নেপথ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস ও তার ভাই বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লোপাট

Slider অর্থ ও বাণিজ্য

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে অর্থ লোপাটের পুরো চিত্র উঠে আসতে শুরু করেছে। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ঘটনাটি তদন্ত করছে। তদন্তের শুরুতেই সংস্থাটি যেসব প্রাথমিক তথ্য-উপাত্ত পেয়েছে তাতে নিশ্চিত যে, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা, শিক্ষা ও জনশক্তি উন্নয়ন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী একটি সিন্ডিকেটের সঙ্গে যোগসাজশ করে বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে ১০ থেকে ১২ কোটি টাকা লুটপাট করেছেন।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, থাইল্যান্ডের থমসট ইউনিভার্সিটিতে কর্মরত বাংলাদেশি ড. সেখ আলতাফুর রহমানের মাধ্যমে লুটপাটের এ ঘটনা ঘটেছে। তিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. সেখ আরিফুর রহমানের ভাই।

চলতি বছরের ‘কোটি টাকা লোপাটের ছক বিদেশ প্রশিক্ষণের নামে’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ পায়। এতে এ সংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করা হয়। এর পরই দুদক এ বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করে।

স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় থেকে বৈদেশিক প্রশিক্ষণের জন্য ১৯টি বিষয়ের আওতায় ৩১টি প্যাকেজে ৪২৬ জনের নামে সরকারি আদেশ (জিও) জারি করা হয়। প্রশিক্ষণার্থীদের সম্মানী ভাতা বাবদ ৪ কোটি ৯৭ লাখ ৯৭ হাজার ৬৭৫ টাকা ও বিমান ভাড়া বাবদ ২ কোটি ২৭ লাখ ৮৬ হাজার টাকা ব্যয় দেখানো হয়েছে। এর বাইরে টিউশন, ইনস্টিটিউশনাল ও প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় হিসেবে ১৪ কোটি ৩৭ লাখ ১১ হাজার ৪৭২ টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। সব মিলে বিদেশে প্রশিক্ষণ বাবদ ২১ কোটি ৭২ লাখ ঊনত্রিশ হাজার ১৪৭ টাকা ব্যয় নির্ধারণ করা হয়। এতে দেখা যায়, প্রশিক্ষণের জন্য জনপ্রতি ৪ হাজার ডলার অথবা ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা ব্যয় হবে। পৃথক দেশের প্রতিষ্ঠান হলেও সবগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক ব্যয় একই ধরা হয়।

বিল পর্যালোচনায় দুর্নীতির চিত্র: বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টে ছাড় করা এ সংক্রান্ত বিল পর্যালোচনায় দেখা গেছে, পাবলিক হেলথের বিভিন্ন বিষয়ে মালয়েশিয়ায় ৫৬ জনের প্রশিক্ষণের জন্য এক কোটি ৯০ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। কিন্তু টাকা পাঠানোর জন্য যে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট দেওয়া হয়, সেটি থাইল্যাণ্ডের থমসট ইউনিভার্সিটির স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজের। উল্লেখ করা হয়েছে, এই অ্যাকাউন্ট নম্বর ৪৭৫-০-৭১৫৯৭-২। এই প্রতিষ্ঠানটির ফ্যাকাল্টি সদস্য ড. সেখ মোহাম্মদ আলতাফুর রহমান। যিনি স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস আরিফুর রহমান সেখের ভাই।

১৯ জুলাই এ সংক্রান্ত বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। তখন বিষয়টি নিয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে ড. সেখ আলতাফুর রহমান বলেছিলেন, থমসট ইউনিভার্সিটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানোর বিষয়টি তার জানা নেই। এ ছাড়া মালয়েশিয়ায় থমসট ইউনিভার্সিটির কোনো শাখাও নেই। থমসট ইউনিভার্সিটিতে দু-একটি দল প্রশিক্ষণ নেবে বলে তিনি জানতে পেরেছেন। সব অভিযোগ তিনি অস্বীকার করেন।

যা আছে দুদকের জব্দ করা মেইলে: এদিকে দুদকের জব্দ করা মেইলে দেখা গেছে, চলতি বছরের ২৮ জুন সকাল ৫টা ৩১ মিনিটে ড. সেখ আলতাফুর রহমান স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলামকে মেইল করেন। মেইলের বিষয় ছিল, ‘অফার লেটার টু কনডাক্ট ফর হেলথ প্রফেশনালস ইন মালয়েশিয়া।’ সাইবারজায়া ইউনিভার্সিটি কলেজ মেডিকেল সায়েন্সের (সিইউসিএমএস) পক্ষে ড. সেখ আলতাফুর রহমান এ মেইলে লাইন ডিরেক্টরকে প্রশিক্ষণের অফার লেটার পাঠান। নিজেকে তিনি থাইল্যান্ডের থমসট ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার এবং এইচএসএ/এলএলএইচওএস, থাইল্যান্ড-মালয়েশিয়া-বাংলাদেশ-নেপাল-কম্বোডিয়ার সেক্রেটারি জেনারেল হিসেবে পরিচয় দেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, মালয়েশিয়ার মাশা ইউনিভার্সিটিতে বেসিক মেডিকেল সায়েন্সের ওপর প্রশিক্ষণের জন্য ২০ জনকে পাঠানো হয়। অধিদপ্তরের কাগজপত্রে প্রশিক্ষণের জন্য যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে ওই ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের ডিন রবীন্দ্র জাগাসেঠীর নাম ও ইমেইল দেওয়া হয়। ২০ জনের প্রশিক্ষণের জন্য মালায়ান ব্যাংকিং বারহার্ড ব্যাংকের সিইউসিএমএস নামের ৫১২৪-৪৬২০-৪১৫৫ নম্বর অ্যাকাউন্টে ৭০ লাখ ৩১ হাজার ৪৭২ টাকা পাঠানো হয়।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তারা মাশা ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি অব মেডিসিনের ডিন রবীন্দ্র জাগাসেঠীর সঙ্গে চলতি মাসের ১৭ তারিখ বিষয়টির সত্যতা জানতে মেইলে যোগাযোগ করেন। পরদিন ফিরতি মেইলে তিনি ওই প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সঙ্গে মাশা ইউনিভার্সিটির সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন।

দুদকের জব্দ করা মেইলে দেখা গেছে, মাশা ইউনিভার্সিটির সঙ্গে সিইউসিএমএস নামে একটি ইউনিভার্সিটির সম্পৃক্ততা দেখিয়ে প্রশিক্ষণের জন্য যে প্রস্তাবনা পাঠানো হয়, সেখানে ওই প্রতিষ্ঠানের যোগাযোগকারী হিসেবে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএসের ভাই ড. সেখ মোহাম্মদ আলতাফুর রহমানের নাম দেওয়া হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী ড. সেখ মোহাম্মদ আলতাফুর রহমানকে ফোন করা হলে সমকালকে বলেন, থাইল্যান্ডে কতগুলো প্রোগ্রাম হয়েছে, তা তার জানা নেই। তবে তাকে থমসট ইউনিভার্সিটির গ্লোবাল স্টাডিজের প্রোগ্রামের সমন্বয়কের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। থাইল্যান্ডে আসা প্রশিক্ষণার্থীদের তিনি দেখভাল করেছেন। এ ছাড়া মালয়েশিয়ার প্রোগ্রামের জন্য তাকে রিসোর্স পারসন হিসেবে নেওয়া হয়। এ জন্য যোগাযোগকারী হিসেবে তার নাম দেওয়া হয়েছে। তবে মালয়েশিয়ায় প্রশিক্ষণের টাকা থাইল্যান্ডে তার চাকরি করা প্রতিষ্ঠানে কেন গেছে, এর কোনো সদুত্তর তিনি দিতে পারেননি।

এ বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এপিএস ড. সেখ আরিফুর রহমানকে ফোন করা হলে তিনি সমকালকে বলেন, থাইল্যান্ডে ভাইয়ের চাকরি করা প্রতিষ্ঠানকে যে প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করা হয়েছে, তা তিনি পরে জেনেছেন। সেই ইউনিভার্সিটি তাকে যোগাযোগকারী নিয়োগ করলে সেটা তাদের ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে তার কিছুই করার নেই। তাছাড়া এই বিষয়টির সঙ্গে তিনি জড়িতই নন।

থাইল্যান্ডের পাইথাই নওয়ামিন হাসপাতালের প্রফেশনাল ট্রেনিং অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট (পিটিএম) নামে একটি প্রতিষ্ঠানের একই অ্যাকাউন্টে দুটি প্রশিক্ষণের জন্য টাকা পাঠানো হয়। ‘শর্ট টার্ম ট্রেনিং অন ডিফারেন্ট ক্লিনিক্যাল স্পেশালিটি ইআরসিপি, রিউমাটলোজি, ইমারজেন্সি পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট’ শীর্ষক এই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ৪১ জনকে পাঠানো হয়। তাদের জন্য পিটিএম নামের এই প্রতিষ্ঠানের মালয়েশিয়া এসডিএন.বিএইচডি এএম ব্যাংকের ৮৮৮১০২৬৮৮৮০৬৩২ নম্বর অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ৩৯ লাখ ৪০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। একই প্রতিষ্ঠানের একই ব্যাংক অ্যাকাউন্টে আরও ৬ কোটি ২৯ লাখ টাকা পাঠানো হয়। এখানে ‘শর্ট টার্ম ট্রেনিং অন ডিফারেন্ট ম্যনেজমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক হেলথ স্পেশালিটি’ শীর্ষক ওই প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে ১৮৫ জনকে পাঠানো হয়।

দুদকের জব্দ করা মেইলে আরও দেখা গেছে, ডা. আনোয়ার জাবেদ নামে এক ব্যক্তি চলতি বছরের ৫ মে দুপুর ১২টা ১৪ মিনিটে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার কম্পিউটার অপারেটর লায়েল হাসানকে একটি মেইল পাঠান। ওই মেইলে সংযুক্তি হিসেবে থাইল্যাণ্ডের পিয়াথাই নওয়ামিন হাসপাতাল, মালয়েশিয়ার জিডি স্পেশালিটি এবং ইন্দোনেশিয়ার এআইটি নেটওয়ার্ক নামে তিনটি প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা পাঠানো হয়। পরদিন ৬ মে বেলা ১১টা ৩ মিনিটে ডা. আনোয়ার জাবেদের পাঠানো মেইলটি লায়েল হাসান চিকিৎসা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য জনশক্তি উন্নয়ন শাখার ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার (ফরেন ট্রেনিং) ডা. মোস্তফা কামাল পাশার মেইলে ফরোয়ার্ড করেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের একাধিক সূত্র জানায়, পিটিএম নামের যে প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে, সেটি পাইথাই নওয়ামিন হাসপাতালের কোনো প্রতিষ্ঠান নয়। সেটির মালিক বাংলাদেশি সরফরাজ নেওয়াজ জিউস। তার পক্ষে বাংলাদেশে ডা. আনোয়ার জাবেদ ব্যবসাটি দেখাশোনা করেন। এ সম্পর্কে জানতে থাইল্যান্ডে অবস্থানকারী জিউসকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। ডা. আনোয়ার জাবেদকে ফোন করা হলে তিনি কোনো বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

‘শর্ট টার্ম ট্রেনিং অন ডিফারেন্ট ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক হেলথ স্পেশালিটি’ শীর্ষক প্রশিক্ষণের জন্য ৩৮ জনকে পাঠানো হয় ইন্দোনেশিয়ার এআইটি নেটওয়ার্ক নামের প্রতিষ্ঠানে। এ জন্য ইন্দোনেশিয়ার ওসিবিসি এনআইএসপি ব্যাংকের পিটি এআইটির ৬৫১৮০০০০০৭৩৯ নম্বর অ্যাকাউন্টে ১ কোটি ২৯ লাখ ২০ হাজার টাকা পাঠানো হয়।

দুদকের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ইন্দোনেশিয়ায় এআইটি নেটওয়ার্ক নামে কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব নেই। ওই প্রতিষ্ঠানের শুধু একটি ফেসবুক পেজ আছে। প্রতিষ্ঠানটির ডিরেক্টর হিসেবে বিজয়ান্ত সুহেধির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এতে তার যে ইমেইল আইডি ব্যবহার করা হয়েছে, সেটিও সঠিক নয়।

‘এক্সপোজার ভিজিট অন রোলস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস অব মেডিকেল প্রফেশনালস’ শীর্ষক অপর একটি প্রশিক্ষণের জন্য ৯ জনকে শ্রীলংকায় পাঠানো হয় কনক্যুয়েস্ট সলিউশন নামের প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটির শ্রীলংকার ন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের ১০১৬২০০০০৪৩৫ নম্বর অ্যাকাউন্টে ৩০ লাখ ৬০ হাজার টাকা পাঠানো হয়। কনক্যুয়েস্ট সলিউশনের ওয়েবসাইট ঘেঁটে দুদক কর্মকর্তারা দেখতে পেয়েছেন, প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে শিক্ষার কোনো সম্পর্ক নেই। এটি একটি ব্রডব্যান্ড সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান।

দুদক থেকে প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে থাকা মেইলে যোগাযোগ করা হলেও কোনো উত্তর আসেনি। দুদক কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, কনক্যুয়েস্ট সলিউশন নামে একটি ভুয়া প্রতিষ্ঠান দেখিয়ে অভিযুক্তরা পরস্পরের যোগসাজশে পুরো টাকা লোপাট করেছেন।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ কর্মসূচির সঙ্গে যুক্ত অভিযুক্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মেইল অ্যাকাউন্ট জব্দ করে তা পর্যালোচনা করে দুদক কর্মকর্তারা প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে পাঠানো মেইলগুলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অফিসিয়াল মেইল থেকে পাঠানোর কোনো রেকর্ড খুঁজে পাননি। এই কর্মসূচির ডিপিএম (ফরেন ট্রেনিং) ডা. মোস্তফা কামাল পাশা ও ড. সেখ আলতাফুর রহমানের মধ্যে আদান-প্রদান হওয়া মেইলগুলো পর্যালোচনা করে দুদকের কর্মকর্তারা ধারণা করছেন, বিদেশে প্রশিক্ষণের জন্য প্রতিষ্ঠানগুলো এই আলতাফুর রহমানই নির্ধারণ করেছেন। বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে টাকা লুটপাটের ঘটনার সঙ্গেও এই চক্র জড়িত।

দুদকের অভিযোগে যা আছে: গত ১৪ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের চিকিৎসক-কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিদেশে প্রশিক্ষণের নামে কোটি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনা তদন্তে মাঠে নামে দুদক। দুদকের উপ-পরিচালক মো. আলী আকবরকে দুর্নীতির এই অভিযোগ তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

তদন্তের অংশ হিসেবে দুদক ১৪ অক্টোবর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের বক্তব্য গ্রহণ করে। পরদিন অভিযুক্ত সব কর্মকর্তার মেইল অ্যাকাউন্ট জব্দ করা হয়। গতকাল রোববার মেডিকেল এডুকেশন অ্যান্ড হেলথ ম্যানপওয়ার ডেভেলপমেন্ট শাখার লাইন ডিরেক্টর অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম, প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মো. নাছির উদ্দিন, ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম আল মামুন ও ডা. মোস্তফা কামাল পাশার বক্তব্য নেওয়া হয়। আজ সোমবার একই শাখার কম্পিউটার অপারেটর (আউট সোর্সিং) সুভাষ চন্দ্র দাশ, অফিস সহকারী মো. আলমগীর. অতিরিক্ত মহাপরিচালকের দপ্তরের কম্পিউটার অপারেটর-কাম সাঁট মুদ্রাক্ষরিক লায়েল হাসানের বক্তব্য নেওয়া হবে। আগামী বুধবার আবারও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের বক্তব্য নেওয়া হবে।

দুদকের অভিযোগে বলা হয়, প্রত্যেকটি দেশের প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে অধ্যাপক ও কর্মচারীসহ সব প্রশিক্ষণার্থীর জন্য সমপরিমাণ প্রোগ্রাম ডেভেলপমেন্ট ব্যয় জনপ্রতি ৪ হাজার ডলার ধরা হয়েছে, যা বাস্তবসম্মত নয়। অতীতে একই প্রোগ্রামে গড়ে জনপ্রতি দেড় থেকে দুই হাজার ডলার ব্যয় হতো। প্রশিক্ষণের নামে জনপ্রতি গড়ে ২ হাজার ডলার অতিরিক্ত ব্যয় ধরা হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় ৭ থেকে ৮ কোটি টাকা অভিযুক্ত ব্যক্তিরা আত্মসাৎ করেন।

অভিযোগে বলা হয়, প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানই মানসম্মত নয়। ওইসব প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার না করে অন্য অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠানো হয়েছে। এসব অ্যাকাউন্ট থেকে অতিরিক্ত পাঠানো টাকা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হয়েছে। এই হুন্ডি চক্রের হোতা ডা. জাবেদ আল হাসান এবং স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টেনোগ্রাফার কাম কম্পিউটার অপারেটর লায়েল হাসান। এই দু’জনকে সরাসরি সহায়তা করেছেন প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম আল মামুন ও ডা. মোস্তফা কামাল পাশা।

থাইল্যান্ডে টাকা পাঠানোর অভিযোগ করে বলা হয়, থাইল্যান্ডের স্কুল অব গ্লোবাল স্টাডিজ, থমসট ইউনিভার্সিটি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় অনুষ্ঠিতব্য প্রশিক্ষণের টাকা পাঠানো হয়েছে, যা সম্পূর্ণ নিয়মবহির্ভূত। ওই প্রতিষ্ঠানে বাংলাদেশি এসএম আলতাব হোসেন নামে এক ব্যক্তি প্রোগ্রামটি পরিচালনা করছেন। এই আলতাব হোসেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএস ড. আরিফুর রহমান সেখের ভাই। এ ছাড়া থাইল্যান্ডের পিয়াথাই নওয়ামিন হাসপাতাল নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে অবৈধভাবে পিটিএম নামে একটি প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। পিটিএম নামের ওই প্রতিষ্ঠানের মালিক বাংলাদেশি সরফরাজ নেওয়াজ জিউস নামে এক ব্যক্তি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের সম্মতিতেই এসব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করা হয়।

এ বিষয়ে গতকাল ডা. আবুল কালাম আজাদ সমকালকে বলেন, দুদক এ বিষয়ে তদন্ত করছে। তাদের তদন্তেই প্রকৃত ঘটনা বেরিয়ে আসবে। অনিয়মের সঙ্গে কেউ যুক্ত থাকলে তার আইন অনুযায়ী শাস্তি হবে।

দুদকের তদন্ত কর্মকর্তা উপ-পরিচালক আলী আকবর জানান, পুরো বিষয়টি তারা তদন্ত করে দেখছেন। কয়েকজনের বক্তব্য নেওয়া হয়েছে। অভিযুক্ত ব্যক্তিদের জব্দ করা মেইলে দুর্নীতির বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ আলামত মিলেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। এটি শেষ হলেই বিষয়টি নিয়ে চূড়ান্তভাবে কথা বলা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *