ঢাকা:বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পর বেরিয়ে আসছে নির্যাতনের রোমহর্ষক নানা ঘটনা। সামান্য সব বিষয় নিয়ে সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর বিভিন্ন কায়দায় চালানো হতো নির্যাতন। একজন শিক্ষার্থীকে নিজের সহপাঠীদের দিয়ে থাপ্পড় দেওয়ানো থেকে শুরু করে বিভিন্ন দফায় মারধরের এমন কিছু ঘটনা কল্পনাকেও হার মানায়। জোরপূর্বক স্বমেহনের অভিনয় করতে বাধ্য করা হয়। স্টাম্প কিংবা রড দিয়ে এমনসব জায়গায় আঘাত করা হয়, যাতে কাউকে দেখানোর উপায় না থাকে। এ ছাড়া কারও সঙ্গে ব্যক্তিগত কোনো বিরোধ থাকলে রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে তার ওপর চালানো হতো নির্যাতন।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ– ছোটখাটো কোনো বিষয়েও ছাত্রলীগ নেতাদের কাউকে পছন্দ না হলে ‘শিবির’ আখ্যা দিয়ে কিংবা অন্যকিছু বলে তাদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়। এর বিরুদ্ধে কেউ মুখ খোলার সাহস পান না। কথা বললেই শিবির আখ্যা দেওয়া হয়। কোনো কারণে নেতাদের অবাধ্য হলেই তার ওপর নির্যাতন অবধারিত। এ ছাড়া চুল বড় রাখা, ছাত্রনেতাদের সালাম না দেওয়া, দাঁড়ি রাখার মতো বিষয়েও শিক্ষার্থীদের মারধর করা হয়।
এক ছাত্রের কাছে টাকা ধার চেয়ে না পেয়ে তাকে উল্টো ঝুলিয়ে নাকে গরম পানি ঢালা হয় বলে জানা গেছে। এ ধরনের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে নিপীড়িত শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিত। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, নির্যাতনের বিচার না হওয়ায় বারবার এরকম ঘটনা ঘটছে।
আবরারের হত্যার পর বুয়েটের সাবেক এক শিক্ষার্থী নিজে নির্যাতিত হওয়ার ছবিসহ ফেসবুকে একটি পোস্ট দিয়েছেন, যা ইতোমধ্যে ভাইরাল হয়েছে। এনামুল হক নামের ওই শিক্ষার্থী জানান, এসব মারের দাগ (পিঠে আঘাতের চিহ্ন পোস্ট করা ছবি) আবরারের নয়, এগুলো তার শরীরেরই ছবি। আবরার মারা গেলেও সেবার ছাত্রলীগ কর্মীর নির্যাতনের পরও প্রাণে বেঁচে ফিরেছেন তিনি।
এতে তিনি লিখেন, ‘বুয়েটের ওএবি’র (পুরাতন একাডেমিক ভবন) দোতলায় মেকানিক্যাল ড্রয়িং কুইজ দেওয়া শেষ হওয়া মাত্রই পরীক্ষার রুম থেকে ছাত্রলীগ নেতা তন্ময়, আরাফাত, শুভ্র জ্যোতির নেতৃত্বে ৮-১০ জন আমাকে শিক্ষকের সামনে থেকে তুলে নিয়ে আহছানউল্লাহ হলের তখনকার টর্চার সেল ৩১৯ নম্বর রুমে নিয়ে নির্যাতন করে। আমি কারো সাথে রাগারাগি পর্যন্ত করতাম না, কারো সাথে কখনোই সম্পর্ক খারাপ ছিলো না। শুধুমাত্র ফেসবুকে সরকারি নীতির সমালোচনা করে পোস্টের কারণে বুয়েটের মতো একটা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রলীগ আমার সাথে এমন আচরণ করে।’
তিনি আরও লিখেছেন, ‘এসব অপরাজনীতি থাকলে ক্যাম্পাসে রক্ত ঝরবেই। তাই নির্যাতিত ছাত্র হিসেবে দাবি জানাই, ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ নিশ্চিত হোক, ছাত্র এবং শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক।’
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নতুন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেওয়ার ঘটনার কথা বিভিন্ন সময়ে উঠে এলেও সব প্রতিষ্ঠানকে ছাপিয়ে গেছে বুয়েটের ঘটনাবলি। সাহস করে অনেকেই এখন মুখ খুলতে শুরু করেছেন। লিখছেন নির্যাতনবিরোধী গ্রুপে।
গত বছরের জুনে মিছিলে যেতে দেরি করায় শেরেবাংলা হলের শিক্ষার্থী সাখাওয়াত অভিকে ২০১১ নম্বর কক্ষে নিয়ে বেদম প্রহার করেন বুয়েট ছাত্রলীগের উপ-আইন সম্পাদক অমিত সাহা। এতে অভির হাত ভেঙে যায়। পরে তাকে দিয়ে বলানো হয়, সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে হাত ভেঙে গেছে।
আসছে অমিত সাহার নাম: বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার হত্যাকাে ও অমিতের নাম বারবারই ঘুরেফিরে আসছে। তার কক্ষেই খুন হন আবরার। তবে ঘটনার দিন তিনি ছিলেন না বলে বন্ধুরা ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলেও এখন তারা বলছেন ভিন্ন কথা। গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর সবুজবাগ এলাকা থেকে তাকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ।
অমিতের সহপাঠী সুকান্ত জয় বলেন, ‘ক্লাসের অন্য দশটা মানুষের মতো তার সঙ্গেও আমাদের বন্ধুত্ব ছিল। আবরারের হত্যকাে র পর অমিত দাবি করে- ঘটনার সময় সে অনুপস্থিত ছিল। এ ঘটনায় তাকে ফাঁসানো হয়েছে বলে দাবি করে সে। তার দাবি, তখন সে আবির সাহার বাসায় অবস্থান করছিল। সেজন্য আমরা অমিতের পক্ষে ফেসবুক গ্রুপে কিছু স্টেটমেন্ট দেই। কিন্তু এরপর বের হয়ে আসা তথ্যে (স্ট্ক্রিনশট) সবার মতো তার সম্পৃক্ততা নিয়ে আমাদেরও আর সন্দেহ নেই। এ কারণে তার পক্ষে সমর্থন প্রত্যাহার করছি।’
বুয়েটের ছাত্র নাশিদ সিফাত বলেন, ‘আমরা জানি এরকম ঘটনায় একদম ধোয়া তুলসিপাতা কাউকে হঠাৎ করে জড়ানো সম্ভব না। অবশ্যই অমিতের একাধিক ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। আমাদের এই অসচেতনতার জন্যই আজ এদের মতো অপরাধীর জন্ম। অমিত সাহা যে অপরাধই করে থাকুক, আমরা তার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি জানাচ্ছি এবং তার বন্ধু হিসেবে আমরা খুবই লজ্জিত এবং দুঃখিত। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক বিচার হোক সেটাই আমরা চাই।’
শেরেবাংলা হলের এক শিক্ষার্থী জানান, গত ১৫ আগস্ট তাদের জোর করে মিছিলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেদিন রাতে শেরেবাংলা হলের কমনরুমে সবাইকে ডেকে নিয়ে তার ব্যাচের (১৬ ব্যাচ) সব ছেলেকে দিয়ে তাকে থাপ্পড় মারা হয়। তারপর ওখান থেকে তাকেসহ নয়জনকে আলাদা করে ছাদে তোলা হয়। সেখানে গিয়ে প্রথমেই মুন্না নামের একজন থাপ্পড় দিয়ে তার চশমা ভেঙে ফেলে। এতে তার দাঁতে ঠোঁট কেটে রক্ত বের হয়। এরপর তাকে স্টাম্প দিয়ে মারা হয়। এমনকি পরে ৫০০ বার কান ধরে উঠবস করতেও বলে। তিনি জানান, হলে আসার প্রথমদিকে মুন্নাকে নিজের বরাদ্দকৃত রুম ছেড়ে না দেওয়াই ছিল তার অপরাধ।
একই হলের আরেক শিক্ষার্থী বলেন, একবার তাকেসহ আরও ৫/৬ জনকে ‘বড় ভাই’দের সঙ্গে দেখা করতে যেতে বলা হয়। তারা বিলম্বে যাওয়ায় ১০১০ নম্বর রুমে নিয়ে গিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন করতে থাকে। কেন দেখা করতে যায়নি, কেন শার্টের হাতা ভাঁজ করে রাখে ইত্যাদি। একপর্যায়ে তাদের নিজেদের দিয়ে নিজেদের থাপ্পড় দেওয়ান এক বড় ভাই। থাপ্পড়ের শব্দ কম হওয়ায় পুনরায় দেওয়ান। তারপর পলাশী থেকে বেত কিনে এনে জেমি নামের একজনসহ কয়েক বড় ভাই আরেক দফা মার দেন।
বুয়েটের ছাত্ররা জানান, গত বছরের ১৪ জানুয়ারি ক্যাম্পাস থেকে এক ছাত্রকে ধরে বেদম প্রহার করে জিমনেশিয়ামের কাছে নিয়ে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে যাওয়া হয়। ঘটনাটির অনেক প্রত্যক্ষদর্শী থাকলেও পরে কোনো বিচার হয়নি। এ ঘটনার মূল হোতা ছিলেন বুয়েট ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি মিনহাজুল ইসলাম। গত বছর রশিদ হলে ভোজের ফি না দেওয়ায় হলের ৪০৫ নম্বর রুমে সিভিল সায়েন্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ১৫তম ব্যাচের শিক্ষার্থী নাসিমকে বেধড়ক মারধর করা হয়। জানা গেছে, গত বছর রশিদ হলে শিবির সন্দেহে ১৩ ব্যাচের নগর পরিকল্পনা বিভাগের ছাত্র সেতুকে মারধর করে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়।
নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে রশিদ হলের এক ছাত্র জানান, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ না নিলে শিক্ষার্থীদের লিস্ট করা হয় এবং পরে সে অনুযায়ী ডেকে নিয়ে ইচ্ছামতো মারধর করা হয়। এ ছাড়া সামান্য কোনো বিষয় নিয়েও শিক্ষার্থীদের বিভিন্নভাবে টর্চার করা হয়। এক্ষেত্রে লাঠি, স্টাম্প, হকিস্টিকসহ কাছে যা পায়, তা দিয়েই অমানবিকভাবে মারধর করে।
তিতুমীর হলের এক ছাত্র জানান, ২০১৪ সালের দিকে হলে আসার পর দুটি আলাদা দলে ভাগ করে র্যাগিং দিতে দেখেন। একদল রাজনৈতিক, আরেক দল অরাজনৈতিক। সালাম না দেওয়া কিংবা সিনিয়রিটির ভাব দেখানোর অভিযোগে তিনি গালি, থাপ্পড় ও স্টাম্প দিয়ে মারধরের শিকার হয়েছেন বহুবার।
মাস্টার্সের শিক্ষার্থী মাহদী বলেন, নিয়মিতই ঘটত শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনা। কিন্তু প্রশাসন কোনো বিচার করত না। প্রশাসনকে জানানো হলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হতো না। উল্টো নির্যাতিত শিক্ষার্থীকেই হল থেকে বহিষ্কার কিংবা পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা রয়েছে।