস্ত, সরু পাইপ টেনে তোলা, বশির আহমেদের প্রস্তুতি।
রাত সাড়ে ১১টা। পাইপের মধ্যে নেমে শিশু উদ্ধারে প্রস্তুত রানা প্লাজায় উদ্ধার অভিযানে অংশ নেওয়া বশির আহমেদ। অবশেষে বশিরকে পাইপের মধ্যে নামতে দেওয়া হলো না। বুয়েটের শিক্ষার্থীদের ক্যাচার নামের এক যন্ত্র তৈরি, আনা হলো ওয়াসার ক্যামেরা, জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শিশুটির বাবাকে আটক। এরইমধ্যে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, ‘উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন ক্যামেরা নিচে নামানো হয়েছিল, সেখানে মানুষের কোনো অস্তিত্ব দেখা যায়নি। কিছু কীটপতঙ্গের ছবি দেখা গেছে। ক্যামেরায় দেখে মনে হচ্ছে সেখানে কেউ নেই। তারপরও পাইপের নিচে যে আবর্জনা আছে সেগুলো তুলে আমরা পরীক্ষা-নীরিক্ষা করে দেখবো।’
এবার ছড়িয়ে পাড়লো পুরোটাই গুজব ছিল। এখন কি হবে! আবেগ নিয়ে খেলেছে, এই, সেই, নানা মন্তব্য। রাইজিংবিডির পাঠকদের জন্য ফেসবুকের কিছু অংশ তুলে ধরা হলো।
সবার প্রায় একই প্রশ্ন, পাইপের ভেতরে পড়ে যাওয়া শিশু জিহাদ আসলে কোথায়?
আল-আমিন লিখেছেন, ‘What`s going on? ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা নাকি শিশুটিকে খাবার খাইয়েছে, কথা বলেছে, আর এখন বলছে কিচ্ছু না ওসব। বিষয়টা কেমন হয়ে গেল? ব্যর্থতা ঢাকতে কি মাটি চাপা দিলো সবকিছু !’
সজিব লিখেছেন, ‘পোলা জন্ম দিছস পোলারে দেইখ্যা শুইন্যা রাখতে পারস না! জানস না, এই দ্যাশে ঝাঁকি মাইরা বিল্ডিং ফেলাইয়া দেওন যায়। অহন আর কি করবি, পারলে একবার শফী হুজুরের কাছে যা। মরা পোলা জিন্দা ফেরত পাইবার ইচ্ছা থাকলে ঐ একখানাই রাস্তা।’
তাওহিদ রানা লিখেছেন, ‘পাইপের মধ্যে ক্যামেরা নামিয়েও শিশু জিহাদের কোনো অস্তিত্ব পায়নি উদ্ধারকারী দল। তাহলে পাইপের ভেতরে জুস খেল কে? শীতের কাপড় গায়ে দিল কে? বুঝলাম না কিছু!’
শাহেদ লিখেছেন, ‘সারা রাত জিহাদ জুস খাইছে, কথা কিইছে, রশি ধরে উঠার চেষ্টা করছে। সকালে জিহাদ গেলো কই?’
কায়েছ লিখেছেন, ‘জিহাদের ঘটনা রহস্যই থেকে যাবে হয়ত, অনেক ঘটনা ঘটেছে পৃথিবীতে যার কোন রহস্য উদঘাটিত হয়নি। যেমন: এ বছর একটি বিমান ২০০ যাত্রী নিয়ে উড়াল দিয়ে হারিয়ে গেছে, বছর কয়েক আগেও এরকমই একটি ঘটনা ঘটেছিল। আরও জানা যায়, কিছু সাগরে জাহাজ রওনা হওয়ার পর আর ফেরত আসেনি। আসলে কোথায় গেছে, ডুবে গেছে নাকি অন্য কোন জায়গায় গেছে তাও পরে জানা যায়নি। জিহাদ কি তাই…।’
ফারহাদ হোসেন মন্তব্য করেন, ‘জিয়াদ/জিহাদ/জিয়া।’
দৃশ্যপট-১ : ৬`শ ফুট গভীর কুপ, সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা পড়ে গেল, মা বলে চিৎকার, উপরে থাকা কয়েকটি শিশু শুনল, বড়দের জানালো, শুরু হলো উদ্ধার কাজ।
দৃশ্যপট-২ : ফায়ার সার্ভিস এলো, জুস দিলো, পানি দিলো, অক্সিজেন দিলো, রশি ফেলা হলো, কয়েকবার রশি ধরে উঠার চেষ্টা করলো শিশুটি কিন্তু শেষ পর্যন্ত উঠে এলো না। সে নিচ থেকে সাড়াও দিলো। (এখানে লক্ষ্য করার বিষয়- গভীর কূপ, ঘুটঘুটে অন্ধকার, রয়েছে পানি, তীব্র শীত, পড়ার সময় নিশ্চয়ই ব্যথাও লেগেছে, সর্বোপরি সাড়ে তিন বছরের বাচ্চা, এই অবস্থায় রশি ধরে রাখা কতটুকু সম্ভব?)
দৃশ্যপট-৩ : এবার কূপে থাকা দুই ইঞ্চি ব্যাসের পাইপ (যেটা দিয়ে পানি উঠে আসতো মটরের সাহায্যে) তুলে ফেলার কাজ। ধারণা করা হচ্ছে এর সাথে সাথে শিশুটিও উঠে আসবে। তখন আমার মনে একটি কাল্পনিক ছবি ভাসছিল এরকম- শিশুটি পাইপ ধরে নিচের মটরের উপর বসে জুস খাচ্ছে, আর বলছে, একা একা খেতে চাও পাতালে এসে খাও। পাইপ তোলার কাজ শেষ হলেও শিশুটি এলো না।’
দৃশ্যপট-৪ : সর্বশেষ উচ্চ ক্ষমতার ক্যামেরা লাগিয়ে দেখা হলো, আদৌ সেখানে কোন মানুষের অস্তিত্ব নেই। তাহলে উপরের কথাগুলোর ভিত্তি কি?
রাইজিংবিডি