আজ আইয়ুব বাচ্চর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী

Slider জাতীয় বাংলার মুখোমুখি


ঢাকা: আর দশজন কিশোরের মতো ফুটবল বা ক্রিকেটে নয়, চট্টগ্রাম শহরে জন্ম নেওয়া আইয়ুব বাচ্চু শুধু গান আর গিটারে মেতে থাকতেন। তারপর ১৯৮৩ সালের এক বিকেলে মাত্র ৬০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় এসেছিলেন তিনি। উঠেছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের এক হোটেলে। নিঃসঙ্গ সেই হোটেলবাসী বাংলাদেশের ব্যান্ড সংগীতের অপ্রতিদ্বন্দ্বী তারকা হয়ে উঠলেন প্রতিভা আর কঠোর পরিশ্রমে। গিটার হাতে মঞ্চে গাইলে অগুনতি দর্শক কণ্ঠ মেলাতেন তাঁর সঙ্গে, তাঁর গিটারের ঝনাৎকারে বিদ্যুৎ বয়ে যেত তরুণ-তরুণীদের শিরা-উপশিরায়। সেই চিরতরুণ গানের মানুষটির কণ্ঠ স্তব্ধ হয়ে গেল গত বছরের ঠিক এই দিনে, ১৮ অক্টোবরের সকালে। মাত্র ৫৬ বছর বয়সে আইয়ুব বাচ্চু মারা গেছেন।

৬০০ টাকা নিয়ে ঢাকায় আসা মানুষটি অগণিত মানুষের ভালোবাসা নিয়ে ফিরে গেলেন চট্টগ্রামে, নিথর দেহে। রেখে গেলেন পঁয়ত্রিশ বছরের স্মৃতি। সুখে–আনন্দে–গৌরবে কাটানো পঁয়ত্রিশটি বছরের মধ্যে যেমন রয়েছে তাঁর সংগ্রাম, তেমনি রয়েছে বেদনা, মান–অভিমান আর রোগ–শোকে ভোগার ঘটনাও।

জীবনের শেষ ১২টি দিনের হিসাব–নিকাশ করলে পাওয়া যাবে একজীবনের আইয়ুব বাচ্চুকে। যে ১২ দিনে আছে গান নিয়ে উৎসবে মেতে থাকার মুহূর্ত, আছে রোগে ভোগার গল্প। আছে গিটার জাদুকরের নতুন গিটার কেনার গল্পও। সেই ১২ দিনের খবর আজ জানব।

এমনিতে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না বাচ্চুর। শরীরকে অবশ্য খুব বেশি পাত্তা দিতেন না গানপাগল মানুষটি। বেশি চাপ নেওয়া বারণ ছিল ডাক্তারের। শরীরে অস্বস্তি ছিল। হাসপাতালে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়েও যাওয়া হয়নি। এর মধ্যে ২০১৮ সালের ৬ অক্টোবর বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) আয়োজনে হাতিরঝিলের অ্যাম্ফিথিয়েটারে দিনব্যাপী ইয়ুথ ফেস্টে এলআরবির সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে গান শোনান আইয়ুব বাচ্চু। বেসিসের ২০ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত হয়।

পরদিন অর্থাৎ ৭ অক্টোবর হাসপাতালে ডাক্তার দেখাতে যান। পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ডাক্তার জরুরি ভিত্তিতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন। জানা গেছে, সেদিন তিনি হাসপাতালে ভর্তি হতে চাননি। কিন্তু চিকিৎসকেরা জানান, তাঁর শরীরের যে অবস্থা, তাতে অবশ্যই ভর্তি হতে হবে। মনের বিরুদ্ধে ডাক্তারের পরামর্শে ওই দিন স্কয়ার হাসপাতালের করোনারি কেয়ার ইউনিটে (সিসিইউ) ভর্তি হন। ১১ অক্টোবর পর্যন্ত সিসিইউতেই ছিলেন। ১১ অক্টোবর বৃহস্পতিবার হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেয়ে সোজা চলে যান এলআরবির অফিসে, অর্থাৎ এবি কিচেনে। সঙ্গে ছিলেন এলআরবির আরেক সদস্য মাসুদ। সেখানেই খাওয়াদাওয়া করেন। পরদিন শুক্রবার এক দিন বিশ্রাম নিয়েছেন। শনিবার সকালের ফ্লাইটে চলে যান চট্টগ্রামে। ওই দিন চট্টগ্রামের জিইসি কনভেনশন সেন্টারে হয় এলআরবির শেষ কনসার্ট। সে রাতে চট্টগ্রামেই ছিলেন। অর্থাৎ ২০১৮ সালের ১৩ অক্টোবর শনিবার ছিল চট্টগ্রামে আইয়ুব বাচ্চুর শেষ রাত।

কনসার্টে অংশ নিয়ে পরদিন রোববার দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরেন। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় শেষ ভ্রমণ ছিল সেটি। শেষ ফেরার পথে আরেক কনসার্টের সূচি ঠিক হয়। এটি অবশ্য এলআরবির না, শুধু আইয়ুব বাচ্চুর। আসার পথেই ঠিক করেন, আরেকটি গিটার কিনবেন। সহযাত্রী মাসুদকে তাগাদা দেন, গিটার লাগবে। ঢাকায় ফেরার আগে আগে যেন স্টুডিওতে গিটার চলে আসে। মাসুদ যোগাযোগ করেন বাদ্যযন্ত্রের বিক্রয় প্রতিষ্ঠান মেলোডিতে।

স্টুডিওতে চারটি গিটার চলে এসেছে। সেখান থেকে বাছাই করে ৬৫ হাজার টাকায় একটি গিটার কিনে নেন। স্টুডিওতে বসেই গিটারের টিউন, অ্যালাইন ঠিকঠাক করেন আইয়ুব বাচ্চু ও মাসুদ মিলে। সেখানে থেকে বাচ্চু চলে যান গানবাংলা অফিসের উদ্দেশে। মাসুদ চলে যান নিজের বাসায়। এক দিন পর অর্থাৎ ১৬ অক্টোবর চলে যান রংপুরে। সন্ধ্যায় রংপুরেই শেষবারের মতো মঞ্চে ওঠেন আইয়ুব বাচ্চু। সেখানে নিজেই ফোন নিয়ে সেলফি তুলেছেন, সে ছবিতে দেখা যায় গানবাংলার জ্যেষ্ঠ সংগীতশিল্পী জানে আলম, সংগীতশিল্পী কৌশিক হোসেন তাপস ছাড়াও আরও কয়েকজন সংগীতশিল্পী। পরদিন বুধবার দুপুরে ঢাকায় ফেরেন।

রংপুরের কনসার্টে আইয়ুব বাচ্চুর শেষ গান ছিল ‘এক আকাশে তারা তুই’। মঞ্চে তিনি আরও গেয়েছিলেন, ‘আর বেশি কাঁদালে উড়াল দেব আকাশে’। গানের কথাই যেন সত্যি হলো, মাত্র এক দিনের ব্যবধানে তিনি যেন আকাশে উড়াল দিয়ে চলে গেলেন। ২০ অক্টোবর বিকেলে চট্টগ্রামের বাইশ মহল্লা চৈতন্য গলি কবরস্থানে নিজের ইচ্ছানুযায়ী মায়ের কবরের পাশে সমাহিত করা হয় আইয়ুব বাচ্চুকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *