যত অনাচার, অন্যায় ও অপরাধ সংঘটনের ধারাবাহিকতায় নতুন নতুন অপরাধ থেকে মহামারী আকারে ঘৃন্যতম অপরাধের জন্ম হয়, সেসবের কারণ বিশ্লেষনে পাওয়া যাবে নিজেদের ব্যর্থতাই। যে সন্তান অসামাজিক কাজে লপ্তি হয়ে যায়, সেজন্য অভিভাবকেো অনেকটাই দায়ী। এর কারণ হল, তারা কেন পারিবারিক শাসন করতে পারলেন না। আদরের পথ বন্ধ করে শাসন প্রতিষ্ঠা যেমন করা যায় না ঠিক তেমনি শাসন বন্ধ রেখে আদর দেয়া, বিপদ থেকে মুক্ত করে না বরং বেশী করে বিপদে ফেলে দেয়। আদর ও শাসনের ভারসাম্য তৈরী করে সন্তানের প্রতি সৃষ্ট ভালবাসারই সংকট আমাদের। তীব্র সংকট। এই পারিবারিক ভালবাসার সংকটের কারণেই নতুন নতুন অপরাধ নানা আবরণে বিস্ফোরিত হচ্ছে সময়-অসময়ে। আর অপরাধের মাত্রা ও ধরণ দেখে আঁতকে উঠছি আমরা। এই অবস্থা থেকে বের হতে হলে আমাদের সম্মিলিতভাবে চিন্তা ভাবনা করতে হবে। ভাবতে হবে এই ধরণের ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরীর আসল কারণ কি। কারণ চিহিৃত করে প্রতিকার করার মাধ্যমে ভবিষৎ মসৃন করতে না পারলে আমাদের গন্তব্য কেউ ঠেকাতে পারবে না। আমরা চলে যাব ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে।
পরিস্থিতি পর্যালোচনায় দেখা যায়, অনেক অভিভাবক আছেন, সন্তানকে অতিরিক্ত আদর দিয়ে নষ্ট করার জন্য দায়ী। নিজের সন্তান ভুল করলে সন্তানের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তিনি সন্তানকে উৎসাহ দিয়ে অপরাধী করে তোলেন। এই সাহস যে নিজের সন্তানকে অপরাধী করে ধ্বংস করে দিবে সেটা তিনি জেনেও না জানার ভান করেন। এমনো দেখা যায়, সন্ত্রাসী সন্তানের জন্য বাবা-মা গর্বও করেন। মাস্তান ছেলের বাবা-মা হয়ে সামজে দাপিয়ে বেড়ান। সন্তানের অবৈধ টাকায় বাবা-মা বড়লোকী করেন ও বড়লোকও হন। তবে সন্তান যখন ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরী করে বিপদে পড়েন বা মারা যান তখন অনেক বাবা-মা সন্তানের লাশের বিরুদ্ধেও অবস্থান নেন। অনেকে আবার লাশের পক্ষে বিপক্ষে না গিয়ে শুধুই কাঁদেন। এই কান্নার কারণ হল নিজেদের আত্মসমর্পনও বটে। যখন চোখের পানি দিয়ে অনুশোচনা করেন, তখন আর প্রিয় সন্তানটি থাকে বা থাকে না। থাকলেও আর নিজের সন্তান হয়ে থাকে না। অন্যের নিয়ন্ত্রনে চলে যায়। তখন বাবা-মা কত কর্মের জন্য বুক চাপড়িয়ে বিলাপ করেন। এই বিলাপ অবশ্য অর্থহীন হয়। কোন কাজে আসে না।
যারা ভালকে তৈরী করবে, তারা যদি নিজেদের ভুলের জন্য ভালকে মন্দ করে ফেলে, তবে ভাল আর ভাল থাকে না, মন্দ হয়ে আসে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা অনেক সময় রাজনীতি করতে গিয়ে যে সব ভুল করে ফেলি, বিপদে পড়ে আবার তার অনুশোচনাও করি। কিন্তু তখন আর ভুল, ভুল থাকে না। মহাবিপদ হয়ে সামনে দাঁড়ায়। যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। আমরা বুঝতে পারি না যে, নিজের মসৃন পথ তৈরী করতে গিয়ে নিজের মত অনেক অন্যের সম্পদ বা রক্ত দিয়ে ফুলেল রাস্তা তৈরী বিপদজনক। কারণ আমি মানুুষ হয়ে আমার জন্য তৈরী রাস্তায় আরেক মানুষের রক্ত পায়ে মেখে যাচ্ছি, কোন সুখের রাজ্যে! সেটা ভাবি না। ভাবী যখন সময় থাকে না। রাজনীতিতে গুরু শিস্যের খেলা দেখছি আমরা। গুরুকে ডিঙিয়ে শিস্য চলে যায় এটাই স্বাভাবিক। কারণ গুরুর তো আর শিস্যকে ডিঙাতে হয় না। রাজনীতিতে গুরু-শিস্যের রক্তমাখা হেলিখেলা দেখতে আজ আমরা চরম সীমায় পৌঁছে গেছি। অনেক সময় দেখছি, শিস্যের হাতে গুরু শেষ হচ্ছে বেশী।
সাম্প্রতিক সময়ের সরকারগুলো কর্মকান্ড বিশ্লেষন করলে সহজেই বুঝা যায যে, ক্ষমতায় থাকা, ক্ষমতায় যাওয়া এই দুটো কাজের জন্য তারা মরিয়া থাকে। ক্ষমতায় যাওয়া-আসার যে ঘোড়া তার গতি বেড়ে গেছে অনেক। এই গতি থামাতে হবে। ঘোড়া থেকে নামতে হবে। তারপর আস্তে ধীরে সবাইকে নিয়ে পথ চলতে হবে। পথচারী হয়ে চললে সকলে সাথে থাকে। ঘোড়য় চড়ে গেলে এক -দুইজনের বেশী যাওয়া যায় না। তাই ক্ষমতায় যাওয়া-আসার কাজটি পায়ে হেঁটেই করা উত্তম।
আক্ষেপ করে বলতে হয়, যে যখন সরকারে আসে তখন প্রথমিকভাবে যে কাজগুলো করেন, তা তাদের জন্যই যে বিপদজনক হয়, তা তারা বুঝে, যখন ক্ষমতা না থাকে। সরকারগুলো যখন ক্ষমতায় থাকার জন্য আইন নিয়ন্ত্রন করে নিজেদের মত করে রাখে ও ব্যবহার করে ঠিকই তবে তারাই বিপদে পড়ে তখন, যখন ক্ষমতার বাইরে যায়। কয়েক দশকের সরকারগুলো ক্ষমতায় গিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাষ্ট্রের মালিকের বিরেুদ্ধে ব্যবহার করে। সরকারী বন্দুক যখন মালিকের বুকের দিকে তাক করা হয়, তখনই গনতন্ত্র বা মৌলিক অধিকার ধ্বংস করার সংকেত চলে আসে। রাষ্ট্রযন্ত্র ব্যবহারের মাধ্যমে যখন মত প্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব হয়ে যায়, তখনি আপদে এগিয়ে আসে।
আমরা ধারণা করতে পারি, সরকার যদি রাষ্ট্রযন্ত্রকে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবহার না করতো, তবে কোন সরকারাই জোর করে ক্ষমতায় আসতে পারত না। আর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের রাজনীতি যদি চলমান থাকতো, তবে অপরাজনীতি আসল রাজনীতিকে আক্রমন করতে পারত না। একই সঙ্গে গণমাধ্যমের দিকে রক্তচোখ করে তাকিয়ে না থাকলে গণমাধ্যম আগাম অনেক তথ্যই দিতে সক্ষম হতো। রাষ্ট্রযন্ত্র ও গণমাধ্যম প্রভাবমুক্ত থাকলে ক্যাসিনো, জঙ্গীবাদ আর কাঁচা বয়সে সন্ত্রাসী হওয়ার কারখানা তৈরীর আগাম খবর হয়ত সরকার আগেই পেযে যেতে পারতো। এমনটা হলে হয়ত আজকের দিনে মেধাবীদের হাতে মেধাবী খুনের মত শিক্ষালয়েরও জন্ম নাও হতে পারত।
আমরা চাই, অতীত ও বর্তমান থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষৎ পরিকল্পনা করা। তা না হলে ক্ষমতায় থাকলে যাকে ভালবাসিনা, ঘৃনা করি, আর ক্ষমতা চলে গেলে তাকেই ভালবাসি, এই রীতিতেই থাকতে হবে আমাদের। না থাকলেও থাকতে হয়, এটাও জানি সবাই।
জাতি আশা করে, ভালবাসা সব সময় স্বতন্ত্র থাকুক। সময়ে অসময়ে ভালবাসার প্রয়োগ ভিন্ন ভিন্ন অর্থে আবির্ভূত হউক, তা চাই না আমরা। ভালবাসা থাকুক এক ও অভিন্ন অর্থের। যার ব্যবহার হতে হবে অপপ্রয়োগহীন,সকলের জন্য সমান ও অপরিবর্তিত। যেন আমরা সকলেই সকলের প্রয়োজনে সব সময় বলতে পারি, তোমাকেই ভালবাসি। ভালবাসব। সব সময়। ভালবাসা এক ও অভিন্ন।