ঢাকা: আবরার ফাহাদ ও দাইয়ান নাফিস প্রধান- দু’জনই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শেরেবাংলা হলের আবাসিক শিক্ষার্থী। আরও কিছু মিল রয়েছে তাদের। বছরখানেক আগে তাকেও আবরারের মতো ছাত্রলীগের টর্চার সেলে যেতে হয়েছিল। ছাত্রলীগের যে নেতাকর্মীরা নির্যাতন চালিয়ে আবরারকে হত্যা করেছে, ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে দাইয়ানকেও বেধড়ক মারধর করেছিল তারা।
তবে অমিলও আছে। সবচেয়ে বড় অমিল হলো, মেরে ফেলা হয়নি দাইয়ানকে। আবরারের তুলনায় পুরোপুরিই ‘ভাগ্যবান’ তিনি। আবরারকে শিবির আখ্যা দিয়ে নির্যাতন করতে করতে মেরেই ফেলা হয়। ‘ভাগ্যবান’ দাইয়ানকে প্রাণে না মেরে পুলিশে দেওয়া হয়। হলের খাবার নিয়ে ফেসবুকে রম্য লেখার কারণে আবরারকে হত্যার একদিন আগেও ‘টর্চার সেলে’ ২০০৫ নম্বরে ডাক পড়েছিল দাইয়ানের। যে কক্ষে গত রোববার মধ্যরাতে এক দফা মারধর করা হয়েছিল আবরারকে।
গতকাল বৃহস্পতিবার দাইয়ানকে পাওয়া গেল আবরারের হত্যাকারীদের বিচারের দাবিতে সমবেত শিক্ষার্থীর ভিড়ে। তার সঙ্গে কী হয়েছিল, তা বলতে রাজি হচ্ছিলেন না। কিছুক্ষণ ইতস্তত করার পর বলতে লাগলেন দুঃস্বপ্নময় সেই রাতের কথা।
গত বছরের ২৯ জুলাই বিমানবন্দর সড়কে বাসচাপায় নিহত হন কলেজ শিক্ষার্থী রাজীব ও দিয়া। নিরাপদ সড়কের দাবিতে সারাদেশে রাস্তায় নামে শিক্ষার্থীরা। কয়েক দিন পর ৪ ও ৫ আগস্ট ধানমণ্ডিতে আন্দোলনকারীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ নামধারীরা। সে সময় সেখানে ছিলেন দাইয়ান। যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, তা টুকে রাখেন তিনি ফেসবুকে। একটি শোনা কথা যাচাই ছাড়াই ফেসবুকের স্ট্যাটাসে উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু পরে তা সংশোধনও করেন ব্যাখ্যাসমেত। ২০১৮ সালের ৫ আগস্ট ফেসবুকে ওই স্ট্যাটাস পোস্ট করেছিলেন দাইয়ান।
দু’দিন পর ৭ আগস্ট হলে ফিরলে সন্ধ্যা ৭টার দিকে শেরেবাংলা হলে দাইয়ানের ৪০০৫ নম্বর কক্ষে আসেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মেহেদী হাসান রবিন। আবরার হত্যার আসামি হয়ে রবিন এখন কারাগারে। দাইয়ানের সহপাঠী তিনি। রবিন তাকে রুমে থাকতে বলেন।
তারপর দাইয়ানের কক্ষে আসেন বুয়েট ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক মেহেদী হাসান রাসেল। সঙ্গে ছিলেন যন্ত্র প্রকৌশল ১৩ ব্যাচের শিক্ষার্থী দিহান। এরপর শুরু হয় ‘জিজ্ঞাসাবাদ’। কেন দাইয়ান নিরাপদ সড়কের আন্দোলন নিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন? কেন ‘বড় ভাইদের’ অনুমতি না নিয়ে আন্দোলনে গিয়েছেন? হলে থেকে আন্দোলনে যাওয়ার সাহস কোথায় পেয়েছেন? দাইয়ান যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেন। তিনি যে তার স্ট্যাটাসে একটি শোনা কথা লিখেছিলেন এবং তা পরে সংশোধন করেছেন, সেটাও জানান। এ জন্য ক্ষমাও চান তিনি। তাকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন মেহেদী হাসান রাসেল, রাজ ও দিহান।
এক দফা চড়-থাপ্পড়ের পর চলে দাইয়ানের কম্পিউটারে ‘তল্লাশি’। কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলনকারীদের নানা ‘ট্রল’ মজার ছলে সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন প্রকৌশলের ছাত্র দাইয়ান। বিশেষজ্ঞ ও পরিবেশবিদদের পরিবেশ-সংক্রান্ত নানা অভিমত এবং লেখাও সেভ করে রাখতেন তিনি কম্পিউটারে। এই শখও কাল হয় তার। এসব লেখাকে ‘সরকারবিরোধী’ হিসেবে রাসেল, রাজ ও দিহান ক্রিকেট স্টাম্প দিয়ে পেটায় তাকে। এ সময় আবরার হত্যার সঙ্গে জড়িত অনেকেও ছিলেন ৪০০৫ নম্বর কক্ষে।
দাইয়ানকে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে বুয়েটে শিবিরের আর কে কে আছে, তা জানতে চেয়ে বেড়ধক মারধর করা হয়। স্টাম্পের প্রতিটি আঘাতে চেয়ার থেকে কাত হয়ে লুটিয়ে পড়ছিলেন তিনি। কিন্তু কেন কান্নাকাটি করছেন না- এই প্রশ্ন তুলে আরও বেশি মারধর করা হয় তাকে। পায়ের পাতা থেকে ঊরু পর্যন্ত, প্রতিটি ইঞ্চিতে স্টাম্প দিয়ে পেটানো হয়। এভাবে কাটে দুর্বিষহ একটি ঘণ্টা।
এরপর হলের অফিস কক্ষে নেওয়া হয় দাইয়ানকে। সেখানে ছিলেন হলের প্রভোস্ট। কিন্তু তিনি ছাত্রকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসেননি। এরপর আসেন সম্প্রতি পদচ্যুত ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রাব্বানী। দাইয়ানের কাছে একটি ওষুধের বাক্স ছিল। যাতে তিনি সিম, পেনড্রাইভ, মডেম, মেমোরি কার্ড ও কার্ড রিডার রাখতেন। একে ‘সিম বক্স’ আখ্যা দিয়ে রাব্বানী ফেসবুক লাইভে এসে বলেন, দাইয়ানের সঙ্গে জঙ্গিদের যোগাযোগ রয়েছে। এ কথা মনে হলে এখনও কষ্ট পান দাইয়ান। এ কথা ভেবে এখনও শিউরে ওঠেন যে একজন বুয়েট ছাত্রকে জঙ্গি সাজানো যায় কত সহজে!
এরপর দাইয়ানকে পুলিশে দেওয়া হয়। যাকে মারধর করা হলো, তাকেই পুলিশে সোপর্দ করা হলো কেন- তা এখনও বুঝতে পারেন না দাইয়ান। পুলিশের কাছে ভালো ব্যবহার পেয়েছেন দাইয়ান। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের মামলায় পাঁচ দিন রিমান্ডে ছিলেন। জিজ্ঞাসাবাদকারী পুলিশ কর্মকর্তারা সদয় ছিলেন, কেউ একটি আঘাতও করেননি। রিমান্ড শেষে কেরানীগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঁচ দিন হাজতবাসের পর জামিনে মুক্তি পান দাইয়ান।
দাইয়ানের বাবা নীলফামারীর চিলাহাটি সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বুয়েটে এসে উপাচার্যের সাক্ষাৎ পাননি। দাইয়ানের পরিবার পায়নি বুয়েট প্রশাসনের তেমন কোনো সহযোগিতা। যাদের বিরুদ্ধে দাইয়ানকে নির্যাতনের অভিযোগ উঠেছে, তারা কারাগারে ও পলাতক থাকায় তাদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল।
সহপাঠীরা জানান, দাইয়ানকে নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা হলের ফটকে অবস্থান নিয়েছিলেন। এরপর তাদের ওপর পাইকারি অত্যাচার নেমে আসে। সিসিটিভির ফুটেজ দেখে প্রতিবাদকারীদের ‘শনাক্ত’ করেন ছাত্রলীগ নেতারা। তারপর টর্চার সেলগুলোতে নিয়ে মারধর করা হয়। আবরার হত্যায় নাম আসা রাসেল, রবিন, মুন্না, অনিক সরকার, অমিত সাহা, ইফতি মোশাররফ সকাল, ইশতিয়াক আহমেদ মুন্না, মেফতাহুল ইসলাম জিওন, মুনতাসির আলম জেমি, মুহতাসিম ফুয়াদসহ অন্যরা তাদের মারধর করেছেন বলে অভিযোগ দাইয়ানের সহপাঠীদের।
দাইয়ানের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগের রাজনীতির সমর্থক। এক মামা ছাত্রলীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা ও ডাকসুর নেতা। তার সহযোগিতাতেই হলে ফিরেছেন দাইয়ান। ঝামেলা এড়াতে পুরনো দিনের কথা আর বলতে চান না। তবে আবরার হত্যার ঘটনায় পুরো বুয়েটসহ সারাদেশ যেভাবে জেগে উঠেছে, তাতে আশান্বিত তিনি। তাই তিনিও রাস্তায় নেমে এসেছেন। জেল থেকে ছাড়া পেলেও এখনও হাজিরা দিতে হয় তাকে। আশায় আছেন সুবিচার পাবেন। মিথ্যা মামলা থেকে রেহাই পাবেন।